সুওয়াল-জাওয়াব বিভাগ

সংখ্যা: ২২২তম সংখ্যা | বিভাগ:

মুহম্মদ আযহারুল ইসলাম

কিশোরগঞ্জ

 

সুওয়াল :  মাসিক মদীনা অক্টোবর ২০১২ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রশ্নোত্তর বিভাগে বলা হয়েছে- “দুই সাজদার মাঝখানে স্থির হয়ে বসা ওয়াজিব। দুই সাজদার মাঝখানে নি¤েœর দুআ পড়া মুস্তাহাব। ‘আল্লাহুম্মাগফিরলী ওয়ার হামনী, ওয়ার যুক্বনী, ওয়াহদিনী। এই দুআ পড়া যায় পরিমাণ বসা যায় এতক্ষণ বসে থাকলে চুপচাপ না থাকা দুআ পড়া স্থিরভাবে বসা হলে উঠে যাওয়া যায়…।”

আর মাসিক মদীনা আগস্ট ২০১২ ঈসায়ী সংখ্যার প্রশ্নোত্তর বিভাগে বলা হয়েছে, “দোয়াটি দুই সাজদার মাঝে বসা অবস্থায় পড়ার কথা রয়েছে। ফরয, ওয়াজিব, সুন্নত ও নফল সব নামাযেই পড়া যাবে।”

এখন আমার সুওয়াল হলো- দুই সিজদার মধ্যে উক্ত দোয়াটি পড়া সম্পর্কে মাসিক মদীনার উক্ত বক্তব্য সঠিক হয়েছে কি? কারণ মাসিক মদীনার উক্ত বক্তব্য দ্বারা এটাই সাবিত হয় যে, দুই সিজদার মধ্যে উক্ত দোয়াটি ফরয নামাযসহ সমস্ত নামাযে পড়া মুস্তাহাব। অথচ আমরা জানি, ফরয নামাযের দুই সিজদার মাঝে উক্ত দোয়াটি পড়া যাবেনা। বরং শুধুমাত্র নফল নামাযের মধ্যে উক্ত দোয়াটি পড়া যাবে। আমাদের এ ধারণা কি সঠিক দয়া করে দলীলভিত্তিক সঠিক? জাওয়াব দানে বাধিত করবেন।

জাওয়াব :  দুই সিজদা উনার মাঝে উক্ত দোয়াটি পড়া সম্পর্কে মাসিক মদীনার সম্পাদক মাহিউদ্দীনের উক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণই ভুল ও অশুদ্ধ হয়েছে। কারণ   দুই সিজদার মাঝে উক্ত দোয়াটি আমাদের হানাফী মাযহাব মোতাবিক ফরয নামাযে পড়া যাবেনা বরং উক্ত দোয়াটি শুধুমাত্র নফল নামাযের ক্ষেত্রে প্রয়োজ্য। যেমন এ প্রসঙ্গে সর্বজনমান্য, অনুসরণীয় ও নির্ভরযোগ্য হানাফী মাযহাবের বিখ্যাত ফিক্বাহ্র কিতাব “মারাকিউল ফালাহ” কিতাবের ১৭৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-

ومقدار الجلوس عندنا بين السجدتين مقدار تسبيحة وليس فيه ذكر مسنون كما فى السراج وكذا ليس بعد الرفع من الركوع دعاء وما ورد فيهما محمول على التهجد كما فى مجمع الانهر

অর্থ : “হানাফী মাযহাব মোতাবিক দুই সিজদা উনার মাঝখানে এক তাসবীহ্ পরিমাণ বসা (ওয়াজিব)। এবং দুই সিজদা উনার মাঝখানে মাসনূন কোন  যিকির (দোয়া) নেই। যেমন “সিরাজে” (অর্থাৎ সিরাজুল ওয়াহহায নামক কিতাবে) বর্ণিত আছে। অনুরূপ রুকু থেকে মাথা উঠানোর পর কোন দোয়া নেই। আর রুকুর পর এবং দুই সিজদা উনার মাঝখানে যে সকল দোয়াগুলি বর্ণিত হয়েছে তা তাহাজ্জুদ (নফল) নামাযের জন্য প্রযোজ্য। যেমন- “মাজমাউল আনহুর” কিতাবে বর্ণিত আছে।”

“রদ্দুল মোহতার” কিতাবের দ্বিতীয় খ-ের ২১৩ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে-

وبين السجدتين اللهم اغفرلى وارحمنى وعافنى واهدنى وارزقنى … محمول على النفل اى تهجدا او غيره.

অর্থ : “আর দুই সিজদা উনার মাঝে-

اللهم اغفرلى وارحمنى وعافنى واهدنى وارزقنى

এই দোয়াটি পড়া ……তাহাজ্জুদ নামায অথবা অন্যান্য নফল নামাযের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

“মাজমাউল আনহুর” কিতাবের প্রথম খণ্ডের ৯৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-

وليس بين السجدتين ذكر مسنون عندنا وكذا بعد رفعه وما ورد فيهما من الدعاء فمحمول على التهجد.

অর্থ : “আমাদের হানাফী মাযহাবে দুই সিজদা উনার মাঝে মাসনূন কোন যিকির (দোয়া) নেই। অনুরূপ রুকু থেকে মাথা উঠানোর পর কোন দোয়া নেই।” আর রুকূ উনার পর এবং দুই সিজদা উনার মাঝখানে যে সকল দোয়াগুলি বর্ণিত হয়েছে তা তাহাজ্জুদ নামায উনার ক্ষেত্রে প্রয়োজ্য।

“মাজমাউল আনহুর” কিতাবের হাশিয়ায় উল্লেখ আছে-

ولا بين السجدتين وبعد الرفع من الركوع دعاء وما ورد محمول على النفل تهجدا او غيره.

অর্থ : “দুই সিজদা উনার  মাঝে এবং রুকু থেকে মাথা উঠানোর পর কোন দোয়া নেই। ……… আর রুকু উনার পর এবং দুই সিজদা উনার  মাঝখানে যে সকল দোয়াগুলি বর্ণিত হয়েছে তা নফল, তাহাজ্জুদ অথবা অন্যান্য (নফল-মুস্তাহাব) নামায উনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।”

“মিশকাত শরীফ উনার” ৮৪ পৃষ্ঠায় বাইনাস সুতুরে উল্লেখ আছে-

وهو  محمول على التطوع عندنا

অর্থ :“দুই সিজদা উনার  মাঝে উক্ত দোয়াটি পড়া সম্পর্কিত পবিত্র হাদীছ শরীফখানা আমাদের মাযহাবে নফল নামায উনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।”

আর মিশকাত শরীফ উনার শরাহ “মিরকাত শরীফ উনার” দ্বিতীয় খণ্ডের ৩২৬ পৃষ্ঠায় হাদীছ শরীফখানা বর্ণনার পর বলা হয়েছে-

وهو محمول على التطوع عندنا

অর্থ : ‘‘ইমামুল মুহাদ্দিছীন হযরত মোল্লা আলী ক্বারী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, দুই সিজদা উনার  মাঝে উক্ত দোয়াটি পড়া সম্পর্কিত হাদীছ শরীফখানা আমাদের হানাফী মাযহাবে নফল নামায উনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।”

আর “ইলাউস সুনান” কিতাব উনার তৃতীয় খণ্ডের ৩৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে-

ولو تركه رأسا لا يلام عليه فان هذا الذكر ورد فى صلاة الليل دون المكتوبة كما يظهر من مجمع الاحاديث ولذا قال الشرنبلالى فى نور الايضاح وليس فيه اى فى الجلوس بين السجدتين ذكر مسنون والوارد فيه محمول على التهجد.

অর্থ : “যদি উক্ত দোয়াটি একেবারেই না পড়ে, তাহলে সে তিরস্কৃত হবেনা। নিশ্চয়ই এ দোয়াটি তাহাজ্জুদ নামায উনার জন্য বর্ণিত হয়েছে।  ফরয নামায উনার জন্য নয়। যা পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার সমষ্টিগত বর্ণনা দ্বারা সুস্পষ্ট। এজন্য আল্লামা শারাম্বলালী রহমতুল্লাহি আলাইহি “নূরুল ইযাহ” কিতাবে উল্লেখ করেছেন যে, দুই সিজদা উনার মাঝের বৈঠকে কোন মাসনূন দোয়া নেই। আর এ সম্পর্কিত বর্ণনাগুলি তাহাজ্জুদ নামায উনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।”

আবূ দাউদ শরীফ উনার শরাহ “বজলূল মাজহুদ উনার” দ্বিতীয় খণ্ডের ৬৮ পৃষ্ঠায় দুই সিজদা উনার মাঝে উক্ত দোয়া পড়া সম্পর্কিত পবিত্র হাদীছ শরীফখানা বর্ণনা করার পর বলা হয়েছে-

وقال القارى وهو محمول على التطوع عندنا

অর্থ : “হযরত মোল্লা আলী ক্বারী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, আমাদের হানাফী মাযহাব মোতাবিক উক্ত দোয়াটি নফল নামায উনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।”

“নুরুল ইজাহ” কিতাবের ৭৬ পৃষ্ঠায়

بين السجدتين

এর ব্যাখ্যায় বাইনাস সুতূরে উল্লেখ  আছে-

وليس فيه ذكر مسنون

অর্থ : “দুই সিজদা উনার মাঝে কোন মাসনূন যিকির বা দোয়া নেই।”

‘ইবনে মাজাহ শরীফ উনাতে’ স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উক্ত দোয়াটি তাহাজ্জুদ নামাযে পাঠ করতেন। যেমন ইবনে মাজাহ শরীফ উনার ১ম জিঃ ৬৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-

عن حضرت ابن عباس رضى الله تعالى عنهما قال كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول بين السجدتين فى صلوة الليل رب اغفرلى وارحمنى واجبرنى وارزقنى وارفعنى

অর্থ : “হযরত ইবনে আব্বাস রদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি তাহাজ্জুদ নামাযে দুই সিজদা উনার মাঝে এই দোয়াটি পড়তেন-

رب اغفرلى وارحمنى واجبرنى وارزقنى وارفعنى

হ্যাঁ, শাফিয়ী, হাম্বলী ও অন্যান্য মাযহাবে ফরয, নফল উভয় নামাযেই উক্ত দোয়াটি পাঠ করা জায়িয। যেমন, “তিরমিযী শরীফ” উনার ১ম খণ্ডের ৩৮ পৃষ্ঠায় উক্ত হাদীছ শরীফ উনার ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, এই দোয়াটি শাফিয়ী, হাম্বলী ও অন্যান্য মাযহাবে ফরয নামাযেও পাঠ করা জায়িয রয়েছে। যেমন-

وبه يقول الشافعى واحمد واسحق يرون هذا جائزا فى الـمكتوبة والتطوع

অর্থ : “ইমাম শাফিয়ী, আহমদ ও ইসহাক রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনারা বলেন, ‘‘ইহা (অর্থাৎ উক্ত দোয়াটি) ফরয ও নফল নামায উনার দুই সিজদা উনার  মাঝে পড়া জায়িয আছে।”

“তিরমীযী শরীফ” উনার শরাহ্ “আরিদাতুল আহওয়াজী” কিতাব উনার দ্বিতীয় খণ্ডের ৮১ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে-

وبه يقول الشافعى واحمد واسحق يرون هذا جائزا فى الـمكتوبة والتطوع

অর্থ : হযরত ইমাম শাফিয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি, ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহি ও ইসহাক রহমতুল্লাহি আলাইহি উনারা বলেন, ইহা (অর্থাৎ উক্ত দোয়াটি) ফরয ও নফল নামায উনার দুই সিজদা উনার  মাঝে পড়া জায়িয আছে।”

মোটকথা হলো- শাফিয়ী, হাম্বলী ও অন্যান্য মাযহাবে ফরয নামায উনার দুই সিজদা উনার  মাঝেও উক্ত দোয়াটি পড়া জায়িয রয়েছে।

আর আমাদের হানাফী মাযহাব উনার ফতওয়া মোতাবিক ফরয নামাযে দুই সিজদা উনার  মাঝে উক্ত দোয়াটি পাঠ করলে ফরয বা রোকন আদায়ে তা’খীর বা বিলম্ব হওয়ার কারণে সাহু সিজদা ওয়াজিব হবে। সুতরাং আমাদের হানাফী মাযহাবে উক্ত দোয়াটি পড়া যাবেনা।

“ফতওয়ায়ে শামী” কিতাবের দ্বিতীয় খণ্ডের ২১২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-

لو اطال هذه الـجلسة او قومة الركوع اكثر من تسبيحة بقدر تسبيحة ساهيا يلزمه سجود السهو.

অর্থ : “যদি দুই সিজদা উনার মাঝে এবং রুকু থেকে দাঁড়ানোর পর ভুলেও এক তাসবীহ পরিমাণের চেয়ে বেশি বিলম্ব করে তাহলে ওয়াজিব তরক হবে এবং সাহু সিজদা আবশ্যক হবে।

আরো উল্লেখ্য যে, উক্ত দোয়াটি পড়া সম্পর্কে হাদীছ শরীফ উনার শরাহ ও ফতওয়ার কিতাবগুলিতে

دون الـمكتوبة، التطوع، النفل، التهجد.

 (ফরয ব্যতীত নফল, তাহাজ্জুদ ইত্যাদি নামাযে বলা হয়েছে।)

অতএব, উল্লিখিত আলোচনা থেকে এটাই ছাবিত হলো যে, মাসিক মদীনার উক্ত বক্তব্য ভুল। কারণ   দুই সিজদার মাঝে উক্ত দোয়াটি আমাদের হানাফী মাযহাব মোতাবিক ফরয নামাযে পড়া যাবেনা বরং উক্ত দোয়াটি শুধুমাত্র নফল নামাযের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

 

মাসিক মদীনার উদ্ধৃত দলীল মিথ্যা

 

উল্লেখ্য যে, মাসিক মদীনার সম্পাদক মাহিউদ্দীন তার উক্ত বক্তব্যের স্বপক্ষে দলীল হিসেবে দুটি কিতাবের বরাত দিয়েছে। ১. দুরুল মুখতার, ২. ফতওয়ায়ে আলমগীরী। অথচ “দুররুল মুখতার” কিতাবে উল্লেখ আছে-

وليس بينهما ذكر مسنون وكذا ليس بعد رفعه من الركوع دعاء … وما ورد محمول على النفل اى تـهجدا او غيره.

অর্থ : দুই সিজদা উনার মাঝে মাসনূন কোন যিক্র (দোয়া) নেই। অনুরূপ রুকু থেকে মাথা উঠানোর পর কোন দোয়া নেই।………. আর রুকুর পর এবং দুই সিজদা উনার মাঝখানে যে সকল দোয়াগুলি বর্ণিত হয়েছে, তা নফল নামায উনার জন্য প্রযোজ্য। অর্থাৎ দুই সিজদা উনার মাঝে বর্ণিত দোয়াগুলি তাহাজ্জুদ নামায অথবা অন্যান্য নফল নামাযে পড়া যাবে।

তাছাড়া “দুররুল মুখতার” কিতাব উনার   শরাহ “গায়াতুল আওতার” কিতাব উনার ১ম খ-ের ২৩৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-

اور دونوں سجدوں کے درمیان میں  کوئی ذکر مسنون نھیں اور اسیطرح رکوع سے سر اٹھا نے کے بعد  کوئی دعا مسنون نھیں … اور جو ذکر یا دعائیں کہ اں مواضع میں وارد ھیں وہ نفل نماز پر محمول ھیں.

অর্থ : “দুই সিজদা উনার মাঝখানে মাসনূন কোন যিকির (দোয়া) নেই। অনুরূপ রুকু থেকে মাথা উঠানোর পর মাসনূন কোন দোয়া নেই। ………. আর রুকুর পর এবং দুই সিজদা উনার মাঝখানে যে সকল দোয়াগুলি বর্ণিত হয়েছে তা নফল নামায উনার জন্য প্রয়োজ্য।”

দ্বিতীয়তঃ মাসিক মদীনার সম্পাদক মাহিউদ্দীন তার উক্ত বক্তব্যের স্বপক্ষে দলীল হিসেবে ফতওয়ায়ে আলমগীরী কিতাব উনার বরাত দিয়েছে, অথচ “ফতওয়ায়ে আলমগীরী” কিতাব উনার ১ম খণ্ডের ৭৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-

وليس فى هذا الجلوس ذكر مسنون عندنا هكذا فى الجوهرة النيرة.

অর্থ : “এই বৈঠকে অর্থাৎ দুই সিজদা উনার মাঝের বৈঠকে আমাদের হানাফী মাযহাবে মাসনূন কোন  যিকির (দোয়া) নেই।”

এছাড়াও “ফতওয়ায়ে হিন্দিয়া” কিতাবের ১ম খণ্ডের ১১৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-

اس جلوس میں ہمارے نزدیک  کوئی ذکر مسنون نھیں یہ جوھرۃ النیرۃ میں لکھا ھے.

অর্থ : ঐ বৈঠকে (অর্থাৎ দুই সিজদা উনার মাঝে) আমাদের হানাফী মাযহাবে কোন মাসনূন যিকির (দোয়া) নেই। ইহা “জাওহারাতুন নাইয়্যারাহ” কিতাবে উল্লেখ আছে।

আর “জাওহারাতুন নাইয়্যারাহ” কিতাবের ৬৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-

وليس فى هذا الجلوس ذكر مسنون عندنا

অর্থ : “এই বৈঠকে অর্থাৎ দুই সিজদা উনার মাঝের বৈঠকে আমাদের হানাফী মাযহাবে মাসনূন কোন যিকির (দোয়া) নেই।

অতএব, উপরোক্ত দলীলভিত্তিক আলোচনা দ্বারা এটাই সাব্যস্ত হলো যে, উক্ত দোয়াটি ফরয নামায উনার দুই সিজদা উনার মাঝে পড়া যাবেনা বরং শুধুমাত্র নফল ও তাহাজ্জুদ নামায উনার দুই সিজদা উনার মাঝে উক্ত দোয়াটি পড়া যাবে। সুতরাং মাসিক মদীনার সম্পাদক মাহিউদ্দীনের এ ভুল মাসয়ালার সংশোধনী দিয়ে খালিছ তওবা ইস্তিগফার করার সুযোগ রয়েছে। অন্যথায় প্রদত্ত ভুল মাসয়ালা আমলকারীর সমূদয় গুণাহর বোঝা তার কাঁধেই বর্তাবে।

{দলীলসমূহ : (১) তিরমিযী শরীফ, (২) আবূ দাউদ শরীফ, (৩) ইবনে মাজাহ শরীফ, (৪) নাসাঈ শরীফ, (৫) মিশকাত শরীফ, (৬) মিরকাত শরীফ, (৭) ই’লাউস সুনান, (৮) বযলুল মজহুদ, (৯) মুসনাদে আহমদ, (১০) হাকিম, (১১) বাইহাকী শরীফ, (১২) আরিদাতুল আহ্ওয়াজী, (১৩) তানবীরুল আবছার, (১৪) আলমগীরী, (১৫) হিন্দিয়া, (১৬) শামী, (১৭) দুররুল মুখতার, (১৮) রদ্দুল মুহতার, (১৯) গায়াতুল আওতার, (২০) হাশিয়ায়ে তাহতাবী, (২১) খানিয়া, (২২) মুহীত, (২৩) শরহে মুনিয়া, (২৪) খাযায়িন, (২৫) নাহরুল ফায়িক, (২৬) জাওহারাতুন নাইয়্যারাহ, (২৭) সিরাজুল ওয়াহ্হাজ, (২৮) মারাকিউল ফালাহ, (২৯) মাজ্মাউল আন্হুর, (৩০) নুরুল ইজাহ্, (৩১) বাহারে শরীয়ত ইত্যাদি।}

 

মুহম্মদ আতিকুর রহমান খান

লাঙ্গল কোট, কুমিল্লা

সুওয়াল: জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, ঢাকা-২০১৩ কর্তৃক নির্ধারিত ষষ্ঠ শ্রেণীর ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’ বইয়ের ২য় পৃষ্ঠায় তাওহিদে বিশ্বাসের উদাহরণ দিতে গিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মহান আল্লাহ পাক উনার নবী ও রসূল হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তিনি এক মূর্তিপূজক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং উনার পিতা ছিলেন মন্দিরের পুরোহিত। নাউযুবিল্লাহ! এ বিষয়ে সঠিক ফায়ছালা জানিয়ে আমাদের ঈমান-আক্বীদা হিফাযত করবেন।

জাওয়াব: হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনারা প্রত্যেকেই খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক উনার তরফ থেকে এরূপভাবে মনোনীত যে, উনাদের কারো পিতা-মাতা পর্যন্ত কেউই কাফির কিংবা মুশরিক ছিলেন না। বরং উনাদের মধ্যে অনেকে নবী ও রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন আর যাঁরা নবী ও রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না উনারা ঈমানদার তো অবশ্যই উপরন্তু উনারা ছিলেন উনাদের যুগে মহান আল্লাহ পাক উনার লক্ষস্থল বান্দা ও ওলী উনার অন্তর্ভুক্ত। এটাই হচ্ছে পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, পবিত্র ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদের মত এবং আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহ উনাদের মত। এ মতের বিপরীত মত, অর্থ, ব্যাখ্যা, বক্তব্য, লিখনী সবই কুফরীর অন্তর্ভুক্ত।

কাজেই, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, ঢাকা-২০১৩ কর্তৃক নির্ধারিত ষষ্ঠ শ্রেণীর ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বইয়ের ২য় পৃষ্ঠায় মহান আল্লাহ পাক উনার নবী ও রসূল হযরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার সম্মানিত পিতা ও পরিবার সম্পর্কে যে মারাত্মক কুফরী লিখনী ছাপা হয়েছে তা অতিসত্বর মুছে ফেলা উচিত এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে এ কুফরীর জন্য খালিছ তওবা ইস্তিগফার করার পাশাপাশি শুদ্ধ ও সঠিক লিখনী প্রকাশ করা ফরয ওয়াজিব। অন্যথায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ প্রত্যেকেই এ কুফরীর কারণে ঈমান ও ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে কাট্টা কাফির ও মুরতাদে পরিণত হবে এবং কুফরীর হালতে মৃত্যুমুখে পতিত হয়ে পরকালে জাহান্নামের কঠিন আযাব-গযবের সম্মুখীন হবে।

প্রকৃতপক্ষে খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক উনার নবী ও রসূল হযরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার পিতা ছিলেন পরিপূর্ণ দ্বীনদার, পরহেযগার, খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক উনার মত ও পথের পরিপূর্ণ অনুসারী একজন খালিছ ঈমানদার।

সর্বোপরি তিনি ছিলেন খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক উনার রুবূবিয়াত প্রকাশের মহানতম ওসীলা। কেননা সমগ্র মাখলূক্বাত বা কায়িনাত সৃষ্টির যিনি মূল উৎস সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র ওজুদ নূর মুবারক উনার একজন মহান ধারক-বাহক।

হযরত আদম ছফীউল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার থেকে শুরু করে যে সকল মনোনীত ও সম্মানিত পুরুষ-মহিলা আলাইহিমুস সালাম ও আলাইহিন্নাস সালাম উনাদের মাধ্যমে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র ওজুদ নূর মুবারক হযরত আব্দুল্লাহ যবীহুল্লাহ আলাইহিস সালাম এবং হযরত আমিনা আলাইহাস সালাম উনাদের পর্যন্ত পৌঁছেছে উনারা সকলেই ছিলেন সর্বকালের সর্বযুগের শ্রেষ্ঠতম পবিত্রতম সুমহান ব্যক্তিত্ব। উনাদের মধ্যে কেউই কাফির, মুশরিক বা বেদ্বীন ইত্যাদি ছিলেননা। উনারা সকলেই ছিলেন খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টিপ্রাপ্ত খাছ বান্দা-বান্দি উনাদের অন্তর্ভুক্ত।

মূলত যারা হযরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার সম্মানিত পিতা বা পরিবারকে মূর্তিপূজক হিসেবে অভিহিত করে কুফরী কাজটি করে থাকে তারা পবিত্র হাদীছ শরীফ ও পবিত্র তাফসীর শরীফ উনাদের সম্পর্কে নেহায়েত অজ্ঞ ও জাহিল হওয়ার কারণেই করে থাকে। এছাড়া তারা মহান আল্লাহ পাক উনার মনোনীত নবী ও রসূল হযরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার মহানতম ও পবিত্রতম শান, মান, মর্যাদা, মর্তবা সম্পর্কে এবং উনার সুমহান পরিচয় সম্পর্কে চরম অজ্ঞ ও গ- মূর্খ হওয়ার কারণে এবং পবিত্র সূরা আনআম শরীফ উনার ৭৪ নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে ব্যবহৃত لابيه ازر উনার মূল ও সঠিক অর্থ যা পবিত্র হাদীছ শরীফ ও পবিত্র তাফসীর শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে তা গ্রহণ না করে তার বিপরীতে শুধুমাত্র আভিধানিক বা শাব্দিক অর্থের উপর ভিত্তি করে অর্থ ও ব্যাখ্যা গ্রহণ করার কারণে কারে থাকে। যা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।

অথচ পবিত্র কুরআন শরীফ উনার পবিত্র আয়াত শরীফসমূহ উনাদের কোন ক্ষেত্রে ব্যক্তির শান বা মর্যাদা অনুযায়ী অর্থ ও ব্যাখ্যা করতে হবে। কোন ক্ষেত্রে পবিত্র হাদীছ শরীফ অনুযায়ী যে অর্থ ও ব্যাখ্যা গ্রহণ করা হয়েছে সে অনুযায়ী অর্থ ও ব্যাখ্যা গ্রহণ করতে হবে। কোন ক্ষেত্রে অনুসরণীয় হযরত মুফাসসিরীনে কিরাম যে অর্থ ও ব্যাখ্যা গ্রহণ করেছেন, সে অনুযায়ী অর্থ ও ব্যাখ্যা গ্রহণ করতে হবে এবং কোন ক্ষেত্রে পবিত্র কালাম উনার শান বজায় রেখে শাব্দিক বা আভিধানিক অর্থ ও ব্যাখ্যাও গ্রহণ করতে হবে। তবে সবক্ষেত্রে শাব্দিক অর্থ ও ব্যাখ্যা আদৌ গ্রহণীয় ও অনুসরণীয় নয়। বরং ক্ষেত্র বিশেষ তা কুফরী এবং কাফির ও জাহান্নামী হওয়ার কারণও বটে।

যেমন মহান আল্লাহ পাক উনার শান মুবারকে পবিত্র সূরা আলে ইমরান শরীফ ৫৪নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে ব্যবহৃত مكر শব্দ মুবারক উনার আভিধানিক বা শাব্দিক অর্থ ‘ধোকাবাজির’ পরিবর্তে ‘হিকমত’ গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় কুফরী হবে।

অনুরূপভাবে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার শান মুবারকে পবিত্র সুরা দ্বুহা শরীফ উনার মধ্যে ব্যবহৃত ضالا শব্দ মুবারক উনার শাব্দিক অর্থ ‘বিভ্রান্ত’ তার পরিবর্তে ‘কিতাববিহীন’ অর্থ গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় কুফরী হবে।

একইভাবে পবিত্র সূরা হিজর শরীফ ৯৯নং আয়াত শরীফ উনার মধ্যে اليقين শব্দ মুবারক উনার শাব্দিক বা আভিধানিক অর্থ ‘বিশ্বাস’ গ্রহণ না করে ‘মৃত্যু’ অর্থ গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় কুফরী হবে। এমনি ধরনের আরো বহু পবিত্র আয়াত শরীফ রয়েছে যাদের শুধুমাত্র আভিধানিক অর্থের উপর ভিত্তি করে অর্থ ও ব্যাখ্যা গ্রহণ করা হলে অশুদ্ধ ও কুফরী হবে। যেরূপ কুফরী হয়েছে পবিত্র সূরা আনআম শরীফ উনার ৭৪ নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখিত اب (আবুন) শব্দ মুবারক উনার শাব্দিক অর্থ ও ব্যাখ্যা গ্রহণ করে।

যেমন মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

واذ قال ابرهيم لابيه ازر اتتخذ اصناما الـهة.

অর্থ : “আর যখন হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম উনার চাচা আযরকে বললেন, আপনি কি মূর্তিকে ইলাহ (মা’বুদ) হিসেবে গ্রহণ করছেন?” (পবিত্র সূরা আনআম শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ৭৪)

এ আয়াত শরীফে ابيه  উনার মধ্যে اب (আবুন) শব্দ মুবারক উনার শাব্দিক একটি অর্থ পিতা গ্রহন করে বলা হচ্ছে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম উনার পিতা। কিন্তু হযরত ইমাম-মুজতাহিদ ও আউলিয়ায়ে কিরামগণ উনাদের সর্বসম্মত মতে, এখানে ابيه শব্দ মুবারক উনার প্রকৃত অর্থ হচ্ছে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম উনার চাচা। অর্থাৎ উদ্ধৃত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে اب (আবুন) শব্দ মুবারক উনার অর্থ পিতা না হয়ে উনার অর্থ হবে চাচা। কারণ, পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার অনেক স্থানেই اب (আবুন) শব্দটি পিতা ব্যতীত অন্য অর্থেও ব্যবহৃত হয়েছে।

যেমন মহান আল্লাহ পাক তিনি উনার কালাম পাক উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন-

ام كنتم شهداء اذ حضر يعقوب الموت اذ قال لبنيه ما تعبدون من بعدى قالوا نعبد الـهك واله ابائك ابرهيم واسمعيل واسحق الـها واحدا.

অর্থ : “তোমরা কি উপস্থিত ছিলে? যখন হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম উনার বিছাল শরীফ উনার সময় উপস্থিত হলো তখন তিনি উনার সন্তানগণ উনাদেরকে বললেন, ‘আপনারা আমার পর কার ইবাদত করবেন? উনারা উত্তরে বললেন, ‘আমরা আপনার রব তায়ালা উনার এবং আপনার পূর্ব পিতা (আপনার দাদা) হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম উনার এবং (আপনার চাচা) হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম উনার এবং (আপনার পিতা) হযরত ইসহাক আলাইহিস সালাম উনার একক রব খালিক্ব মালিক মহান আল্লাহ পাক উনার ইবাদত করবো।” (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১৩৩)

এ আয়াত শরীফ উনার মধ্যে اب (আবুন) দ্বারা দাদা, চাচা ও পিতা সকলকে বুঝানো হয়েছে। যেমন, এ সম্পর্কে  বিশ্বখ্যাত তাফসীর ‘তাফসীরে মাযহারী’-এর ৩য় খণ্ডের ২৫৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-

وكان ازر على الصحيح عما لابراهيم والعرب يطلقون الاب على العم كما فى قوله تعالى نعبد الـهك واله ابائك ابراهيم وسماعيل واسحاق الـها واحدا.

অর্থ : “বিশুদ্ধ মতে, আযর ছিলো হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম উনার চাচা। আর আরবরা চাচাকেও اب (আবুন) শব্দে অভিহিত করে থাকে।” যেমন মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন, আমরা আপনার প্রতিপালক ও আপনার পূর্বপুরুষ হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম, হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম ও হযরত ইসহাক আলাইহিস সালাম উনার একক প্রতিপালক মহান আল্লাহ পাক উনার ইবাদত করবো।”

“তাফসীরে মাযহারী” কিতাবের ৩য় খণ্ডের ২৫৬ পৃষ্ঠায় আরো উল্লেখ করা হয়েছে-

والعرب يطلقون الاب على العم.

অর্থ : “আরববাসীরা الاب (আল আবু) শব্দটি চাচার ক্ষেত্রেও ব্যবহার করেন।” তাফসীরে কবীর কিতাবের ১৩তম খণ্ডের ৩৮ পৃষ্ঠায়ও অনুরূপ উল্লেখ রয়েছে।

সুতরাং, পবিত্র সূরা আনআম শরীফ উনার ৭৪নং আয়াত শরীফে ابيه ازر এর অর্থ হলো আযর হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস্ সালাম উনার চাচা। উনার পিতা নন।

এ সম্পর্কে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে এসেছে-

عن حضرت ابن عباس رضى الله تعالى عنه ان ابا ابراهيم عليه السلام لم يكن اسمه ازر وانما كان اسمه تارخ.

অর্থ : “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বর্ণনা করেন, নিশ্চয়ই হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম উনার পিতার নাম আযর নয়। বরং উনার পিতার নাম মুবারক হলো হযরত তারাখ আলাইহিস সালাম।” (ইবনে আবি হাতিম শরীফ, ইবনে কাছীর শরীফ- ৩/২৪৮)

ان والد ابراهيم عليه السلام ما كان مشركا وثبت ان ازر كان مشركا فوجب القطع بان والد ابراهيم كان انسانا اخر غير ازر.

অর্থ : “নিশ্চয়ই হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম উনার পিতা (হযরত তারিখ আলাইহিস সালাম) মুশরিক ছিলেননা। বরং আযর (উনার চাচা) মুশরিক ছিল। কেননা, অকাট্যভাবে প্রমাণিত যে, নিশ্চয়ই হযরত ইবরাহীম আলাইহিস্ সালাম উনার পিতা আযর নয়। বরং অন্য একজন অর্থাৎ হযরত তারাখ বা তারাহ আলাইহিস সালাম।” (তাফসীরে কবীর শরীফ- ১৩/৩৯)

এ সম্পর্কে তাফসীরে কবীর শরীফ ১৩/৩৮ পৃষ্ঠায় আরো উল্লেখ রয়েছে-

ان والد ابراهيم عليه السلام كان تارخ وازر كان عماله والعم قد يطلق عليه اسم الاب.

অর্থ : “নিশ্চয়ই হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম উনার সম্মানিত পিতা ছিলেন হযরত তারাখ আলাইহিস সালাম। আর আযর ছিলো উনার চাচা। এবং আম্মুন (চাচা) শব্দটি কখনও ‘ইসমুল আব’ অর্থাৎ পিতা নামে ব্যবহৃত হয়।”

তাফসীরে মাযহারী- ৩/২৫৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-

ليس ازر ابا لابراهيم انما هو ابراهيم بن تارخ.

অর্থ : “আযর হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম উনার পিতা নয়। বরং নিশ্চয়ই তিনি (হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম) হলেন হযরত তারাখ বা তারাহ আলাইহিস সালাম উনার সুযোগ্য সন্তান।”

তাফসীরে মাযহারী- ৩/২৫৬ পৃষ্ঠায় আরো উল্লেখ আছে-

وفى القاموس ازر اسم عم ابراهيم عليه السلام واما ابوه فانه تارخ.

অর্থ : “ক্বামূস অভিধানে উল্লেখ করা হয়েছে, আযর হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম উনার চাচার নাম। আর নিশ্চয়ই উনার পিতার নাম হলো হযরত তারাখ আলাইহিস সালাম।”

মূলতঃ হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তিনিসহ সকল হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামগ উনাদের পিতা-মাতা বা পূর্বপুরুষ ছিলেন পরিপূর্ণ ঈমানদার, খালিছ মু’মিন। কেউই কাফির ছিলেন না।

এ সম্পর্কে কিতাবে বর্ণিত রয়েছে-

ان اباء الانبياء ماكانوا كفارا ويدل عليه وجوه منها قوله وتقلبك فى الساجدين.

অর্থ : “নিশ্চয়ই সকল হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের পিতা বা পূর্বপুরুষ কেউই কাফির ছিলেননা। তার দলীল হচ্ছে, খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক উনার এ কালাম বা  আয়াত শরীফ। মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন-

وتقلبك فى السجدين.

অর্থ : “তিনি আপনাকে (হে আমার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম!) সিজদাকারীগণ উনাদের মধ্যে স্থানান্তরিত করেছেন।” (পবিত্র সূরা শুয়ারা শরীফ ২৯, তাফসীরে কবীর- ১৩/৩৮)

প্রকাশ থাকে যে, মহান আল্লাহ পাক উনার জলীলুল কদর নবী ও রসূল হযরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি হলেন সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পূর্বপুরুষ।

এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

ملة ابيكم ابرهيم هو سمكم المسلمين.

অর্থাৎ- “তোমরা তোমাদের পিতৃপুরুষ হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম উনার পবিত্র দ্বীন উনার উপর কায়িম থাক। তিনি তোমাদের নাম রেখেছেন মুসলমান।” (পবিত্র সূরা হজ্জ শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ৭৮)

কাজেই, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যাঁদের মাধ্যমে যমীনে তাশরীফ এনেছেন অর্থাৎ হযরত আদম ছফীউল্লাহ আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে হযরত আব্দুল্লাহ যবীহুল্লাহ আলাইহিস সালাম পর্যন্ত উনারা সকলেই ছিলেন সিজদাকারী। অর্থাৎ সকলেই নামায-কালাম, যিকির-আযকার, ইবাদত-বন্দিগীতে মশগুল ছিলেন। উনারা সকলেই পূর্ণ পরহেযগার, মুত্তাক্বী ও ধার্মিক ছিলেন।

এ সম্পর্কে পবিত্র তাফসীর শরীফ উনার মধ্যে আরো বর্ণিত রয়েছে-

فالاية دالة على ان جميع اباء محمد صلى الله عليه وسلم كانوا مسلمين وحينئذ يجب القطع بان والد ابراهيم عليه السلام كان مسلما.

অর্থ : “উপরোক্ত আয়াত শরীফ উনার দ্বারা এটাই ছাবিত বা প্রমাণিত যে, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পূর্বপুরুষ উনারা সকলেই পরিপূর্ণ মুসলমান ছিলেন। এ থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত বা সাব্যস্ত যে, নিশ্চয়ই হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম উনার পিতা মুসলমান ছিলেন।” (তাফসীরে কবীর শরীফ- ১৩/৩৮)

পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন-

لـم ازل انقل من اصلاب الطاهرين الى ارحام الطاهرات.

অর্থ : “আমি সর্বদা পূত-পবিত্র নারী ও পুরুষ উনাদের মাধ্যমেই স্থানান্তরিত হয়েছি।” সুবহানাল্লাহ! (তাফসীরে কবীর শরীফ- ১৩/৩৯)

তিনি আরো বলেন-

لـم يلتق ابوى قط على سفاح.

অর্থ : “আমার পিতা-মাতা (পূর্বপুরুষ) কেউই কখনও কোন অন্যায় ও অশ্লীল কাজে জড়িত হননি।” (কানযুল উম্মাল শরীফ, ইবনে আসাকীর বারাহিনে  কাতিয়া)

পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো বর্ণিত হয়েছে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিয়্যীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

بعثت من خير قرون بنى ادم قرنا فقرنا حتى بعثت من القرن الذى كنت فيه.

অর্থ : “আমি হযরত আদম আলাইহিস সালাম উনার সন্তানগণ উনাদের মধ্যে সর্বোত্তম সম্প্রদায়ের মধ্যেই সর্বদা প্রেরিত হয়েছি। এমনকি আমি যে (কুরাইশ) সম্প্রদায়ের মধ্যে ছিলাম সেটিই ছিলো সর্বোত্তম সম্প্রদায়।” সুবহানাল্লাহ! (বুখারী শরীফ, তাফসীরে মাযহারী শরীফ ৪র্থ খ- ৩০৮ পৃষ্ঠা)

এ পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার ব্যাখ্যায় কিতাবে বর্ণিত হয়েছে-

فلا يـمكن ان يكون كافرا فى سلسلة ابائه صلى الله عليه وسلم.

অর্থ : “নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পিতা (পূর্ব পুরুষ) উনাদের সিলসিলার মধ্যে কেউই কাফির হওয়া সম্ভব নয়।” (তাফসীরে মাযহারী শরীফ ৪র্থ খণ্ড ৩০৮ পৃষ্ঠা)

এ সম্পর্কে কিতাবে আরো বর্ণিত রয়েছে-

ان احدا من اجداده ما كان من الـمشركين.

অর্থ : “নিশ্চয়ই নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বাপ-দাদাগণ কেউই মুশরিক ছিলেননা।” (তাফসীরে কবীর শরীফ- ১৩ খণ্ড ৩৯ পৃষ্ঠা)

উল্লেখ্য, অনেকে “পবিত্র সূরা মারইয়াম শরীফ” উনার ৪৭নং পবিত্র আয়াত শরীফ ও পবিত্র সূরা তওবা শরীফ উনার ১১৪নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনাদের বরাত দিয়ে বলে যে, “হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তিনি উনার পিতার জন্য ইস্তিগফার করেছেন। কাজেই উনার পিতা ঈমানদার ছিলেননা।” নাউযুবিল্লাহ!

মূলতঃ যারা একথা বলবে তারা উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফদ্বয় উনাদের অর্থই বুঝেনি। কারণ “পবিত্র সূরা মারইয়াম শরীফ” উনার ৪৭নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

قال سلم عليك ساستغفر لك ربى.

অর্থ : “হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তিনি বলেন, আপনার প্রতি (বিদায়কালীন) সালাম, অচিরেই আমি আমার প্রতিপালক উনার নিকট আপনার জন্য মাগফিরাত কামনা করবো।” এবং “পবিত্র সূরা তওবা শরীফ উনার” ১১৪নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

ما كان استغفار ابرهيم لابيه الا عن موعدة وعدها اياه.

অর্থ : “হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম উনার তরফ থেকে স্বীয় চাচার মাগফিরাত কামনা করা ছিলো কেবলমাত্র তার সাথে ওয়াদা করার কারণে।”  অর্থাৎ প্রথমত হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম উনার চাচার সাথে ওয়াদা করেছিলেন যে, তিনি তার জন্য ইস্তিগফার করবেন যেন উনার চাচা তওবা করে, শিরক ছেড়ে ঈমান গ্রহণ করে মুসলমান হয়ে যায় সেজন্য দোয়া করবেন।

আর তাই “পবিত্র সূরা তওবা শরীফ” উনার ১১৪নং আয়াত শরীফ উনার মধ্যে সেই ওয়াদা পালনার্থে এবং মুশরিকদের জন্য দোয়া করা নিষেধ হওয়ার পূর্বে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তিনি উনার চাচার জন্য দোয়া করেছিলেন।

যেমন, উক্ত আয়াত শরীফ উনার তাফসীর শরীফ এ এসেছে-

ان ذلك كان قبل النهى عن الاستغفار للمشرك وقد قال رسول الله صلى الله عليه وسلم لعمه ابى طالب والله لاستغفرن لك.

অর্থ : “নিশ্চয়ই হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম উনার ইস্তিগফার কামনা করাটা ছিল মুশরিকদের জন্য দোয়া করা নিষেধ হওয়ার পূর্বের। যেমন নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (নিষেধ হওয়ার পূর্বে) উনার চাচা আবূ তালিব উনাকে বলেছিলেন, মহান আল্লাহ পাক উনার কসম! অবশ্যই আমি আপনার তওবা নছীব হওয়ার জন্য দোয়া করবো।” (তাফসীরে মাযহারী শরীফ ৬/১০০)

এছাড়া হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম উনার চাচা আযরের জন্য এবং নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার চাচা আবূ তালিবের জন্য সরাসরি দোয়া করেননি; বরং তাদের ইস্তিগফার কামনা করেছেন। অর্থাৎ আযর ও আবু তালিব তাদের যেন তওবা নছীব হয়, তারা যেন ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়, ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হয় সেজন্য দোয়া করেছেন। আর তাও ছিল মুশরিকদের জন্য দোয়া নিষেধ সংক্রান্ত বিধান (আয়াত শরীফ) নাযিল হওয়ার পূর্বে।

আর চাচা হিসেবে আযর হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম উনার এবং আবূ তালিব নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার অনেক খিদমত করেছে। তার বিনিময় স্বরূপ হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এবং নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনারা তাদের ইস্তিগফার (তওবা কবুল হওয়ার দোয়া) কামনা করেছেন।

এ সম্পর্কে তাফসীরে উল্লেখ রয়েছে-

وما كان استغفار ابراهيم لابيه يعنى ازر وكان عما لابراهيم عليه السلام وكان ابراهيم بن تارخ.

অর্থ : “হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম উনার পিতার জন্যে ইস্তিগফার করেন অর্থাৎ আযরের জন্যে ইস্তিগফার করেন। আযর ছিল হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম উনার  চাচা। আর হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তিনি ছিলেন হযরত তারাখ আলাইহিস সালাম উনার ছেলে।” (তাফসীর মাযহারী শরীফ ৪ খণ্ড ৩০৮ পৃষ্ঠা)

এ কথা বিশেষভাবে  স্মরণীয় ও প্রণিধানযোগ্য যে, সকল হযরত ইমাম-মুজতাহিদ রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণ উনারা এ বিষয়ে ইজমা বা ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিয়্যীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র শরীর মুবারকে বা পা মুবারকে রওযা শরীফ উনার যে মাটি মুবারক এবং যমীনের যে মাটি মুবারক স্পর্শ করেছে তা আরশে মুআল্লা উনার চাইতে লক্ষ-কোটি গুণ বেশি মর্যাদাবান। সুবহানাল্লাহ!

তাহলে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র অজুদ নূর মুবারক তা যাঁদের মাধ্যম হয়ে পরযায়ক্রমে স্থানান্তরিত হয়ে তিনি যমীনে আগমন করেছেন সেই সকল ব্যক্তিগণ উনাদের মর্যাদা কত বেমেছাল হবে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।

বস্তুত সাইয়্যিদুনা হযরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার মহান শানে এরূপ কুফরীমূলক উক্তি করার অর্থ হলো খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মুবারক শানে চরম ধৃষ্ঠতা প্রদর্শণ করা। যা কাট্টা কুফরীর অন্তর্ভুক্ত।

আরো উল্লেখ্য, যেই পবিত্র নসব-নসল সূত্রে হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনারা দুনিয়ার যমীনে তাশরীফ আনেন উনাদের পূর্ব-পুরুষ উনাদের নসব-নসলনামায় ‘কেউ কেউ ঈমানদার ছিলেননা’ এরূপ কল্পনা বা ধারণা করাও কাট্টা কুফরী।

উপরোক্ত দলীলভিত্তিক সংক্ষিপ্ত আলোচনায় সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল যে, মহান আল্লাহ পাক উনার নবী ও রসূল হযরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার পিতা ছিলেন হাক্বীক্বী পরহেযগার, মুত্তাক্বী, পরিপূর্ণ ঈমানদার ও মুসলমান। উনার নাম মুবারক ছিল হযরত তারাখ মতান্তরে তারিহ বা তারাহ আলাইহিস সালাম। আর আযর নামক ব্যক্তি ছিল উনার চাচা। আরো প্রমাণিত হলো যে, পূর্ববর্তী সকল হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের পূর্বপুরুষগণ এবং সর্বোপরি সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিয়্যীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পূর্বপুরুষগণ হযরত আদম ছফীউল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার থেকে শুরু করে হযরত আব্দুল্লাহ যবীহুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার পর্যন্ত সকলেই ছিলেন পূত-পবিত্র চরিত্র মুবারক উনার অধিকারী, পূর্ণ ধার্মিক ও পরিপূর্ণ মুসলমান।

অতএব, যে ব্যক্তি খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক উনার নবী ও রসূল হযরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার সম্মানিত পিতা ও পরিবার সম্পর্কে উক্তরূপ কুফরীমূলক আক্বীদা রাখবে ও বক্তব্য-লিখনী প্রকাশ করবে ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী তার উপরে মুরতাদের হুকুম বর্তাবে। অর্থাৎ সে ইসলাম বা মুসলমান থেকে খারিজ হয়ে যাবে। ইসলামী খিলাফত থাকলে তাকে তিনদিন সময় দেয়া হতো তওবা করার জন্য। তিনদিনের মধ্যে তওবা না করলে তার শাস্তি হতো মৃত্যুদ-। সে মারা গেলে তার জানাযা পড়া জায়িয হবে না। তাকে মুসলমানদের কবরস্থানে দাফন করা যাবে না; বরং তাকে মৃত কুকুর-শৃগালের মত মাটিতে পুঁতে রাখতে হবে। তার জীবনের সমস্ত নেক আমল বাতিল হয়ে যাবে। বিয়ে করে থাকলে তার স্ত্রী তালাক হয়ে যাবে এবং সে হজ্জ করে থাকলে তা বাতিল হয়ে যাবে। সে ওয়ারিছসত্ব থেকেও বঞ্চিত হবে।

{দলীলসমূহ : (১) তাফসীরে মাযহারী, (২) ইবনে কাছীর, (৩) ইবনে আবী হাতিম, (৪) কবীর, (৫) আহকামুল কুরআন, (৬) আহমদী, (৭) তাফসীরে বাইযাবী, (৮) বয়ানুল হক্ব, (৯) মাআলিমুত তানযীল, (১০) তাফসীরে জালালাইন, (১১) বুখারী, (১২) মুসলিম, (১৩) তিরমিযী, (১৪) বাইহাক্বী, (১৫) মিশকাত, (১৬) মুস্তাদরাকে হাকিম, (১৭) তবারানী, (১৮) কামূস, (১৯) ফতহুল বারী,(২০) উমদাতুল ক্বারী, (২১) মিরকাত, (২২) আশয়াতুল লুময়াত, (২৩) লুময়াত, (২৪) তা’লীকুছ ছবীহ, (২৫) শরহুত ত্বীবী, (২৬) মুযাহিরে হক্ব, (২৭) ফতহুল মুলহিম, (২৮) শরহে নববী, (২৯) আহমদ, (৩০) ইবনে আসাকির, (৩১) ইবনে মারদুবিয়া, (৩২) তাক্বদীসু আবায়িন নাবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, (৩৩) দুররুল মুখতার, (৩৪) ফিকহুল আকবর, (৩৫) শরহুশ শিফা, (৩৬) শুমুলুল ইসলাম লি উছূলির রসূলিল কিরাম, (৩৭) আকাইদে নিজামিয়া, (৩৮)  কাছাছূল আম্বিয়া, (৩৯) কাছাছূল কুরআন, (৪০) কুরআন কাহিনী, (৪১) কিতাবুদ্ দারাযিল, (৪২) মাওয়াহিবে লাদুন্নিয়া, (৪৩) শাওয়াহিদুন্ নুবুওওয়াহ, (৪৪) কিছাছে আম্বিয়া, (৪৫) মাতালিউন নূর, (৪৬) আল মুসতালিদ, (৪৭) বারাহিনে ক্বাতিয়া ইত্যাদি।}

 

মুহম্মদ আলী আজম

ঝাউতলা, খুলশী, চট্টগ্রাম

মুহম্মদ রফীকুল ইসলাম

শিবগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ

সুওয়াল: আমাদের এলাকার এক মাওলানা ছাহিব বলেন যে, ‘ছাহিবু কুন ফাইয়াকূন’ অর্থ ‘কুন ফাইয়াকূন’  উনার মালিক; যা মহান আল্লাহ পাক উনার জন্যেই খাছ। কোন মানুষ ‘কুন ফাইয়াকূন’ উনার মালিক বা অধিকারী হতে পারে না। তাই অন্যদের ক্ষেত্রে এ লক্বব বা উপাধি ব্যবহার করাটা শিরিকের অন্তর্ভুক্ত।

আমার জানার বিষয় হলো, উক্ত মাওলানার বক্তব্য সঠিক কি না? দলীলসহকারে জাওয়াব দিয়ে বাধিত করবেন।

জাওয়াব: ক্বিল্লতে ইলিম ও ক্বিল্লতে ফাহাম অর্থাৎ কম জ্ঞান ও কম বুঝের কারণই হচ্ছে ফিতনা সৃষ্টির মূল কারণ। ফার্সী ভাষায় একটি প্রবাদ রয়েছে-

نیم حکیم خطر جان + نیم ملا خطر ایمان

অর্থ: আধা বা অনভিজ্ঞ কবিরাজ, ডাক্তার জীবনের জন্য হুমকি স্বরূপ। তদ্রুপ আধা বা অনভিজ্ঞ মোল্লা-মৌলবী, মাওলানা ঈমানের জন্য হুমকি স্বরূপ।

এ শ্রেণীর একজন মাওলানাই হচ্ছে সুওয়ালে উল্লেখিত মাওলানা ছাহিব। এসকল মাওলানাদের না আছে পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, পবিত্র ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদের সঠিক ও পরিপূর্ণ ইলিম, না আছে ইলিম অনুযায়ী আমল, না আছে সম্মানিত সুন্নত উনার ইত্তিবা বা অনুসরণ, না আছে তাক্বওয়া বা খোদাভীতি, এছাড়া এদের দিল বা অন্তরও পরিশুদ্ধ নয়, এমনকি এদের আক্বীদার মধ্যেও রয়েছে গলদ বা ত্রুটি। যার কারণে এরা ইলিম ছাড়া, তাহক্বীক্ব ছাড়া, দলীল-প্রমাণ ছাড়া, মনগড়াভাবে কথা বলে থাকে এবং ফতওয়া দিয়ে থাকে। নাউযুবিল্লাহ!

কাজেই, এসব মাওলানা, মুফতী নামধারী ব্যক্তির কোন কথা বা ফতওয়া শরীয়ত সম্মত নয়। বরং শরীয়ত সম্মত যে জাওয়াব তাহলো, হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম এবং হযরত আওলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনারা মহান আল্লাহ পাক উনার কুদরত মুবারক প্রকাশের বিশেষ স্থল। উনাদের মু’জিযা শরীফ এবং কারামত শরীফ মহান আল্লাহ পাক উনার কুদরত মুবারক উনারই একটি অংশ।

উল্লেখ্য, কারামত শরীফ হচ্ছে হযরত আওলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনাদের সম্মান বা মর্যাদা। উনাদের সম্মান-মর্যাদার বহি:প্রকাশ হচ্ছে উনাদের লক্বব বা উপাধি মুবারকসমূহ। যিনি যত বেশি মর্যাদা-মর্তবার অধিকারী; উনার লক্বব বা উপাধি মুবারকও তত বেশি। সুবহানাল্লাহ!

খলীফাতুল্লাহ, খলীফাতু রসূলিল্লাহ, ইমামুশ শরীয়াহ ওয়াত তরীক্বাহ, ইমামুল আইম্মাহ, মুহইস সুন্নাহ, কুতুবুল আলম, মুজাদ্দিদ আ’যম, সুলত্বানুল আওলিয়া, ছাহিবু সুলত্বানিন নাছীর, আওলাদুর রসূল ইমাম রাজারবাগ শরীফ উনার হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা আলাইহিস সালাম উনার অসংখ্য অগণিত লক্বব বা উপাধি মুবারকসমূহের মধ্যে একখানা লক্বব মুবারক হচ্ছে ‘ছাহিবু কুন ফাইয়াকূন’। এ লক্বব মুবারক কেবল উনারই রয়েছে তা নয়। এ লক্বব মুবারক উনার অধিকারী অতীতেও অনেকেই ছিলেন। কিন্তু নীম মোল্লা শ্রেণীর মাওলানারাই সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ বেখবর। তাই তাদের জিহালতী বা অজ্ঞতা প্রকাশ করাটাই স্বাভাবিক।

মূলত: ‘ছাহিবু কুন ফাইয়াকূন’ صاحب (ছাহিব) অর্থ সঙ্গী, বন্ধু, মালিক, কর্তা, ওয়ালা ইত্যাদি। আর كن (কুন) অর্থ হও এবং فيكون অর্থ অতঃপর হয়ে যায়। যেমন পবিত্র সূরা ইয়াসীন শরীফ উনার ৮২নং আয়াত শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

اذا اراد شيئا ان يقول له كن فيكون

অর্থ: মহান আল্লাহ পাক তিনি যখন কোন কিছু সৃষ্টি করতে ইচ্ছা মুবারক করেন তখন সেটাকে বলেন كن হও فيكون অতঃপর সেটা হয়ে যায়। সুবহানাল্লাহ!

এ আয়াত শরীফ উনার দ্বারা মহান আল্লাহ পাক উনার কুদরত মুবারক বা ক্ষমতা বুঝানো হয়েছে। একইভাবে সমস্ত মাখলূক্বাত যে উনার কত অনুগত সে বিষয়টি ফুটে উঠেছে। (তাফসীরে বায়যাবী, কুরতুবী, তাবারী, লুবাব, মাযহারী)

পারিভাষিক অর্থে ‘ছাহিবু কুন ফাইয়াকূন’ লক্বব মুবারক দ্বারা ঐ সকল হযরত আওলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনাদেরকে খিতাব বা সম্বোধন  করা হয়, যাঁরা মহান আল্লাহ পাক উনার এবং উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের চরম-পরম নৈকট্যপ্রাপ্ত। যাঁদের দ্বারা মহান আল্লাহ পাক উনার كن فيكون (কুন ফাইয়াকূন) ছিফত বা গুণ মুবারক উনার বিকাশ ঘটে। উনারা যা চান মহান আল্লাহ পাক তিনি উনাদেরকে সেটাই দান করেন।

যেমন এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছে কুদসী শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

عن حضرت ابى هريرة رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم ان الله تعالى قال لايزال العبد يتقرب الى بالنوافل حتى احبه فاذا احببته كنت سـمعه الذى يسمع به كنت بصره الذى يبصربه كنت لسانه الذى ينطق به كنت يده التى يبطش بها كنت رجله التى يـمشى بها وان سألنى لاعطيته ولان استعاذ بى لاعيذنه.

অর্থ: “হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তা‘য়ালা আনহু তিনি বর্ণনা করেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন, বান্দা নফল ইবাদত করতে করতে আমার এত নৈকট্য লাভ করেন যে, আমি উনাকে মুহব্বত করি। আর আমি যখন উনাকে মুহব্বত করি, তখন আমি উনার কান হই, তিনি আমার কুদরতী কান মুবারক-এ শ্রবণ করেন। আমি উনার চক্ষু হই, তিনি আমার কুদরতী চোখ মুবারক-এ দেখেন। আমি উনার যবান হই, তিনি আমার কুদরতী যবান মুবারক-এ কথা বলেন। আমি উনার হাত হই, তিনি আমার কুদরতী হাত মুবারক-এ ধরেন। আমি উনার পা হই, তিনি আমার কুদরতী পা মুবারক-এ চলেন। যদি তিনি আমার কাছে কিছু চান, আমি উনাকে তা সাথে সাথে দিয়ে দেই। আর যদি তিনি আমার কাছে কোনো সাহায্য তলব করেন, আমি উনাকে তা পুরা করে দেই।” (বুখারী শরীফ, ফতহুল বারী, উমদাতুল ক্বারী)

এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফ ও সীরাতগ্রন্থসমূহে বর্ণিত রয়েছে, একদিন একজন মহিলা ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খিদমতে আরজ করলেন, ইয়া রসূল্লাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমার স্বামী জিহাদে গেছেন। আর গত রাতে একটা স্বপ্ন দেখে অস্থির লাগছে। কোন ইত্মিনান পাচ্ছি না।

আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, “আপনার সেই স্বপ্নটা কি?  মহিলা ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা তিনি বললেন, স্বপ্নে দেখলাম, একটা মৌমাছি কোথা থেকে যেন উড়ে এসে আমার ঘরে প্রবেশ করলো।” আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি মহিলা ছাহাবী উনাকে কিছু নছীহত মুবারক করলেন, অতঃপর বললেন, আপনার সেই স্বপ্নের তা’বীর (ব্যাখ্যা) হচ্ছে, আপনার স্বামী জিহাদে শহীদ হয়েছেন।

মহিলা ছাহাবী উক্ত তা’বীর শুনে নানা চিন্তা ফিকির করতে করতে বাড়ীতে ফিরছিলেন। পথিমধ্যে হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম উনার সাথে দেখা হলো। তিনি উনার এলো-মেলো চুল, উসকু-খুসকু চেহারা দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, “হে মহিলা ছাহাবী! আপনার কি হয়েছে?” তিনি উনার সেই স্বপ্নের কথা বললেন। কিন্তু নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যে তা’বীর করেছেন তা বললেন না। হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম তিনি বললেন, “আপনি উত্তম স্বপ্ন দেখেছেন। চিন্তা করবেন না। আজ রাতেই আপনার স্বামী বাড়ীতে ফিরে আসবেন।”

এ তা’বীর শুনে মহিলা ছাহাবী তিনি আশ্চর্য হলেন। কিছু না বলে বাড়ীতে চলে গেলেন। দেখা গেল, সেই রাতেই উনার স্বামী বাড়ীতে ফিরে আসলেন। পরের দিন সকালে তিনি উনার স্বামীকে সাথে নিয়ে আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মুবারক খিদমতে হাজির হলেন।

আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উনাকে দেখে বললেন, “হে মহিলা ছাহাবী! আপনি কি আপনার স্বামী উনার ফিরে আসার সংবাদ নিয়ে এসেছেন?” গতকাল আমার এখান থেকে ফিরে যাওয়ার সময় রাস্তায় কারো সাথে দেখা হয়েছিল কি? মহিলা ছাহাবী বললেন, হ্যাঁ, হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম উনার সাথে দেখা হয়েছিল। আপনি উনাকে স্বপ্নের কথা বলেছিলেন? জি, তিনি কি তা’বীর করেছেন? তিনি বলেছেন, আপনি কোন চিন্তা করবেন না, আপনার স্বামী আজ রাতেই বাড়ী ফিরে আসবেন। নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, হে মহিলা ছাহাবী! আমি আপনার স্বপ্নের যে তা’বীর করেছিলাম সেটাই সঠিক ছিল অর্থাৎ আপনার স্বামী শহীদ হয়েছিলেন। কিন্তু হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম তিনি আপনার অবস্থা দেখে দয়াদ্র হয়েছিলেন এবং আপনার স্বামী ফিরে আসার সংবাদ দিয়ে আপনাকে আশ্বস্ত করেছিলেন। মহান আল্লাহ পাক তিনি হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম উনাকে আদেশ দিলেন যে, সেই ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে জীবিত করে উনার বাড়ীতে পৌঁছিয়ে দিন। হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম তিনি যা বলেছেন তাই হবে। কারণ আমি যাঁকে ‘ছিদ্দীক্ব’ লক্বব মুবারক হাদিয়া করেছি উনার কথা তো ভুল হতে পারে না। তখন হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম তিনি তাই করলেন। সুবহানাল্লাহ!

মূলত: ছিদ্দীক্ব স্তরের ওলীআল্লাহগণ উনারা যা বলেন তা বাস্তবায়িত হওয়ার বিষয়টি উনাদের কারামত শরীফ উনার অন্তর্ভুক্ত।

‘ফাওয়ায়িদুল ফুয়াদ’ কিতাবে উল্লেখ রয়েছে, ‘কারামত’ শব্দের সাধারণ অর্থ হচ্ছে মাহাত্ম্য, অসাধারণ শক্তি। কিন্তু তাছাউফের পরিভাষায় রূহানীশক্তি, যা রূহানী জজবায় বা মুহব্বতে মশগুল বীর সালিকের প্রাপ্ত পুরস্কার। যাকে মা’রিফাতের পরিভাষায়

قوة الكن

(কুওওয়াতুল কুন) বলা হয়। অর্থাৎ কুন শক্তির অধিকার পাওয়া। মূলতঃ এ কুন শক্তি মহান আল্লাহ পাক উনার নিজস্ব ব্যাপার। যাদ্বারা তিনি সমস্ত সৃষ্টি জগত ও তন্মধ্যস্থিত সবকিছুকে সৃষ্টি করেছেন। আসলে এটা ইচ্ছা ও আদেশের বহিঃপ্রকাশ।

সালিক বা মুরীদ যখন ফানাফিল্লাহ উনার মাক্বামে অর্থাৎ রূহানী জগতে মজজুবী স্বভাব হতে শান্ত হয়ে বাকাবিল্লাহ উনার মাক্বামে স্থানান্তরিত হন তখন উনাকে বিলায়েত (আধ্যাত্মিক রাজত্বের শাসনভার) দান করা হয়। আর রাজত্ব পরিচালনার জন্য উনাকে দেয়া হয় কুওওয়াতুল কুন শক্তি। ‘কুন’ শব্দের অর্থ হও। এ শক্তি দ্বারা কোন বিষয়, বস্তু ও প্রাণীকে আদেশ করা মাত্র তা কার্যকর হয়।

গাউছুল আ’যম, সাইয়্যিদুল আওলিয়া হযরত বড়পীর ছাহিব রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি দীর্ঘ বারো বছর পূর্বে বরযাত্রীসহ যে ডুবে যাওয়া নৌকাটি  উদ্ধার করেছিলেন তা কিংবদন্তির মত সবার মুখে মুখে। তিনিও ছিলেন

قوة الكن

তথা কুন শক্তির অধিকারী অর্থাৎ ছাহিবু কুন ফাইয়াকূন মাক্বামপ্রাপ্ত ওলীআল্লাহ।

একদিন এক খ্রিস্টান ব্যক্তি বললো, হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম উনার মর্যাদা সবার ঊর্ধ্বে। তিনি মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করতে পারতেন। গাউছুল আ’যম, সাইয়্যিদুল আওলিয়া হযরত বড়পীর ছাহিব রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বললেন, হে ব্যক্তি  আমাদের যিনি রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি তো মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করতে পারতেনই। এমনকি উনার উম্মতগণও তা পারেন। মনে রেখো, হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম তিনি কিন্তু قم باذن الله (মহান আল্লাহ পাক উনার আদেশ মুবারকে জিবীত হও) বলে জীবিত করতেন।

আর আমি قم باذنى (আমার আদেশে জীবিত হও) বললেও জীবিত হয়। যদি প্রমাণ দেখতে চাও তাহলে বল। তখন উক্ত খ্রিস্টান ব্যক্তি একটি কবরের প্রতি নির্দেশ করে বললো “এ কবরে শায়িত ব্যক্তিকে জীবিত করুন।”  তখন গাউছুল আ’যম, সাইয়্যিদুল আওলিয়া হযরত বড়পীর ছাহিব  রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি সেই কবরের দিকে লক্ষ্য করে বললেন

قم باذنى

 (আমার আদেশে জীবিত হও)। আর সাথে সাথে জীবিত হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। সুবহানাল্লাহ! (ফতহুল গাইব, রওজাতুল কাইয়ুমিয়াহ)

সুলত্বানুল হিন্দ, কুতুবুল মাশায়িখ হযরত খাজা গরীবে নেওয়াজ রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনিও ছিলেন ‘ছাহিবু কুন ফাইয়াকূন’ মাক্বামপ্রাপ্ত ওলীআল্লাহ। এ বিষয়ে উনার সর্বজন বিদিত একটা কারামত উল্লেখ করা যায়। তিনি আনা সাগরের সম্পূর্ণ পানি একটা ছোট পাত্রের মধ্যে নিয়ে এসেছিলেন। সুবহানাল্লাহ!

আরো উল্লেখ্য, বাদশাহ জাহাঙ্গীরের উজিরে আ’যম ছিল আসফ খাঁ। সে ছিল শিয়া। সে সব সময় বাদশাহকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করতো।

অপর দিকে বাদশাহর দরবারে একজন মুফতী ছিলেন। উনার নাম হযরত আব্দুর রহমান রহমতুল্লাহি আলাইহি। তিনি ছিলেন আফদ্বালুল আওলিয়া, ইমামে রব্বানী হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মুরীদ। তিনি বাদশাহকে সবসময় হক্বের উপর ইস্তিক্বামত থাকতে পরামর্শ দিতেন। একবার উজিরে আ’যম আসফ খাঁর নেতৃত্বে শিয়ারা ইউরোপ থেকে চৌদ্দ জন পাদ্রীকে নিয়ে আসলো। বাদশা যাতে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করতে রাজী হয়। পাদ্রীরা এসে বাদশাহর দরবারে বীজ লাগালো, তাতে সাথে সাথে গাছ হয়ে ফল হলো। আগুন ব্যতীত ভাত পাকালো। বাদশাহ সেটা বুঝতে না পেরে তাদের অনুরক্ত হয়ে গেল। খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করবে বলে এক প্রকার সিদ্ধান্ত নিলো। মুফতী হযরত আব্দুর রহমান রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বিষয়টি আফদ্বালুল আওলিয়া, ইমামে রব্বানী হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে অবহিত করলেন। ইমামে রব্বানী হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বললেন, তাদেরকে থাকতে বল, আমি আসতেছি। তিনি বাদশাহর দরবারে এসে পাদ্রীদেরকে বললেন, “তোমরা তোমাদের কথিত কারামত দেখাও দেখি। তারা তাদের কথিত কোন কারামত দেখাতে পারলো না। ভয়ে থর থর করে কাঁপতে লাগলো।  আর কাকুতি-মিনতি করে বার বার ক্ষমা চাইতে লাগলো। তখন তিনি তাদেরকে দু’ভাগ হতে বললেন। তারা দু’ভাগ হলো। তিনি তাদের একভাগকে বললেন-

موتوا باذن الله

(তোমরা মহান আল্লাহ পাক উনার আদেশে মরে যাও) সাথে সাথে তারা মারা গেল। অপর ভাগকে বললেন, দেখতো তারা জীবিত না মৃত। তারা ভালভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বললো, “তারা মৃত”। তিনি বললেন, “তোমরা তাদেরকে জীবিত কর।” তারা জীবিত করতে পারলো না। তাই তারা হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ক্বদম মুবারক ধরে তাদের সঙ্গীদেরকে জীবিত করে দেয়ার জন্য কান্নাকাটি করলো। তখন ইমামে রব্বানী হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি তাদের (মৃতদের) প্রতি লক্ষ্য করে বললেন-

قوموا باذن الله

(তোমরা মহান আল্লাহ পাক উনার আদেশ মুবারক-এ জীবিত হও)। সাথে সাথে তারা জীবিত হলো। এবার অপর ভাগের প্রতি লক্ষ্য করে তিনি বললেন-

موتوا باذن الله

(তোমরা মহান আল্লাহ পাক উনার আদেশে মরে যাও) সাথে সাথে তারাও মারা গেল। জীবিতদেরকে বললেন, তাদেরকে জীবিত কর। তারা তাদেরকে জীবিত করতে পারলো না। তাই তারা হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ক্বদম মুবারক ধরে তাদের সঙ্গীদেরকে জীবিত করে দেয়ার জন্য কান্নাকাটি করলো। তখন তিনি তাদেরকেও জীবিত করলেন। ইহা দেখে বাদশাহ জাহাঙ্গীরসহ সবাই তওবা করলো এবং বাইয়াত গ্রহণ করলো। ইমামে রব্বানী হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, “সেদিন আমার ক্বইয়ূমিয়াতের হাল এমনভাবে গালিব হয়েছিল যে, আমি যদি আসমানকে যমীন এবং যমীনকে আসমান হতে বলতাম তাহলে তাই হতো।” সুবহানাল্লাহ!

প্রসঙ্গতঃ বলতে হয়, খলীফাতুল্লাহ, খলীফাতু রসূলিল্লাহ, ইমামুল আইম্মাহ্, মুহইস্ সুন্নাহ, কুতুবুল আলম, মুজাদ্দিদে আ’যম, আওলাদে রসূল, সাইয়্যিদুনা ইমাম রাজারবাগ শরীফ উনার হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা আলাইহিস সালাম তিনি বেমেছাল ‘কুওওয়াতুল কুন’ শক্তির অধিকারী।

উনার মধ্যে শৈশবকাল থেকে এগুণের বিকাশ ঘটেছিল। তিনি যখন যা বলতেন তাই হতো। তখন অনেকেই উনার ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে ভাবতেন। সম্মান-ইজ্জত করতেন। মুহব্বতে, আবেগে আপ্লুত হতেন। সঙ্গী-সাথীরা অনেক সময় হতভম্ব হয়ে যেতেন। কারণ তিনি যার পক্ষে কথা বলতেন তিনি কামিয়াব হতেন। যার বিপক্ষে বলতেন তার পরাজয় অনিবার্য হয়ে পড়তো। এরূপ হাজার-হাজার ঘটনা রয়েছে। স্বল্প পরিসরে যার বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া সম্ভব নয়। তবে এক/দুটির উল্লেখ না করাটাও আমানতের খিয়ানতে পর্যবসিত হবে। যার কারণে এক/দুটি ঘটনা পাঠকগণের খিদমতে পেশ করা হলো।

ওলীয়ে মাদারজাদ, কুতুবুজ্জামান, মুসতাজাবুদ্ দা’ওয়াত, ছাহিবে কাশ্ফ ওয়া কারামাত, আওলাদে রসূল, আমাদের সম্মানিত দাদা হুযূর ক্বিবলা আলাইহিস সালাম উনার একজন খাদিম ছিলেন। উনার সাথে একদিন আলোচনা হলো। তিনি বললেন, শৈশবকাল থেকে আমরা হযরত মুজাদ্দিদ আ’যম আলাইহিস সালাম উনার মধ্যে এইসব গুণাবলী দেখে আসছি। উনাদের কয়েকটা বাস ছিল। যা গুলিস্থান-মীরপুর  রোডে চলতো। একদিন রাস্তায় বাসে সমস্যা দেখা দিল। আমি মেরামত করতে লাগলাম। প্রয়োজনীয় অনেক যন্ত্রাংশ পাওয়া যাচ্ছিল না। রাত বেড়ে যাওয়ার কারণে দোকান-পাটও বন্ধ হয়ে গেছে। এদিকে অনেক রাত পর্যন্ত আমাকে বাসায় ফিরতে না দেখে উনার সম্মানিত পিতা হযরত মুজাদ্দিদ আ’যম আলাইহিস সালাম উনাকে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি এসে আমাকে মেরামত করতে দেখে বললেন, “কি আগামী কাল সকাল থেকে চালানো যাবে না?” আমি একটু গোস্বার স্বরে বললাম, যাবে। আপনারা মালিকের ছেলে, যা বলবেন সেটা কি আর না হয়। আমি জানতাম দু’ তিন দিনের আগে এটা চলানোর উপযুক্ত হবে না। তিনি বললেন, চিন্তা করবেন না। ইনশাআল্লাহ আগামী কাল সকাল থেকে যথারীতি এটা চালানো যাবে। একথা শুনে আমার গোস্বা আরো বেড়ে গেল। কারণ আমি সবসময় বাসের সাথে আষ্টে-পৃষ্টে জড়িয়ে রয়েছি। অথচ উনার সাথে এর কোন সম্পর্কই নেই। বললাম, হ্যাঁ, আপনারা তো আসমান-জমিন এক করে দিতে পারেন। তিনি কিন্তু  কোন রাগ করলেন না। বরং মধুমাখা স্বরে বললেন, “আপনি কাজ করতে থাকুন। দেখবেন ঠিক হয়ে যাবে।” আর সত্যি অল্প সময়ের মধ্যে সেটা ভাল হয়ে গেল। সুবহানাল্লাহ! এতো অল্প সময়ে বাসটি ভাল হওয়ার কারণে আমি উনার চেহারা মুবারক উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ফিকির করতে লাগলাম, কি ব্যাপার! কি ঘটলো!! ইত্যবসরে তিনি আবারো আমাকে সম্বোধন করে বললেন, “কি ভাবছেন? চলুন। বাড়ী চলুন। রাত অনেক হয়েছে।”

তিনি একদিন এক ছুফীকে বললেন, তোমাদের রিয়াজত-মাশাক্কাত, যিকির-ফিকিরের সময় তো এখনই।  এই বয়সে যদি তা করতে না পার তাহলে আর কখন করবে? এক/দুই ঘণ্টা ঘুমালেই তো যথেষ্ট। সেই ছুফী ছাহিব বললেন- সেই দিন হতে আমার এক থেকে দুই ঘণ্টার বেশি ঘুম হতো না। সুবহানাল্লাহ!

আরেকবার উনার কাছে অন্য একজন ছুফী ভাই আসলেন। তিনি হজ্জে যাবেন সেজন্য দোয়া প্রার্থনা করলেন। তিনি তাকে দোয়া করলেন এবং বললেন, যাও, তুমি আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কাছে যা চাবে তাই পাবে। সেই ছুফী ভাই মদীনা শরীফে গেলেন। রওজা শরীফ উনার নিকটে দাঁড়িয়ে সবিনয়ে জানালেন, ইয়া রসূল্লাল্লাহ ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমার “সুলত্বানুল আযকার” যিকির জারী করে দিন। প্রার্থনা শেষ হতে না হতেই তার “সুলত্বানুল আযকার” যিকির জারী হলো। সারা শরীরে “আল্লাহ” আল্লাহ” যিকির শুরু হলো। তিনি বলেন, “আমি চলে আসলাম অবস্থান স্থলে। সারা রাত কেটে গেল। ঘুম হলোনা।  পরের দিন আবারও রওজা শরীফ উনার নিকটে গিয়ে বললাম, ইয় রাসূলাল্লাহ ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমি সহ্য করতে পারছি না। আমার যিকির বন্ধ করে দিন। আর সাথে সাথে তা বন্ধ হয়ে গেল। সুবহানাল্লাহ! এরূপ অসংখ্য-অগনিত ঘটনা রয়েছে।

মূলতঃ যারা বলে, কোন মানুষ কুন ফাইয়াকূনের মালিক বা অধিকারী হতে পারে না তাদের এ বক্তব্য সম্পূর্ণ ভুল, অশুদ্ধ, অজ্ঞতাসূচক, জিহালতপূর্ণ এবং উদ্দেশ্য প্রণোদিত। সাথে সাথে তা কুফরীও বটে। কারণ মহান আল্লাহ পাক উনার দেখা মুবারক, শুনা মুবারক, জানা মুবারক ইত্যাদি কোনটিই মানুষের মত নয়। সেটা সম্পূর্ণরূপে কুদরত মুবারক উনার অন্তর্ভুক্ত। যারা বলবে মানুষের মত তারা কাফির, মুশাবিহা ফিরক্বা, বাতিল বাহাত্তর দলের একদল। যাদের আক্বীদা হচ্ছে, মহান আল্লাহ পাক উনারও মানুষের মত হাত, পা, কান, চোখ ইত্যাদি রয়েছে। তিনিও মানুষের মত দেখেন, শুনেন, জানেন। নাউযুবিল্লাহ!

প্রকৃতপক্ষে যেখানে মহান আল্লাহ পাক উনার হাত মুবারক, পা মুবারক, চোখ মুবারক ইত্যাদি সম্পর্কে বলা হয়েছে সেখানে উনার কুদরত মুবারক উনাকে বুঝানো হয়েছে। কাজেই “ওলীআল্লাহগণ উনাদের আদেশের মত মহান আল্লাহ পাক উনার আদেশ মুবারক”, মনে করা যাবেনা। বরং “মহান আল্লাহ পাক উনার আদেশ মুবারক উনার অনুসরণে ওলীআল্লাহগণ উনাদের আদেশ” বলা যেতে পারে। কারণ মহান আল্লাহ পাক তিনি কারো মুহতাজ নন। এমনকি তিনি বরকতময় الله (আল্লাহ) লফজ মুবারক উনার মুহতাজও নন। তিনি তা হতেও পবিত্র। (মুকাশাফাতে আইনীয়া, মাকতুবাত শরীফ)

আর ওলীআল্লাহগণ মহান আল্লাহ পাক উনার মুহতাজ। মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মুহতাজ। উনারা মহান আল্লাহ পাক উনার এবং উনার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের গুণে গুণান্বিত।

মহান আল্লাহ পাক উনার গুণে গুণান্বিত হলে যদি মহান আল্লাহ হওয়ার দাবি করা বুঝায় তাহলে সুওয়ালে উল্লেখিত লক্বব মুবারক উনার বিরোধীতাকারীরাসহ সবাই মহান আল্লাহ হওয়ার দাবীকারী। সবাইতো দেখে, শুনে, বুঝে। তাহলে তারাও মহান আল্লাহ পাক হওয়ার দাবী করলো। সুতরাং তারা সকলেই কাফির। কারণ মহান আল্লাহ পাক তিনি তো দেখেন, শুনেন। তাছাড়া “হাকিম” বিচারক, সেও মহান আল্লাহ হওয়ার দাবিদার। কারণ মহান আল্লাহ পাক তিনি হচ্ছেন হাকিম। মানুষ হাকিম হয় কিভাবে? আবার অনেক বৈজ্ঞানিক আছেন যারা অনেক নতুন নতুন জিনিস আবিষ্কার করেন। ওলীআল্লাহ বিদ্বেষীদের ফতওয়া মুতাবিক তারাও মহান আল্লাহ পাক হওয়ার দাবীদার, কাফির। আর যদি তা না হয়, তাহলে ওলীআল্লাহগণ উনাদের ইশারায় বা ওসীলায় আবিষ্কৃত হলে উনারা মহান আল্লাহ পাক হওয়ার দাবীকারী হবেন কেন?

আমরা ইতোমধ্যেই এই লেখায় উল্লেখ করেছি যে, সাইয়্যিদুল আওলিয়া, মাহবূবে সুবহানী, কুতুবে রব্বানী, গাউছুল আ’যম হযরত বড়পীর ছাহিব রহমতুল্লাহি আলাইহি, ইমামুশ শরীয়ত ওয়াত তরীক্বত, মুজাদ্দিদে যামান, সুলত্বানুল হিন্দ হযরত গরীবে নেওয়াজ রহমতুল্লাহি আলাইহি, কাইয়ূমে আউয়াল হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনারাসহ অনেক আওলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনারা ছিলেন ‘‘ছাহিবু কুন ফাইয়াকূন” লক্বব মুবারক উনার অধিকারী। উনারা যদি আল্লাহ হওয়ার দাবীকারী না হন তাহলে পঞ্চদশ শতকের মুজাদ্দিদ, খলীফাতুল্লাহ, খলীফাতু রসূলিল্লাহ, মুজাদ্দিদে আ’যম, সুলত্বানুল আরিফীন, হাকিমুল হাদীছ, আওলাদে রসূল, সাইয়্যিদুনা, ইমাম রাজারবাগ শরীফ উনার হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা আলাইহিস সালাম তিনি মহান আল্লাহ হওয়ার দাবীকারী হবেন কেন? উনার শানে এই তোহমত কেন? মুলতঃ ইহা জাহিলদের জিহালতী আর হিংসুকদের হিংসার প্রতিফলন। জাহিলরা হিংসার বশবর্তী হয়ে উনার শানে এরূপ মিথ্যা তোহমত (অপবাদ) দিয়ে তারা যে আসলেই মালউন ইবলীসের যোগ্য উত্তরসূরি তা প্রমাণ করে থাকে। ইবলিস যেমন হযরত আদম আলাইহিস সালাম উনার শ্রেষ্ঠত্ব দেখে সহ্য করতে পারেনি। হিংসার আগুনে জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়েছিল। তারাও মুজাদ্দিদে আ’যম, আওলাদে রসূল, সাইয়্যিদুনা ইমাম রাজারবাগ শরীফ উনার মামদূহ হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা আলাইহিস সালাম উনার শ্রেষ্ঠত্ব, মর্যাদা- মর্তবা দেখে হিংসার আগুনে জ্বলে-পুড়ে ছারখার হচ্ছে। উনার প্রতি তারা হিংসা ও বিদ্বেষ পোষণ করতে গিয়ে মহান আল্লাহ পাক উনার আদেশ লংঘন করছে। ফলে তারা কুফরীতে নিমজ্জিত হচ্ছে। মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন-

ولا تتمنوا ما فضل الله به بعضكم على بعض

অর্থ : মহান আল্লাহ পাক তিনি তোমাদের একজনের উপর অন্যজনকে যে ফযীলত দিয়েছেন তোমরা (হিংসার বসবর্তী হয়ে) তার আকাঙ্খী হয়ো না। (পবিত্র সূরা নিসা শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ৩২)

কাজেই যারা বলে এবং বিশ্বাস করে যে, “ছাহিবু কুন ফাইয়াকূন” লক্ববধারী নিজে মহান আল্লাহ হওয়ার দাবীকারী, তারা প্রকারান্তরে মহান আল্লাহ পাক উনার এবং সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের আদেশের বিরোধিতাকারী। কারণ মহান আল্লাহ পাক তিনি স্বয়ং নিজেই স্বীয় গুণে গুণাম্বিত হওয়ার জন্য আদেশ মুবারক করেছেন। মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন-

صبغة الله ومن احسن من الله صبغة

অর্থ : “তোমরা মহান আল্লাহ পাক উনার রঙে রঞ্জিত হও। মহান আল্লাহ পাক উনার চেয়ে উত্তম রঞ্জনকারী আর কে আছেন? (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ১৩৮)

এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার ব্যাখ্যায় আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

تخلقوا باخلاق الله

অর্থ : “তোমরা মহান আল্লাহ পাক উনার চরিত্রে চরিত্রবান হও।”

অর্থাৎ ওলীআল্লাহগণ উনাদের মাথার তালু থেকে পায়ের তলা পর্যন্ত মহান আল্লাহ পাক উনার গুণে গুণাম্বিত। উনারা যা চান মহান আল্লাহ পাক তিনি সেটাই দেন। উনারা যেটা হতে বলেন, সেটাই হয়। আর তখনই উক্ত ওলীআল্লাহ উনাকে “ছাহিবু কুন ফাইয়াকূন” বলা হয়।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, একবার হযরত বাহলুল দানা রহমতুল্লাহি আলাইহি নামক একজন মজ্জুব ওলীআল্লাহ তিনি উনার পীর ছাহিব ক্বিবলা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে জিজ্ঞাসা করলেন, হুযূর! আপনি কেমন আছেন? উত্তরে তিনি বললেন, খুব ভাল। এরূপ ভাল যে, আমি যা চাই সেটাই হয়। আর আমি যেটা চাই না সেটা হয়না।”

মুরীদ সবিনয়ে আরজ করলেন। হুযূর! বেয়াদবী ক্ষমা চাই। এটা কেমন হাল? আপনি যা চান তাই হয়, আর যা চান না তা হয় না? দয়া করে এর হাক্বীক্বত বর্ণনা করবেন কি?

তখন পীর ছাহিব ক্বিবলা তিনি বললেন, মূলতঃ আমি আমার মতকে মহান আল্লাহ পাক উনার মতের সাথে মিলিয়ে দিয়েছি অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক তিনি যা চান আমি সেটাই চাই। আর সেটাই হয়। আর মহান আল্লাহ পাক তিনি যেটা চাননা, আমিও সেটা চাইনা। কাজেই সেটা হয় না।

অতএব, উপরে উল্লেখিত আলোচনা থেকে প্রতিভাত হলো যে, ‘ছাহিবু কুন ফাইয়াকূন’ লক্বব বা উপাধি মুবারক ব্যবহার করাটা আদৌ শিরিকের অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং শিরিক বলাটাই কুফরী এবং কাফির ও জাহান্নামী হওয়ার কারণ।

 

মুহম্মদ রুহুল আমীন

উত্তর শাহজাহানপুর, ঢাকা

 

সুওয়াল : ঢাকা শহরের এক মসজিদের জনৈক খতীব বিভিন্ন সময় জুমুয়ার বয়ানে এমন কিছু বক্তব্য প্রদান করেন, যে বক্তব্যগুলি মুছল্লীদের দৃষ্টিতে ভুল এবং আপত্তিকর বলে মনে হয়েছে। বক্তব্যগুলি আসলেই ভুল ও আপত্তিকর হয়ে থাকলে উক্ত খতীবের পিছনে নামায পড়া ঠিক হবে কি-না? পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ উনাদের আলোকে জাওয়াব দানে বাধিত করবেন।

পূর্ব প্রকাশিতের পর

১০নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব

সুওয়াল: তিনি বিভিন্ন সময় নবী ও রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের শানে মায়ের পেট বা মায়ের পেটে ছিলেন, এরকম বক্তব্য দিয়েছেন। কথাটা আদবের খিলাফ কিনা? জাওয়াব: হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনারা ইজ্জত, সম্মান, মর্যাদার অধিকারী। খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক উনার পরেই উনাদের মর্যাদা বা সম্মান। উনারা মহান আল্লাহ পাক উনাদের তরফ থেকে মনোনীত এবং উনারা পবিত্র এবং নিষ্পাপ। উনাদেরকে যথাযথ সম্মান করার জন্য নির্দেশ করা হয়েছে। যেমন সূরা ফাতহ শরীফ ৯নং আয়াত শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

تعزروه وتوقروه وتسبحوه بكرة واصيلا

অর্থ: হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খিদমত মুবারক করো, সম্মান মুবারক করো এবং উনার ছানা-ছিফত মুবারক বা প্রশংসা মুবারক বর্ণনা করো সকাল-সন্ধ্যা অর্থাৎ সদাসর্বদা।

এ আয়াত শরীফ উনার ব্যাখ্যায় আল্লামা কাজী আয়ায রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সুপ্রসিদ্ধ ‘কিতাবুশ শিফা’ গ্রন্থে বর্ণনা করেন-

اعلم ان حرمة النبى صلى الله عليه وسلم بعد موته وتوقيره وتعظيمه لازم كما كان حال حياته وذالك عند ذكره وذكر حديثه وسنته وسماع اسمه وسيرته.

অর্থ : জেনে রাখ! নিশ্চয়ই নূরে মুজাসসাম হাবীবূুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বিছাল শরীফ অর্থাৎ তিনি পর্দার আড়ালে চলে যাওয়ার পর উনার প্রতি তা’যীম বা সম্মান প্রদর্শন ঐরূপ ওয়াজিব যেরূপ উনার পবিত্র হায়াত মুবারক-এ অর্থাৎ উনার দুনিয়ায় অবস্থানকালীন যেরূপ ওয়াজিব। কাজেই, উনার বরকতময় জীবনী মুবারক আলোচনাকালে, পবিত্র হাদীছ শরীফ বর্ণনাকালে, উনার পবিত্র নাম মুবারক উচ্চারনকালে, উনার পবিত্র আদর্শ ও আখলাক্ব মুবারক বর্ণনাকালে ও শ্রবণকালে সম্মান প্রদর্শন করাও ওয়াজিব।

স্মরণীয় যে, উপরে উল্লেখিত আয়াত শরীফখানা যদিও নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মুবারক শানে বর্ণিত হয়েছে কিন্তু উনার হুকুম অন্য সকল হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের প্রতিও বর্তাবে।

কাজেই, সাধারণ মানুষদের ক্ষেত্রে যেভাবে সম্মান ব্যতিরেকে শব্দ ব্যবহার করা হয় সেভাবে হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের শান মুবারকে ব্যবহার করা অবশ্যই আদবের চরম খিলাফ।

হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে রয়েছে-

انزلوا الناس منازلـهم

অর্থ : মানুষকে উনার মর্যাদা অনুযায়ী সম্মান করো। (মিশকাত শরীফ)

এখানে আমভাবে মানুষের ক্ষেত্রে তাদের মর্যাদা অনুযায়ী সম্মান করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে সেক্ষেত্রে যাদের মর্যাদা ও সম্মান খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক উনার পরেই, উনাদের শানে তাহলে কতটুকু সম্মান রক্ষা করে ভাষা বা শব্দ ব্যবহার করতে হবে তা সত্যিই ফিকিরের বিষয়।

অতএব, উনাদের শান মুবারকে মায়ের পেট বা মায়ের পেটে ছিলেন এভাবে বলাটা অবশ্যই আদবের খিলাফ।

জগৎ বিখ্যাত বুযুর্গ এবং ফার্সী কবি আল্লামা হযরত জালালুদ্দীন রুমী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি উনার মসনবী শরীফ লেখার শুরুতেই এই বলে প্রার্থনা করেছেন যে-

از خدا  جویم توفیق ادب+  بے ادب محروم گشت از لطف رب.

অর্থ : আমি মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট আদব রক্ষার জন্য তাওফীক চাচ্ছি। কেননা বেআদব মহান আল্লাহ পাক উনার রহমত থেকে বঞ্ছিত থাকে।

হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের শানে আদব সহকারে শব্দ বা ভাষা ব্যবহার করা উচিত। যেমন, উনারা উনাদের আম্মা আলাইহাস সালাম উনাদের রেহেম শরীফ-এ ছিলেন বা অবস্থান করেছিলেন ইত্যাদি।

১১নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব

সুওয়াল : কারবালার ময়দানে ইয়াযীদের সন্তান হুর ইবনে ইয়াযীদ হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার পক্ষে জিহাদ করে শাহাদাত বরণ করেছেন। ঘটনাটা কি সত্যি?

জাওয়াব : এ বক্তব্যটিও শুদ্ধ হয়নি। কারবালার ময়দানে হযরত হুর রহমতুল্লাহি আলাইহি নামে যিনি হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার মুবারক খিদমতে এসে উনার পক্ষ হয়ে পাপিষ্ঠ ইয়াযীদ বাহিনীর সাথে জিহাদ করে শহীদ হয়েছিলেন, তিনি পাপিষ্ঠ ইয়াযীদের সন্তান ছিলেন না। বরং উনার পরিচয় হচ্ছে, হযরত হুর ইবনে ইয়াযীদ রিয়াহী রহমতুল্লাহি আলাইহি। অর্থাৎ উনার পিতা হচ্ছেন ইয়াযীদ রিয়াহী। উনি হযরত মুআবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার ছেলে নন।

কাজেই, হযরত হুর রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি পাপিষ্ঠ ইয়াযীদ লা’নাতুল্লাহি আলাইহি-এর সন্তান ছিলেন না।

 

১২নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব

 

সুওয়াল : গত ০১.০৮.২০১২ ঈসায়ী তারিখে একটি টিভি চ্যানেলে এক মহিলার প্রশ্নের উত্তরে বলেছে, শুধু মহিলারা একজন মহিলার ইমামতিতে নামায পড়তে পারবেন। এই ক্ষেত্রে পুরুষ ইমাম যেমন এক সিজদার সামনে দাঁড়ায় মহিলা ইমাম সেইভাবে নয় বরং একই কাতারে মাঝখানে একটু সামনে মহিলা ইমাম দাঁড়াবেন। জাওয়াব : তা’লীম বা শিক্ষার উদ্দেশ্যে মহিলাদের জন্য মহিলা ইমামের পিছনে নামায আদায় করা জায়িয হলেও তা অবশ্যই মাকরূহের অন্তর্ভুক্ত। যেমন এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

عن حضرت على عليه السلام قال لا تؤم النساء.

অর্থ : হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহূ আলাইহিস সালাম তিনি বলেন, মহিলারা ইমামতি করবে না। (মুছান্নাফ ইবনে আবি শায়বা, ফিক্বহুস সুনান ওয়াল আছার)

কাজেই, মহিলাদের জন্য মহিলা ইমামের পিছনে জামায়াত করে নামায পড়া মাকরূহ তাহরীমীর অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং তাদের উচিত জামায়াতে নামায না পড়ে একা নামায আদায় করা।

যেসব খতীব ও ইমাম টিভি চ্যানেলে প্রোগ্রাম করে বা টিভি চ্যানেল দেখে থাকে তারা চরম ফাসিকের অন্তর্ভুক্ত। কারণ তারা সম্মানিত শরীয়ত উনার দ্বারা ঘোষষণাকৃত দুটি প্রকাশ্য হারাম ও কবীরা গুনাহর সাথে জড়িত। প্রথম হচ্ছে ছবি এবং দ্বিতীয় হচ্ছে বেপর্দা। অর্থাৎ যে খতীব বা ইমাম টিভিতে প্রোগ্রাম করে সে কিন্তু টিভিও দেখে থাকে। এতে সে ছবি তুলে থাকে, দেখে থাকে এবং অন্যরাও তার ছবি দেখে থাকে। এরপর নিজের ছবি দেখার সাথে সাথে অন্য পুরুষ ও মহিলা তাদেরও ছবি দেখে থাকে। আর যেসব মহিলার ছবি দেখে থাকে তারা কিন্তু উক্ত খতীব বা ইমামের মাহরাম মহিলার অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং তারা বেগানা মহিলার অন্তর্ভুক্ত।

হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

كل مصور فى النار

অর্থ : প্রত্যেক ছবি তুলনেওয়ালা, তোলানেওয়ালা জাহান্নামে প্রবেশ করবে। (মুসলিম শরীফ)

একইভাবে যে নিজে পর্দা করেনা এবং তার অধিনস্তদের পর্দা করায় না সে দাইয়ূছের অন্তর্ভুক্ত। পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

الديوث لا يدخل الجنة

অর্থ : দাইয়ূছ বেহেশতে প্রবেশ করবে না। অর্থাৎ যে দাইয়ূছ হবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। (নাসায়ী শরীফ)

কাজেই, ইমাম বা খতীব ছাহিবের জন্য যাবতীয় হারাম ও কবীরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা শর্ত। কারণ যে হারাম বা কবীরা গুনাহ করে সে ফাসিক। আর ইমাম বা খতীব ছাহিবের জন্য ফাসিক না হওয়া শর্ত। কেননা ফাসিক খতীব বা ইমামের পিছনে যে নামায আদায় করা হয় সে নামায দোহরায়ে পড়াটা ওয়াজিব। (সমূহ ফিক্বাহর কিতাব)

 

১৩নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব

 

সুওয়াল : অন্যদিন একই টিভি চ্যানেলে বিতিরের নামায প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম উনার নূরানী পাখা ৭০ হাজার উল্লেখ করেছেন। জাওয়াব :  ছহীহ বর্ণনা অনুযায়ী ফেরেশতা হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম উনার পাখা মুবারক ছয়শ থেকে ছয় হাজার বলে বর্ণিত রয়েছে।

যদি সংখ্যাধিক্যের দিকে খেয়াল করে ৭০ হাজার বলে থাকে তাহলে খতীবকে এর দলীল পেশ করতে হবে। কারণ মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেছেন-

هاتوا برهانكم ان كنتم صادقين

অর্থ : যদি তোমরা (আক্বীদা-আমলে, বক্তব্য-লিখনীতে) সত্যবাদী হয়ে থাক, তাহলে দলীল পেশ করো। (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ: আয়াত শরীফ ১১১)

অর্থাৎ দলীল-প্রমাণ ব্যতীত কারো কোন কথা শরীয়তে গ্রহণযোগ্য নয় বা হবে না।

উপরে উল্লেখিত সুওয়ালসমূহের সংক্ষিপ্ত জাওয়াবের দ্বারাই প্রমাণিত হয়েছে যে, উক্ত মসজিদের খতীবের বক্তব্যসমূহের মধ্যে কিছু বক্তব্য বর্ণনা ও ভাষাগত ভুল, কিছু বক্তব্য চরম আপত্তিকর ও বেয়াদবিমূলক এবং কিছু বক্তব্য কুফরীর শামিল।

শরীয়তের ফতওয়া হলো, কোন মুসলমান কুফরী করলে সে মুরতাদ হয়ে যায়। আর কেউ হারাম কাজ বা কবীরা গুনাহ করলে সে ফাসিক হয়ে যায়।

কাজেই, উপরোক্ত বক্তব্য দানকারী খতীবের উপর মুরতাদ ও ফাসিকের হুকুম বর্তিয়েছে। মুরতাদ ও ফাসিক ব্যক্তি খতীব ও ইমাম হওয়ার উপযুক্ত বা যোগ্য নয়। কেননা ইমামতির জন্য আক্বীদা ও আমল বিশুদ্ধ থাকা অপরিহার্য।

অতএব, মসজিদ কমিটির দায়িত্ব হবে উক্ত খতীবকে অতিসত্বর বরখাস্ত করে শুদ্ধ আক্বীদার অধিকারী, নেককার, পরহিযগার খতীব নিয়োগ করা।

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ