সুওয়াল-জাওয়াব বিভাগ

সংখ্যা: ২২১তম সংখ্যা | বিভাগ:

মুহম্মদ নিজামুদ্দীন

কোম্পানীগঞ্জ, সিলেট

সুওয়াল : অখ্যাত এক মাসিক পত্রিকায় এক প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়েছে যে, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ গইব জানে না। যে ব্যক্তি এ ধরণের দাবি করবে সে কুরআন ও হাদীছকে অস্বীকার এবং আল্লাহ পাক উনাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করলো। সে এ দাবির মাধ্যমে মুসলিম মিল্লাতের গণ্ডী থেকে বের হয়ে গেল। আল্লাহ তায়ালা বলেন, আকাশ ও যমীনে আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ গইবের সংবাদ জানে না। সূরা নমল: ৬৫। এমনকি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনিও গইব জানেন না। আল্লাহ তায়ালা তিনি উনার নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে মানুষের জন্য ঘোষণা দিতে বলেন, আপনি বলুন, আমি তোমাদের বলিনা যে, আমার কাছে আল্লাহ পাক উনার ভা-ার আছে। তাছাড়া আমি গইব সম্পর্কেও অবগত নই। সূরা আনআম: ৫০। সুতরাং যে এরূপ দাবি করবে সে মুসলিম থাকে না।

আমার সুওয়াল হলো, উক্ত প্রশ্নের উত্তর সঠিক হয়েছে কিনা? বহুল পঠিত যামানার তাজদীদী মুখপত্র মাসিক আল বাইয়্যিনাত শরীফ উনার মাধ্যমে জানতে ইচ্ছুক।

জাওয়াব: অখ্যাত পত্রিকার উক্ত প্রশ্নের উত্তর আদৌ সঠিক হয়নি। বরং পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের খিলাফ বা বিরোধী হওয়ার কারণে এবং বিশেষ করে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্রতম মর্যাদা বা শান মুবারক উনার বিরোধী হওয়ার কারণে সুস্পষ্ট কুফরী হয়েছে।

উক্ত অখ্যাত পত্রিকার উত্তরে বলা হয়েছে, “একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ গইব জানে না” এ কথা মোটেও সঠিক নয়। কেননা মহান আল্লাহ পাক তিনি গইব জানেন খালিক্ব মালিক রব হিসেবে এবং কারো মধ্যস্থতা ব্যতিরেকে। আর মহান আল্লাহ পাক উনার মনোনীত হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম এবং উনার মনোনীত হযরত আওলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনারা মহান আল্লাহ পাক উনার তরফ থেকে প্রদত্ব ইলিমের মাধ্যমে গইবের সংবাদ রাখেন।

মূলতঃ মহান আল্লাহ পাক তিনি যেহেতু আলিমুল গইবি ওয়াশ্ শাহাদাহ অর্থাৎ দৃশ্য-অদৃশ্য উভয় ইলিমের অধিকারী সেহেতু মহান আল্লাহ পাক উনার তরফ থেকে যাঁরা ইলিম প্রাপ্ত হন উনারাও উভয় প্রকার ইলিমেরই অধিকারী হয়ে থাকেন। সুবহানাল্লাহ!

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার গইবের ইলিম তো অনেক উর্ধ্বের বিষয় বরং যাঁরা কোন নবী আলাইহিমুস সালাম কিংবা কোন রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের অন্তর্ভুক্ত নন; যাঁরা হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের উম্মতের অন্তর্ভুক্ত মহান আল্লাহ পাক উনার ওলী উনাদেরকেও মহান আল্লাহ পাক তিনি ইলমে গইব বা অদৃশ্যের জ্ঞান দান করেন। যেমন এ প্রসঙ্গে হযরত খিযির আলাইহিস সালাম সম্পর্কে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

وعلمنه من لدنا علما

অর্থ: ‘আমি উনাকে ইলমে লাদুন্নী অর্থাৎ আমার তরফ থেকে ইলিম হাদিয়া করেছি।’ (পবিত্র সূরা কাহাফ শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ৬৫)

আহলে সুন্নত  ওয়াল জামায়াত উনাদের মতে, হযরত খিযির আলাইহিস সালাম তিনি একজন ওলীআল্লাহ। উনাকে মহান আল্লাহ পাক ইলমে লাদুন্নী তথা ইলমে গইব ও ইলমে হাদ্বির হাদিয়া করেছেন। এর প্রমাণস্বরূপ হযরত খিযির আলাইহিস সালাম উনার তিন তিনটি গইবের বিষয় পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে এবং সেসব গইবের সংবাদ জলীলুল ক্বদর নবী ও রসূল হযরত মূসা কালীমুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার দ্বারা সত্যায়ন করা হয়েছে। প্রথমত: হযরত খিযির আলাইহিস সালাম যে নৌকাতে চড়ে নদী পার হয়েছিলেন তা তিনি ছিদ্র করে দিলেন। দ্বিতীয়ত: একটি বালককে হত্যা করে ফেললেন। তৃতীয়ত: একটি জনপদের অধিবাসীদের কাছে পৌঁছে তাদেরকে মেহমানদারী করাতে বললেন। তারা মেহমানদারী করতে অস্বীকার করা সত্ত্বেও তিনি তাদের একটি ভগ্ন প্রাচীর ঠিকঠাক করে দিলেন।

এসব ঘটনার কারণসমূহ বর্ণনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন-

এক. নৌকাটি যেদিকে যাচ্ছিলো সেখানে একজন যালিম বাদশাহ এই পথে চলাচলকারী সব নৌকা ছিনিয়ে নিত। এ কারণে তিনি নৌকাটি ছিদ্র করে দেন যাতে যালিম বাদশাহ্র লোকেরা ছিদ্র বা ভাঙ্গা দেখে নৌকাটি ছেড়ে দেয় এবং দরিদ্ররা বিপদের হাত থেকে বেঁচে যায়।

দুই. বালকটির হত্যার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ছেলেটি বড় হয়ে তার সৎকর্মপরায়ণ পিতা-মাতাকে বিব্রত করবে ও কষ্ট দিবে। সে কুফরীতে লিপ্ত হয়ে পিতা-মাতার জন্য ফিৎনা হয়ে দাঁড়াবে এবং তার ভালবাসায় পিতা-মাতার ঈমানও বিপন্ন হয়ে পড়বে। তাই তিনি ছেলেটিকে হত্যা করে ইচ্ছা পোষণ করলেন যে,  মহান আল্লাহ পাক এই সৎকর্মপরায়ণ পিতা-মাতাকে এ ছেলের পরিবর্তে তার চাইতে উত্তম সন্তান দান করবেন, যার কাজকর্ম ও চরিত্র হবে পবিত্র এবং সে পিতা-মাতার হক্বও পূর্ণ করবে।

এক রেওয়ায়েতে বর্ণিত রয়েছে, নিহত ছেলের পিতা-মাতাকে মহান আল্লাহ পাক তার পরিবর্তে একটি কন্যা সন্তান দান করেন। পরবর্তীকালে যার রেহেম শরীফ-এ দুজন নবী আগমন করেন। আরেক রেওয়ায়েতে বর্ণিত রয়েছে, উক্ত কন্যার রেহেম শরীফ থেকে আগমনকারী নবী আলাইহিস সালাম উনার মাধ্যমে মহান আল্লাহ পাক একটি বিরাট উম্মতকে হিদায়েত দান করেন।  অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে, নিহত ছেলের পরিবর্তে মহান আল্লাহ পাক তিনি উক্ত ছেলের মাতার ঘরে সাত জন ছেলে দান করেন যাঁরা প্রত্যেকেই নবী হন। সুবহানাল্লাহ!

তিন. প্রাচীরের নিচে ইয়াতীম বালকদের জন্য রক্ষিত গুপ্তধন স্বর্ণ-রৌপ্যের ভা-ার ছিলো। তা হিফাযতের জন্য তিনি প্রাচীর ঠিক করে দিয়েছিলেন এজন্য যে, উক্ত ইয়াতীম বালকদের পিতা একজন মহান আল্লাহ পাক উনার ওলী ছিলেন। তাই উনার সন্তান-সন্ততির উপকারের লক্ষ্যে এ ব্যবস্থা করেন।

স্মরণীয় যে, মহান আল্লাহ পাক উনার তরফ থেকে হযরত আওলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনাদেরকে ইলমে গইবসহ সর্বপ্রকার ইলিম ও নিয়ামত হাদিয়া করার পদ্ধতির নাম হচ্ছে ‘ইলমে লাদুন্নী, ইলহাম ও ইলক্বা। আর হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকে ইলমে গইবসহ সর্বপ্রকার ইলিম ও নিয়ামত হাদিয়া করার পদ্ধতির নাম হচ্ছে ওহী। বলার অপেক্ষা রাখে না, সকল হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনারা ওহী মুবারক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিলেন। সুবহানাল্লাহ!

আরো উল্লেখ্য, ‘শরহে মাওয়াহিব’ কিতাবে উল্লেখ আছে, ‘লাতায়িফুল মিনান’ কিতাবে উল্লেখ আছে যে, কোন কামিল বান্দা বা হক্কানী ওলীআল্লাহগণ উনারা মহান আল্লাহ পাক উনার পক্ষ থেকে কোন অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান বা ইলমে গইব লাভ করা আশ্চর্যের বিষয় নয়। এটা হাদীছ শরীফ উনার দ্বারা প্রমাণিত। হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বলা হয়েছে-

اتقوا فراسة الـمؤمن فانه ينظر بنور الله

অর্থ: ‘মু’মিনের অর্থাৎ প্রকৃত মু’মিন তথা ওলীআল্লাহ উনার অন্তরদৃষ্টিকে ভয় করো। কেননা তিনি মহান আল্লাহ পাক উনার নূর মুবারক দ্বারা অবলোকন করেন।’  (মিশকাত শরীফ)

হাদীছে কুদসী শরীফ উনার মধ্যে আরো ইরশাদ মুবারক হয়েছে, মহান আল্লাহ পাক উনার মুহব্বত-মা’রিফাত অর্জনকারী ওলীআল্লাহ উনার শান মুবারক সম্পর্কে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন-

كنت سـمعه الذى يسمع به كنت بصره الذى يبصربه كنت لسانه الذى ينطق به كنت يده التى يبطش بها كنت رجله التى يـمشى بـها

অর্থ: আমি উনার কান হই, তিনি আমার কুদরতী কান মুবারক-এ শ্রবণ করেন। আমি উনার চক্ষু হই, তিনি আমার কুদরতী চোখ মুবারক-এ দেখেন। আমি উনার যবান হই, তিনি আমার কুদরতী যবান মুবারক-এ কথা বলেন। আমি উনার হাত হই, তিনি আমার কুদরতী হাত মুবারক-এ ধরেন। আমি উনার পা হই, তিনি আমার কুদরতী পা মুবারক-এ চলেন। (বুখারী শরীফ, ফতহুল বারী শরীফ, উমদাতুল ক্বারী শরীফ)

অর্থাৎ যাঁরা প্রকৃত ওলীআল্লাহ উনারাও মহান আল্লাহ পাক উনার তরফ থেকে নিয়ন্ত্রিত। কাজেই উনাদের সবকিছুই মহান আল্লাহ পাক উনার কুদরত বা ক্ষমতা বলেই সম্পন্ন হয়ে থাকে। তাই উনার গইব সম্পর্কে অবগত হওয়াটা বিস্ময়কর কোন ব্যাপার নয়।

অতএব, হযরত ওলী-আওলিয়ায়ে রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনাদের ক্ষেত্রে যদি ইলমে গইব থাকাটা বাস্তবসম্মত হয় তাহলে হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের ইলমে গইব থাকাটা আরো বেশি বাস্তসম্মত। এ বিষয়ে কেবল কাফিররাই চু-চেরা, ক্বীল-ক্বাল করে থাকে।

অখ্যাত পত্রিকায় বলা হয়েছে, “যে ব্যক্তি এ ধরণের দাবি করবে সে কুরআন ও হাদীছ অস্বীকার এবং আল্লাহ পাক উনাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করলো এবং এ দাবির মাধ্যমে মুসলিম মিল্লাতের গণ্ডি থেকে বের হয়ে গেল” এ বক্তব্য ডাহা মিথ্যা ও মনগড়া। কারণ এরূপ বক্তব্য ইসলামী শরীয়াহ উনার উছূল বা দলীল- পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, পবিত্র ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদের কোথাও উল্লেখ নেই যে, গইবের ইলিমের অধিকারী হলে বা দাবি করলে কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ উনাদেরকে অস্বীকার করা হয় এবং মহান আল্লাহ পাক উনাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা হয় এবং মুসলিম মিল্লাতের গণ্ডি থেকে বের হতে হয়।

এরপর অখ্যাত পত্রিকায় আরো বলা হয়েছে, “এমনকি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহান রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনিও গইব জানেন না।” নাউযুবিল্লাহ! এ বক্তব্যও পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ উনাদের চরম বিরোধী ও কুফরী হয়েছে। কেননা নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি গইব সম্পর্কে জানেন না এরূপ কথা পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, পবিত্র ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদের কোথাও নেই। বরং তিনি গইব সম্পর্কে জানেন এবং জানিয়েছেন এ বর্ণনাই পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, পবিত্র ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদের মধ্যে রয়েছে।

এরপর উক্ত অখ্যাত পত্রিকায় আরো বলা হয়েছে, “সুতরাং যে এরূপ দাবি করবে সে মুসলিম থাকে না।” অর্থাৎ যে গইব সম্পর্কে জানে বলে দাবি করবে সে মুসলিম থাকে না। এ বক্তব্যও পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, পবিত্র ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদের কোথাও নেই। এ বক্তব্যও সম্পূর্ণ মনগড়া, মিথ্যা, দলীলবিহীন ও কুফরীর শামিল। কেননা পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ উনাদের বর্ণনা মুবারক অনুযায়ী প্রতিভাত যে, গইব সম্পর্কে যেমন হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনারা প্রত্যেকেই অবহিত ছিলেন তেমনি হযরত আওলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলইহিম উনাদের মধ্য থেকে মহান আল্লাহ পাক তিনি যাকে ইচ্ছা উনাকে গইব সম্পর্কে ইলিম দিয়ে থাকেন।

এরপর উক্ত অখ্যাত পত্রিকায় প্রদত্ব উত্তরের স্বপক্ষে সূরা নমল: আয়াত শরীফ ৬৫ এবং সূরা আনআম: আয়াত শরীফ ৫০ দুখানা আংশিক আয়াত শরীফ উনার অর্থ উল্লেখ করেছে। সূরা নমলে উল্লেখিত আয়াত শরীফখানা হচ্ছে-

قل لا يعلم من فى السموت والارض الغيب الا الله وما يشعرون ايان يبعثون.

অর্থ: হে আমার হাবীব নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি উম্মতকে বলে দিন যে, মহান আল্লাহ পাক তিনি ব্যতীত আসমান-যমীনে  যারা রয়েছে, কেউই গইব সম্পর্কে অবহিত নয় এবং তারা (ইনতিকালের পর) কখন উত্থিত হবে সে সম্পর্কেও জানে না।

এ আয়াত শরীফ উনার মধ্যে من (মান) শব্দ দ্বারা নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উম্মতকে বুঝানো হয়েছে। আর আসমান যমীনে যত সৃষ্টি রয়েছে সকলেই উনার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত। যেমন মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

قل يايها الناس انـى رسول الله اليكم جميعا

অর্থ: হে আমার হাবীব নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি বলেন দিন, হে মানুষেরা! নিশ্চয়ই আমি তোমাদের সকলের জন্যে মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল হিসেবে প্রেরিত হয়েছি। সুবহানাল্লাহ! (পবিত্র সূরা আ’রাফ শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ১৫৮)

একইভাবে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

ارسلت الى الخلق كافة

অর্থ: আমি সমস্ত সৃষ্টির জন্যে রসূল হিসেবে প্রেরিত হয়েছি। (মুসলিম শরীফ)

কাজেই, আসমান ও যমীনে যারা রয়েছে মানুষ হোক, জিন হোক, ফেরেশতা হোক কিংবা অন্য প্রাণী হোক সকলেই নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত।

এরপর সূরা আনআম শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখিত আয়াত শরীফখানা হচ্ছে-

قل لا اقول لكم عندى خزائن الله ولا اعلم الغيب.

অর্থ: হে আমার হাবীব নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি (উম্মতকে) বলে দিন, আমি তোমাদেরকে বলিনা যে, আমার কাছে মহান আল্লাহ পাক উনার ভা-ার রয়েছে। আর আমি গইব সম্পর্কেও অবহিত নই।

এ আয়াত শরীফখানা হচ্ছে অর্ধেক, আয়াত শরীফখানা শেষ হয়নি, আয়াত শরীফখানা উনার পরবর্তী অংশে রয়েছে-

ان اتبع الا ما يوحى الى

অর্থাৎ: আমি তো কেবল ঐ ওহী মুবারক উনার অনুসরণ করি, যা আমার নিকট অবতীর্ণ হয়।

এখন তাহলে কি অর্থ দাঁড়ালো? অর্থ এই দাঁড়ালো যে, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সবকিছুই খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক উনার তরফ থেকে নাযিলকৃত পবিত্র ওহী মুবারক উনার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত, সেহেতু উনার আলাদা কোন অবস্থা নেই। মহান আল্লাহ পাক তিনি যা বলতে বলেন তিনি তাই বলেন, যা করতে বলেন, তাই করেন, উনার ইচ্ছা মুবারকই উনার ইচ্ছা মুবারক, উনার চাওয়া মুবারকই উনার চাওয়া মুবারক, উনার ভাণ্ডার মুবারকই উনার ভা-ার মুবারক, উনার প্রদত্ব ইলিম মুবারকই উনার ইলিম মুবারক; তা গইব হোক কিংবা হাদ্বির হোক, বাতিন হোক কিংবা যাহির হোক। অর্থাৎ আউওয়াল ও আখিরের সর্বপ্রকার ইলিম এবং সর্বপ্রকার নিয়ামত উনার কাছে জমা করা হয়েছে বা উনাকে হাদিয়া করা হয়েছে।

যেমন এ প্রসঙ্গে স্বয়ং নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি নিজেই ইরশাদ মুবারক করেন-

اعطيت بحوامع الكلم

অর্থাৎ- “আমাকে সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমস্ত ইলিম মুবারক হাদিয়া করা হয়েছে।” (মুসলিম শরীফ)

এবং নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

انـما انا قاسم والله يعطى

অর্থ: “মহান আল্লাহ পাক তিনি হাদিয়া করেন আর নিশ্চয়ই আমি হলাম (উক্ত হাদিয়া) বণ্টনকারী।” (বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফ)

অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক তিনি উনার সর্বপ্রকার নিয়ামত উনার হাবীব নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে হাদিয়া করেছেন। আর নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি কুল মাখলুক্বাতের যাকে যতটুকু বা যে পরিমাণ ইচ্ছা তাকে সে পরিমাণ বণ্টন করে দিয়ে থাকেন। দেখা যাচ্ছে, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নিকট মহান আল্লাহ পাক উনার ভা-ার মুবারক রয়েছে এবং তিনি সে ভা-ার মুবারক থেকে যাকে যতটুকু প্রয়োজন তাকে ততটুকু দিয়ে থাকেন।

এখন যিনি কুল-মাখলুক্বাতের জন্য বণ্টনকারী তিনি মূলত সৃষ্টির শুরু হতে সৃষ্টির শেষ পর্যন্ত বণ্টনকারী। আর বণ্টনকারী যাদের মাঝে বণ্টন করবেন তাদেরকে অবশ্যই চিনেন ও জানেন। অন্যথায় না চিনলে ও না জানলে কাকে কতটুকু বা কি পরিমাণ দিবেন? কাজেই বলার অপেক্ষা রাখেনা, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইলমে বাতিন বা ইলমে গইবসহ সমস্ত ইলিমের অধিকারী। সুবহানাল্লাহ!

উল্লেখ্য, লওহে মাহফূয সম্পর্কে বলা হয়, সৃষ্টির শুরু হতে যা কিছু হয়েছে, হচ্ছে ও হবে সবকিছুই সেখানে লিপিবদ্ধ রয়েছে। এখানে বলতে হয়, লওহে মাহফূয সৃষ্টি হয়েছে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ওজুদ পাক নূর মুবারক উনার অংশ হতে। আর লওহে মাহফূয যেহেতু সৃষ্টিরাজির মধ্যে একটি সৃষ্টি সেহেতু তারমধ্যে সংরক্ষিত নিয়ামত তথা ইলিমেরও বণ্টনকারী হলেন নূরে  মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি। সুবহানাল্লাহ!

অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক সুবহানাহূ ওয়া তায়ালা উনার ইলিমের একটা অংশ রাখা হয়েছে লওহে মাহফূযে যেই ইলিম মাখলুক্বাত সম্পর্কিত এবং মাখলুক্বাতের জন্য বণ্টিত। আর নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যেহেতু মাখলুক্বাতের সর্বপ্রকার নিয়ামতের বণ্টনকারী সেহেতু তিনি মাখলুক্বাতের অবস্থা সম্পর্কিত ও তাদের জন্য বণ্টিত লওহে মাহফূযে সংরক্ষিত সমস্ত ইলিম উনাদেরও অধিকারী এবং তার বণ্টনকারীও।

মূলকথা হলো, লওহে মাহফূযে সংরক্ষিত ইলিম মুবারক যেরূপ মহান আল্লাহ পাক সুবহানাহূ ওয়া তায়ালা উনার ইলিম মুবারক উনার একটা অংশ একইভাবে উক্ত ইলিম নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনারও ইলিম মুবারক উনার অংশ বিশেষ। সুবহানাল্লাহ!

মনে রাখতে হবে, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি পরিপূর্ণরূপে গইবের ইলিম বণ্টনকারী। উনার মধ্যেমেই বান্দা ও উম্মত গইবের ইলিম জেনেছে, বুঝেছে ও লাভ করেছে। সুবহানাল্লাহ!

কালামুল্লাহ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

عالـم الغيب فلا يظهر على غيبه احدا الا من ارتضى من رسول

অর্থ: “মহান আল্লাহ পাক সুবহানাহূ ওয়া তায়ালা তিনি আলিমুল গইব। তিনি উনার গইবের ইলিম উনার মনোনীত রসূল আলাইহিমুস সালাম ব্যতীত কারো নিকট প্রকাশ করেন না।” (সূরা জিন : আয়াত শরীফ-২৬, ২৭)

প্রতিভাত হলো, হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনারা প্রত্যেকেই ইলমে গইবের অধিকারী। আর উনারা এই নিয়ামতের অধিকারী হয়েছেন নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মুবারক বণ্টনের ওসীলায়।

অতএব, পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ উনাদের আলোকে উপরের সংক্ষিপ্ত জাওয়াবের দ্বারা যেখানে হযরত আওলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনাদের ইলমে গইব সম্পর্কে অবহিত হওয়াটাই প্রমাণিত সেখানে যিনি সাইয়্যিদুল মুরসালীন, যিনি ইমামুল মুরসালীন, যিনি হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ক্ষেত্রে ইলমে গইব সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করা যে কত চরম জিহালতি, গুমরাহী ও কুফরী; তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মূলত নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার যারা চিরশত্রু, চির লা’নতগ্রস্ত ও চিরজাহান্নামী কেবল তারাই উক্ত বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারে। জানা আবশ্যক যে, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র শান বা মর্যাদা সম্পর্কিত কোন বিষয়ে ফায়ছালা দিতে হলে শুধু দু’ বা একখানা আয়াত শরীফ উনার আংশিক ও শাব্দিক অর্থের উপর ভিত্তি করে ফায়ছালা দেয়াটা আদৌ শুদ্ধ নয় বরং উনার সীমাহীন পবিত্র মর্যাদা বা শান মুবারক সম্পর্কে ফায়ছালা দিতে হলে সম্পূর্ণ কুরআন শরীফ ও সম্পূর্ণ হাদীছ শরীফ উনার ইলিম থাকতে হবে; অন্যথায় প্রদত্ব ফায়ছালা অশুদ্ধ ও কুফরী হবে এবং পরিণামে চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নাম ওয়াজিব হবে। নাউযুবিল্লাহ!

বিশেষ দ্রষ্টব্য: এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে মাসিক আল বাইয়্যিনাত শরীফ ১২৯তম সংখ্যা পাঠ করুন।

মুহম্মদ আশিকুর রহমান

রাজশাহী

সুওয়াল: নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে হাযির-নাযির জানাটাকে কেউ কেউ শিরিক মনে করে? এ ব্যাপারে ইসলামী শরীয়ত উনার সঠিক ফায়ছালা জানতে ইচ্ছুক?

জাওয়াব: কুল-কায়িনাতের নবী ও রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সর্বত্র হাযির ও নাযির। বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফ উনাদের মধ্যে বর্ণিত রয়েছে, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

انـما انا قاسم والله يعطى

অর্থ: “মহান আল্লাহ পাক তিনি হাদিয়া করেন আর নিশ্চয়ই আমি হলাম (উক্ত হাদিয়া) বণ্টনকারী।”

অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক উনার সর্বপ্রকার নিয়ামত উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে হাদিয়া করেছেন। আর হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি কুল-মাখলূক্বাতের যাকে যতটুকু ইচ্ছা তাকে ততটুকু নিয়ামত বণ্টন করে দিয়ে থাকেন। সুবহানাল্লাহ!

এখন যিনি কুল-মাখলূক্বাতের জন্য নিয়ামত  বণ্টনকারী; তিনি যদি কুল-মাখলূক্বাতের কাছে হাযির বা উপস্থিত না থাকেন এবং তাদেরকে নাযির বা দেখে না থাকেন তাহলে তিনি তাদের মাঝে কিভাবে নিয়ামত বণ্টন করবেন? কাজেই, কায়িনাতের সমস্ত সৃষ্টির জন্য তিনি যেহেতু নিয়ামত বণ্টনকারী সেহেতু বলার অপেক্ষা রাখে না তিনি সবখানেই হাযির ও নাযির।

নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি কায়িনাতের সমস্ত স্থানে হাযির বা উপস্থিত ও সবকিছু নাযির বা প্রত্যক্ষকারী।

এ প্রসঙ্গে হযরত ইমাম তবারানী রহমতুল্লাহি আলাইহি এবং হযরত নঈম ইবনে উমর রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাদের থেকে একখানা হাদীছ শরীফ বর্ণিত রয়েছে, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

ان الله قد رفع لى الدنيا فانا انظر اليها والى ما هو كائن فيها الى يوم القيامة كانـما انظر الى كفى هذه.

অর্থ: নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক তিনি এই পৃথিবীকে আমার চোখের সামনে এরূপভাবে রেখেছেন যে, আমি এ সমগ্র পৃথিবীকে এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত তার মধ্যে যা কিছু সৃজিত বা সংঘটিত হবে তদসমূহকে ওইরূপভাবে দেখি যেরূপ আমার হাত মুবারক উনার তালু মুবারক দেখে থাকি। সুবহানাল্লাহ! (তবারানী, মিশকাত শরীফ)

উল্লেখ্য, মহান আল্লাহ পাক তিনি জিসিম ও ছূরত এ দুটির কোনো একটি হিসেবে হাযির ও নাযির নন। বরং তিনি ছিফত-অর্থাৎ ইলিম ও কুদরত মুবারক উনার দ্বারা এবং ছিফত মিছালী ছূরত মুবারক হিসেবে কায়িনাতের সমস্ত স্থানে হাযির ও নাযির।

আর নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ছিফত-ইলিম ও মু’জিযা দ্বারা এবং ছিফত- নূর ও রহমত হিসেবে কায়িনাতের সমস্ত স্থানে হাযির ও নাযির। আর উনার যেহেতু জিসিম ও ছূরত মুবারক রয়েছে সেহেতু তিনি যে জিসিম মুবারক-এ রওযা শরীফ উনার মধ্যে অবস্থান করছেন উনার ইখতিয়ার ও ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তিনি সেই জিসিম মুবারক নিয়ে কোথাও হাযির হবেন না। আহলে সুন্নত ওয়াল জামা‘আত উনাদের মুজতাহিদ ইমামগণ উনারা এ বিষয়ে একমত যে, তিনি ওই জিসিম মুবারক নিয়ে রওযা শরীফ থেকে উঠলে ক্বিয়ামত হয়ে যাবে। তাই তিনি উক্ত জিসিম মুবারক উনার অনুরূপ জিসিম মুবারক ও ছূরত মুবারক ধারণ করে এবং মিছালী ছূরত মুবারক নিয়ে কায়িনাতের সমস্ত স্থানে হাযির ও নাযির থাকেন, যে কারণে উনার আশিকগণ উনাকে স্বপ্নে, মুরাক্বাবা-মুশাহাদার হালতে এমনকি জাগ্রত অবস্থার মধ্যেও দেখে থাকেন এবং কথোপকথনও করে থাকেন। সুবহানাল্লাহ!

প্রতিভাত হলো, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি কায়িনাতের সমস্ত স্থানে হাযির ও নাযির।

মুহম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুন

কক্সবাজার

 

সুওয়াল: আমরা জেনে আসছি, আমাদের নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি নূরের সৃষ্টি। উনার নূর মুবারকই সর্বপ্রথম সৃষ্টি করা হয় এবং সেই নূর মুবারক হতেই সবকিছুর সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু ইদানীংকালে কিছু কিছু মৌলভী ছাহেব বলে যে, ‘তিনি নাকি মাটির সৃষ্টি। আবার কেউ কেউ বলে যে, মাটি ও নূর উভয়টির দ্বারা তিনি সৃষ্টি হয়েছেন।’আসলে কোনটি সঠিক?

জাওয়াব:  আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে ‘নূরের তৈরি’ হিসেবে অস্বীকার করা এবং তার বিপরীত উনাকে মাটির তৈরি বলা এবং নূর ও মাটি দ্বারা তৈরি বলা পবিত্র কুরআন শরীফ উনার আয়াত শরীফ ও অসংখ্য হাদীছ শরীফ অস্বীকার করার নামান্তর। যা কাট্টা কুফরীর অন্তর্ভুক্ত। কেননা, অসংখ্য পবিত্র আয়াত শরীফ ও পবিত্র ছহীহ হাদীছ শরীফ দ্বারা প্রমাণিত যে, আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি শুধুমাত্র নূরের তৈরি। সেজন্য বলা হয়, তিনি নূরে মুজাসসাম অর্থাৎ তিনি আপাদমস্তক নূর। মাটির কোন অস্তিত্বই উনার মধ্যে নেই।

মহান আল্লাহ পাক “পবিত্র সূরা মায়িদা শরীফ” উনার ১৫ নম্বর আয়াত শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন-

قد جاءكم من الله نور.

অর্থ: “নিশ্চয় তোমাদের নিকট মহান আল্লাহ পাক উনার তরফ থেকে ‘নূর’ এসেছেন।”

উল্লেখ্য, এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তিনি “নূর” শব্দ দ্বারা সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকেই বুঝিয়েছেন, যেহেতু তিনি আপাদমস্তক “নূর বা নূরের তৈরি।”

আর হযরত মুফাসসিরীনে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনারা বলেন, উক্ত ‘নূর’ হচ্ছেন নূরে মুজাসসাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

যেমন ক্বাজিউল কুজাত হযরত ইমাম আবূ সউদ মুহম্মদ ইবনে মুহম্মদ ইমাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মশহূর তাফসীর “তাফসীরে আবী সউদ”-এর ৩য় জিলদ ১৮ পৃষ্ঠায় লিখেন-

(قد جاءكم من الله نور.) … الـمراد بالنور هو الرسول صلى الله عليه وسلم

অর্থ: বর্ণিত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে ‘নূর’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলেন “সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম তিনি।”

এছাড়া আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বয়ং নিজেই নিজেকে নূরের তৈরি বলে উল্লেখ করেছেন। যেমন, পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে-

عن حضرت جابر رضى الله تعالى عنه قال قلت يا رسول الله صلى الله عليه وسلم انت بابى انت وامى اخبرنى عن اول شىء خلق الله تعالى قبل الاشياء قال يا جابر رضى الله تعالى عنه ان الله تعالى قد خلق قبل الاشياء نور نبيك.

অর্থ: “হযরত জাবির রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি বললাম, ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবান হোক, আমাকে জানিয়ে দিন যে, মহান আল্লাহ পাক তিনি সর্বপ্রথম কোন জিনিস সৃষ্টি করেন? তিনি বললেন, হে জাবির রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু! মহান আল্লাহ পাক সবকিছুর পূর্বে আপনার নবী উনার নূর মুবারককে সৃষ্টি করেন।” মুসনাদে আব্দির রয্যাক, দালায়িলুন নুবুওওয়াত, মাদারিজুন নুবুওওয়াত ইত্যাদি।

উল্লেখ্য, মহান আল্লাহ পাক উনার সর্বপ্রথম সৃষ্টিই হচ্ছেন উনার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নূর মুবারক। আর উক্ত নূর মুবারক থেকেই মাটিসহ সবকিছুর সৃষ্টি হয়। তাহলে উনাকে মাটির সৃষ্টি বলা কিভাবে শুদ্ধ হতে পারে?

কাজেই, পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে বাশার, ইনসান বা মানুষ মাটির তৈরি বলতে একমাত্র হযরত আদম আলাইহিস সালাম উনাকে বুঝানো হয়েছে। আর অপর কাউকে নয়। যেমন মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেছেন-

واذ قال ربك للملئكة انى خالق بشرا من طين

অর্থ: “যখন আপনার পালনকর্তা ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকে বললেন, আমি মানুষ সৃষ্টি করবো মাটি দ্বারা।” (সূরা ছোয়াদ: আয়াত শরীফ ৭১)

“তাফসীরে সামারকান্দী”-এর ৩য় জিঃ, ১৪১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-

(انى خالق بشرا من طين) يعنى ادم عليه السلام.

অর্থ: “(নিশ্চয়ই আমি সৃষ্টি করবো বাশার মাটি থেকে) অর্থাৎ হযরত আদম আলাইহিস সালাম উনাকে।”

মূলত পবিত্র কুরআন শরীফ উনার যতো আয়াত শরীফ উনাদের মধ্যে ‘মানুষকে’ মাটির তৈরি বলা হয়েছে সে সকল আয়াত শরীফ উনাদের মধ্যে উল্লিখিত ‘মানুষ’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলেন “হযরত আদম আলাইহিস সালাম।” কারণ শুধুমাত্র হযরত আদম আলাইহিস সালাম উনাকেই মহান আল্লাহ পাক তিনি সরাসরি মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। হযরত আদম আলাইহিস সালাম তিনি ব্যতীত আর কেউই মাটি থেকে সৃষ্টি নন।

অতএব, প্রত্যেক মুসলমানকে এ আক্বীদাই রাখতে হবে যে, মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি নূরে মুজাসসাম অর্থাৎ নূরের তৈরি, মাটির তৈরি নন। অথবা নূর ও মাটি মিশ্রিতও নন। উনাকে মাটির বা মাটি ও নূরের তৈরি বলা সুস্পষ্ট গুমরাহী ও কুফরীর অন্তর্ভুক্ত।

(বিঃ দ্রঃ এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে মাসিক আল বাইয়্যিনাত শরীফ পত্রিকা উনার ফতওয়া বিভাগ “৬০তম থেকে ৮২তম” সংখ্যা পাঠ করুন। সেখানে ২৪১টি পবিত্র কুরআন শরীফ-সুন্নাহ শরীফ উনাদের দলীলসহ বিস্তারিত ফতওয়া প্রদান করা হয়েছে। এছাড়াও ৯৪তম ও ১৬২তম সংখ্যার সুওয়াল-জাওয়াব বিভাগ দেখুন।)

 

ইঞ্জিনিয়ার মুহম্মদ রিদ্বওয়ানুর রহমান

দিনাজপুর

 

সুওয়াল: কেউ কেউ সূরা হামীম সাজদাহ উনার ৬ নম্বর আয়াত শরীফ-

قل انـما انا بشر مثلكم يوحى الى

দলীল হিসেবে গ্রহণ করে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে অন্যান্য মানুষের মতো বলতে চায়। তাদের বক্তব্য কতটুকু গ্রহণযোগ্য দয়া করে জানাবেন।

জাওয়াব: নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে যারা অন্যান্য মানুষের মতো বলতে চায় তারা মূলত আশাদ্দুদ দরজার জাহিল ও পথভ্রষ্ট। নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে অন্যান্য মানুষের মতো মনে করা সুস্পষ্ট কুফরীর শামিল। মূলতঃ যারা কাফির কেবল তারাই হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকে তাদের মতো মানুষ বলে মনে করতো।

যেমন হযরত নূহ আলাইহিস সালাম উনার ক্বওম এবং আদ ও ছামূদ গোত্রের লোকেরা হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের শানে বেআদবী করতে গিয়ে বলেছিলো-

ان انتم الا بشر مثلنا

অর্থাৎ আপনারা তো আমাদের মতোই বাশার (মানুষ)। (পবিত্র সূরা ইব্রাহীম শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ১০)

একইভাবে ফিরআউনের লোকেরা হযরত মূসা আলাইহিস সালাম ও হযরত হারূন আলাইহিস সালাম উনাদের ব্যাপারে বলেছিলো

انؤمن لبشرين مثلنا

অর্থাৎ আমরা কি আমাদের মতোই দু’জন বাশার তথা মানুষ উনাদের উপর ঈমান আনবো। (পবিত্র সূরা মু’মিনূন শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ৪৭)

কাফির সর্দাররা হযরত নূহ আলাইহিস সালাম উনাকে বলেছিলো-

ما نراك الا بشرا مثلنا

অর্থাৎ আমরা তো আপনাকে আমাদের মতোই (বাশার) মানুষ দেখতে পাচ্ছি। (পবিত্র সূরা হুদ শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ২৭)

হযরত ছালিহ আলাইহিস সালাম উনাকে কাফিররা বলেছিলো-

ما انت الا بشر مثلنا

অর্থাৎ আপনি তো আমাদের মতোই মানুষ। (পবিত্র সূরা শুয়ারা শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ১৫৪)

হযরত হূদ আলাইহিস সালাম উনার সম্পর্কে কাফিরেরা বলেছিলো-

ما هذا الا بشر مثلكم ياكل مما تاكلون منه ويشرب مما تشربون

অর্থাৎ এই লোকটি তিনি তো আমাদের মতোই একজন মানুষ। তোমরা যা আহার করো, তিনিও তা আহার করেন এবং তোমরা যা পান করো তিনিও তা পান করেন। (পবিত্র সূরা মু’মিনূন শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ৩৩)

এমনকি যিনি সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সম্পর্কেও কাফিরেরা বলেছিলো-

هل هذا الا بشر مثلكم افتاتون السحر وانتم تبصرون.

অর্থ: “ইনি তো তোমাদের মতো ‘বাশার’ ব্যতীত কেউ নন। তা সত্ত্বেও কি তোমরা দেখে শুনে জাদুর শিকার হবে।” (পবিত্র সূরা আম্বিয়া শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ৩)

নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সম্পর্কে তারা আরো বলতো-

مال هذا الرسول ياكل الطعام ويمشى فى الاسواق

অর্থ: “ইনি কেমন রসূল যিনি খাদ্য খান এবং বাজারে যান।” (পবিত্র সূরা ফুরকান শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ৭)

মক্কার কাফির ওলীদ বিন মুগীরা সে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সম্পর্কে বলেছিলো-

ان هذا الا قول البشر

অর্থাৎ, ইহা তো মানুষের কথা ছাড়া আর কিছু নয়। (সূরা মুদ্দাছ্ছির শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ২৫)

কাজেই, উল্লিখিত পবিত্র আয়াতে কারীমা উনার দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকে নিজের মতো মানুষ বলা কাফিরদের অন্যতম একটি স্বভাব।

মূলত কাদিয়ানীরা যেমন  خاتم النبينউনার মনগড়া অর্থ ও ব্যাখ্যা করে খতমে নুবুওওয়াতকে অস্বীকার করে থাকে তদ্রুপ বাতিল আক্বীদা ও ফিরক্বার লোকের পবিত্র কালাম উনার পবিত্র সূরা হামীম সাজদা উনার আয়াত শরীফ-

قل انـما انا بشر مثلكم يوحى الى

উনার মনগড়া অর্থ ও ব্যাখ্যা করে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে তাদের মতো মানুষ বলে থাকে। নাউযুবিল্লাহ!

প্রকৃতপক্ষে পবিত্র আয়াত শরীফ উনার সঠিক অর্থ ও মর্ম হলো- “হে আমার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি ওই মুশরিকদের বলে দিন যে, আমি তোমাদের মেছাল (মত) একজন মানুষ, (হাক্বীক্বত আমি একজন রসূল; যার কারণে) আমার নিকট ওহী এসে থাকে।

পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে কি মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব উনাকে আমাদের মতো বলা হয়েছে? মোটেও নয়। কারণ উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যেই

يوحى الى

অর্থাৎ ‘আমার নিকট ওহী মুবারক এসে থাকে’ এ বাক্যটি হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে সকল মানুষ থেকে আলাদা করে দিয়েছে। যেহেতু অন্যান্য মানুষের নিকট ওহী মুবারক আসে না।

এর প্রমাণ হচ্ছে حيوان (হায়ওয়ান) শব্দটি। যেমন ‘হায়ওয়ান’ বা প্রাণী বলতে মানুষকেও বুঝায় এবং অন্যান্য জীব-জন্তুকেও বুঝায়। তবে কি কেউ একথা বলবে যে, গরু-ছাগল, ঘোড়া-গাধা ইত্যাদিও আমাদের মতো ‘হায়ওয়ান’।

মূলত মানুষ হায়ওয়ান বটে কিন্তু গরু-ছাগল, ঘোড়া-গাধা প্রভৃতি হায়ওয়ানের মতো নয়। কেননা মানুষ হলো ‘হায়ওয়ানে নাতিক’ অর্থাৎ বাকশক্তিসম্পন্ন জীব। মানুষ বিবেক, জ্ঞান ও বাক শক্তির অধিকারী। যেরূপ এ নাতিক্ব বা ‘বাকশক্তি সম্পন্ন’ শব্দটি মানুষকে অন্যান্য জীব-জন্তু হতে পৃথক করে দিয়েছে তদ্রুপ يوحى الى (আমার নিকট ওহী মুবারক এসে থাকে) পবিত্র বাক্যখানা নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে সাধারণ মানুষ থেকে পৃথক করে দিয়েছে।

বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফ উনাদের মধ্যে বর্ণিত রয়েছে, হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম তিনি ‘ইহসান’ সম্পর্কে জানতে চাইলে তার উত্তরে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন-

ان تعبد الله كانك تراه فان لـم تكن تراه فانه يراك

অর্থাৎ ইহসান হলো এমনভাবে মহান আল্লাহ পাক উনার ইবাদত করো অর্থাৎ মুসলমানের প্রতিটি মুহূর্তই যেহেতু ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত সেহেতু প্রতিটি মুহূর্ত এমনভাবে অতিবাহিত করো যেনো তুমি মহান আল্লাহ পাক উনাকে দেখছো, যদি দেখতে না পাও তাহলে ধারণা করো যে তিনি তোমাকে দেখছেন।

এ পবিত্র হাদীছ শরীফ থেকে হযরত মুহাদ্দিছীনে কিরাম ইহসানের দুটি স্তর বর্ণনা করেছেন। এক. বান্দা মহান আল্লাহ পাক উনাকে দেখে দেখে ইবাদত করবে। দুই. বান্দাকে মহান আল্লাহ পাক দেখছেন এ ধারণা করে বান্দা ইবাদত করবে। এ দুঅবস্থা ব্যতীত ইবাদত করা হলে সে ইবাদত মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট কবূলযোগ্য হবেনা।

এ পবিত্র হাদীছ শরীফ প্রমাণ করছে, বান্দা যমীনে মহান আল্লাহ পাক উনাকে দেখবে। এখন কিভাবে দেখবে সে বর্ণনা অন্য পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে রয়েছে এবং হযরত ইমাম-মুজতাহিদ-আওলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনাদের কিতাবাদিতে উনারা সেটা বর্ণনা করেছেন। তাহলো- মিছালী ছূরত মুবারক উনার বর্ণনা। কারণ আমাদের আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত উনাদের আক্বীদা হলো, যমীনে মহান আল্লাহ পাক উনাকে হাক্বীক্বী ছূরত মুবারক-এ কেউই দেখবে না। মিছালী ছূরত মুবারক-এ দেখতে পাওয়া বহু বর্ণনার মধ্যে একটি বর্ণনা হলো বাশারী ছূরত মুবারক-এ দেখা।

এখন মহান আল্লাহ পাক উনাকে মিছালী বাশারী ছূরত মুবারকে দেখে কী একথা বলা শুদ্ধ হবে যে, মহান আল্লাহ পাক তিনি মানুষের মতো? নাঊযুবিল্লাহ!

যদি মহান আল্লাহ পাক উনাকে মিছালী বাশারী ছূরত মুবারক-এ দেখে মানুষের মতো বলা শুদ্ধ না হয় তাহলে মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে মিছালী বাশার ছূরত বা আকৃতি মুবারক উনার কারণে অন্যান্য মানুষের মতো বলা শুদ্ধ হবে কি করে?

পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সৃষ্টির পর থেকে যমীনে আগমনের পূর্ব পর্যন্ত শুধুমাত্র নূর মুবারক উনার ছূরত বা আকৃতি মুবারক-এ ছিলেন। আর হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারাও নূর মুবারক দ্বারা সৃষ্টি। তাই বলে কি কোন ফেরেশতা কখনও একথা বলেছেন যে, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উনাদের মতো? বললে কি সে কথা শুদ্ধ হতো? অবশ্যই না। তাহলে বাশারী ছূরত মুবারক উনার কারণে তিনি অন্য মানুষের মতো হন কি করে?

নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আনুষ্ঠানিক নুবুওওয়াত প্রকাশের তেইশ বছর যিন্দিগী মুবারক-এ হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম তিনি চব্বিশ হাজার বার সাক্ষাৎ করেছেন। এরমধ্যে তিনি অনেক সময় ছাহাবী হযরত দাহইয়াতুল কলবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার মুবারক ছূরত বা আকৃতিতে সাক্ষাৎ করেছেন। আর তাই পবিত্র সূরা মারইয়াম শরীফ উনার ১৭ নম্বর আয়াত শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তিনি হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম উনার মানব আকৃতি ধারণ করার কথা উল্লেখ করেছেন। এই পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যেও হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম উনার ক্ষেত্রে ‘বাশার’ বা মানব শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এখন বাশার ছিফতের অধিকারী হওয়ার কারণে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে যারা তাদের মতো সাধারণ মানুষ বলছে, তারা তাহলে হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম উনাকে সাধারণ মানুষের মতো বলছে না কেন?

একইভাবে জিনেরাও মানুষের ছূরত ধারণ করে চলাফেরা করে, মানুষের সাথে সাক্ষাৎ করে সেজন্য তাদেরকে কি মানুষ বলা শুদ্ধ হবে? কস্মিনকালেও নয়।

উল্লেখ্য, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার শান মুবারক সম্পর্কে কটূক্তি করে যারা বলছে যে, তিনি নাকি তাদের মতোই সাধারণ মানুষ। নাঊযুবিল্লাহ! যারা এরূপ জঘন্য উক্তি করছে তারা কি কখনও তাদের দলের আমীর, উস্তাদ ও পিতা-মাতার দাঁতকে কুকুরের দাঁতের মতো বলবে? যদিও কুকুরের দাঁত তাদের আমীর, মুরুব্বী, উস্তাদ ও পিতা-মাতার দাঁতের চেয়েও শক্ত।

আরো উল্লেখ্য, জগৎ কুখ্যাত নমরূদ, শাদ্দাদ, কারূন, ফিরআউন, আবূ জাহিল, আবূ লাহাব এরাও তো মানুষ, তাহলে মাঝে মাঝে ওইসব কুলাঙ্গাররা নিজেদের বড়ত্ব প্রকাশ করার জন্য বলুক যে, সে এবং তাদের আমীর ও মুরুব্বী গং নমরূদ, শাদ্দাদ, কারূন, ফিরআউন, আবূ জাহিল, আবূ লাহাবের মতোই।

উপরন্তু ‘মিছলু’ বা ‘মতো’ শব্দটির জন্য সবকিছুকেই যদি একাকার করতে হয় তাহলে পৃথিবীটা তো কমলা লেবুর মতোই গোলাকার। ফলে তারা নিজেদের ঘরের দেয়াল চাটুক আর বলুক যে তারা কমলা লেবু খাচ্ছে। কারণ, তাদের ঘরটাতো পৃথিবীর ভিতরেই। মহান আল্লাহ পাক কত চমৎকারইনা বলেছেন-

من اتخذ الـهه هواه واضله الله على علم وختم على سمعه وقلبه وجعل على بصره غشاوه

অর্থ: “যে ব্যক্তি তার খেয়াল-খুশিকে স্বীয় উপাস্য স্থির করে নেয়, মহান আল্লাহ পাক তিনি জেনে শুনেই তাকে পথভ্রষ্ট করেন, তার কান ও অন্তরে মোহর মেরে দেন এবং তার চোখের উপর আবরণ বা পর্দা রেখে দেন।” অর্থাৎ সে নফসের পায়রবী করার কারণে পথভ্রষ্ট হয়ে যায় অতঃপর তার কান ও অন্তরে মহর পড়ে যায় এবং চোখে পর্দা পড়ে যায়।

ফলে, এদের পক্ষে হক্ব জানা, বুঝা, অনুধাবন করা এবং তা মানা ও গ্রহণ করা কস্মিনকালেও সম্ভব নয়।

 

মুহম্মদ জামিলুর রহমান

নরসিংদী

সুওয়াল: কেউ কেউ বলে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ছায়া মুবারক ছিলো না, আবার কেউ কেউ বলে, উনার ছায়া মুবারক ছিলো। কোনটি সঠিক?

জাওয়াব: সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ছায়া মুবারক ছিল না। এটাই সঠিক।

এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত ও প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিছ আল্লামা হাকীম তিরমিযী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার “নাওয়াদিরুল উছূল” কিতাবে পবিত্র হাদীছ শরীফ বর্ণনা করেছেন, হযরত হাকীম তিরমিযী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি “নাওয়াদিরুল উছূল” কিতাবে হযরত যাকওয়ান রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার থেকে বর্ণনা করেন, “নিশ্চয়ই সূর্য ও চাঁদের আলোতেও সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ছায়া মুবারক দেখা যেত না।”

ইমামুল মুহাদ্দিছীন, সুলত্বানুল আরিফীন হযরত ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনিও উনার “খাছায়িছুল কুবরা” নামক কিতাবে উক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফখানা উল্লেখ করে প্রমাণ করেন যে, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কোন ছায়া মুবারক ছিলো না।

বাহ্রুল উলূম, শায়খুল মাশায়িখ, হযরতুল আল্লামা ইবনে সাবা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার “শিফাউছ ছুদূর” কিতাবে লিখেছেন, “নিশ্চয়ই নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম উনার ছায়া মুবারক যমীনে পড়তো না। কেননা তিনি ছিলেন নূর। অতঃপর যখন তিনি সূর্য অথবা চাঁদের আলোতে হাঁটতেন তখন উনার ছায়া মুবারক দৃষ্টিগোচর হতো না।”

বিখ্যাত ব্যাখ্যাকার, হাফিযুল হাদীছ, আওলাদে রাসূল, হযরতুল আল্লামা ইমাম যুরকানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার “শরহে মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া শরীফ” কিতাবে বর্ণনা করেছেন- “চাঁদ ও সূর্যের আলোতেও হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ছায়া মুবারক দৃষ্টিগোচর হতো না। কেননা তিনি নূর ছিলেন।” সুবহানাল্লাহ!

ইমামুল আল্লাম, জালালু মিল্লাত ওয়াদ্ দীন, আল্লামা হযরত ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার “আলমু’জামুল লাবীব ফী খাছায়িছিল হাবীব” ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামক কিতাব উনার দ্বিতীয় বাবের চতুর্থ অধ্যায়ে লিখেছেন- “হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ছায়া মুবারক যমীনে পড়তো না। চাঁদ ও সূর্যের আলোতেও উনার ছায়া মুবারক দেখা যেতনা।”

হযরতুল আল্লামা ইবনে সাবা রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন- হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যেহেতু সম্পূর্ণ নূর ছিলেন সেহেতু উনার ছায়া মুবারক ছিল না।

হযরত ইমাম রযীন রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, “অবশ্যই হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নূর সমস্ত কিছুকে ছাড়িয়ে যেত।” সুবহানাল্লাহ!

ইমামুল জালীল, মুহাদ্দিছুশ্ শাহীর, ফক্বীহুল আছার, আল্লামা ইমাম ক্বাযী আয়ায রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার “শিফা শরীফ” কিতাবে লিখেছেন- “হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দেহ মুবারক উনার ছায়া মুবারক সূর্য ও চাঁদের আলোতেও পড়তো না। কেননা তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ নূর।” সুবহানাল্লাহ!

বিখ্যাত বুযুর্গ, ওলীয়ে কামিল, হযরত ইমাম ইবনে হাজার মক্কী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি “আফদ্বালুল কুরা” কিতাবে উল্লেখ করেন, “নিশ্চয়ই সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি নূর ছিলেন। নিশ্চয়ই তিনি যখন চাঁদ ও সূর্যের আলোতে হাঁটতেন তখন উনার ছায়া মুবারক প্রকাশ পেতো না।” সুবহানাল্লাহ!

বিখ্যাত মুহাদ্দিছ আল্লামা শিহাবুদ্দীন খাফ্ফাজী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি “নাসীমুর রিয়াদ্ব” নামক কিতাবে লিখেন, “সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নুবুওওয়াত মুবারক প্রমাণের মধ্যে এটাও একটি প্রমাণ যে, উনার শরীর মুবারক উনার ছায়া মুবারক ছিলো না। যখন তিনি সূর্য ও চন্দ্রের আলোতে হাঁটতেন তখনও উনার ছায়া মুবারক পড়তো না। কেননা তিনি (আপাদমস্তক) নূর।” সুবহানাল্লাহ!

কিতাবুল ওয়াফা উনার লিখক হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণনা করেন, “সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ছায়া মুবারক ছিলো না। উনার নূরের উজ্জ্বলতা সূর্য ও বাতির আলোর উপর প্রাধান্য লাভ করতো।” সুবহানাল্লাহ!

ক্বাইয়ূমে আউয়াল, আফদ্বালুল আওলিয়া, শায়খ আহমদ ফারূক্বী সিরহিন্দী হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার জগদ্বিখ্যাত কিতাব “মাকতুবাত শরীফ” উনার ৩য় জিলদ্ ১৫৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “মহান আল্লাহ পাক উনার কি করে ছায়া মুবারক পড়তে পারে? ছায়া তো তিনিই সৃষ্টি করেছেন। তবে কি উনার কোন মিছাল রয়েছে? তবে কি তিনি কামালে লাতাফাত-এর অধিকারী নন? দেখুন সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ‘কামালে লাতাফাত’-উনার অধিকারী হওয়ার কারণে উনার দেহ মুবারক উনার ছায়া মুবারক পড়তো না।” সুবহানাল্লাহ!

পবিত্র হাদীছ শরীফ এবং অনুসরণীয় ইমাম, মুজতাহিদ, আওলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনাদের নির্ভরযোগ্য উল্লিখিত ক্বওল শরীফ মুবারক দ্বারা প্রমাণিত ও প্রতিভাত হলো যে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নূরানী দেহ মুবারক উনার কোন ছায়া ছিল না।

 

সাইয়্যিদ মুহম্মদ মুক্তাদুল ইসলাম

সিলেট

সুওয়াল: আমরা জানি নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ৪০ বৎসর বয়স মুবারক-এ নুবুওওয়াত লাভ করেছেন। কিন্তু আপনাদের মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকায় দেখলাম, তিনি নবী-রসূল হিসেবেই সৃষ্টি হয়েছেন অর্থাৎ সৃষ্টির শুরু হতেই তিনি নবী ও রসুল। এ বিষয়ে দলীলভিত্তিক জাওয়াব জানতে ইচ্ছুক।

জাওয়াব: পবিত্র হাদীছে কুদছীতে ইরশাদ মুবারক হয়েছে, মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

كنت كنزا مخفيا فاحببت ان اعرف فخلقت الخلق لاعرف

অর্থ: “আমি গোপন ছিলাম। যখন আমার মুহব্বত হলো যে, আমি প্রকাশিত হই, তখনই আমি সৃষ্টি করলাম মাখলূক্ব অর্থাৎ আমার হাবীব, নূরে মুজাসসাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে।” (আল মাক্বাছিদুল হাসানা ৮৩৮, কাশফুল খিফা-২০১৩, তমীযুত্তীব-১০৪৫, আসরারুল মারফুয়া-৩৩৫, তানযিয়াতুশ শরীয়াহ, আদ্দুরারুল মুন্তছিরা-৩৩০, আত্তাযকিরা ফি আহাদীছিল মুশতাহিরা)

অন্য পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, নূরে মুজাসসাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

اول ما خلق الله نورى وخلق كل شىء من نورى

অর্থ: “মহান আল্লাহ পাক সর্বপ্রথম আমার নূর মুবারক সৃষ্টি করেছেন এবং উনার থেকেই সমস্ত কায়িনাত সৃষ্টি করেছেন।” (নূরে মুহম্মদী, আল ইনসানুল কামিল, হাক্বীক্বতে মুহম্মদী)

পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো বর্ণিত রয়েছে-

عن حضرت ابى هريرة رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم كنت اول النبين فى الخلق واخرهم فى البعث.

অর্থ: “হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, হাবীবুল্লাহ, নূরে মুজাসসাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, সৃষ্ট জীবের মধ্যে আমিই সর্বপ্রথম নবী হিসাবে সৃষ্টি হয়েছি। কিন্তু আমি প্রেরিত হয়েছি সব নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদের শেষে।” (তাফসীরে বাগবী শরীফ ৫/২৩২, দুররে মানছূর শরীফ ৫/১৮৪, শিফা ১/৪৬৬, মানাহিলুচ্ছফা ৫/৩৬, কানযুল উম্মাল শরীফ ৩১৯১৬, দাইলামী শরীফ ৪৮৫০) মিরকাত শরীফ ১১/৫৮)

আরো ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

عن حضرت عبد الله بن عمر رضى الله تعالى عنهما قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم اول شىء خلق الله القلم من نور واحد.

অর্থ: “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, মহান আল্লাহ পাক প্রথমে কলম সৃষ্টি করেছেন একখানা নূর মুবারক (নূরে হাবীবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার) হতে।” (ইবনে আবি হাতিম শরীফ ১-৯, আহমদ শরীফ ৫-২১৭১, আত্ তয়ালিস ৫৭৭, তিরমিযী শরীফ ২-২৩, দাইলামী শরীফ-২)

এ সম্পর্কে অন্য পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, মহান আল্লাহ পাক তিনি যখন প্রথম মানব, প্রথম নবী ও প্রথম রসূল হযরত আদম আলাইহিস সালাম উনাকে যমীনে প্রেরণ করেন, তখন তিনি দুশ থেকে তিনশত বছর যাবৎ দোয়া ও কান্নাকাটি করার পর বলেন-

يا رب اغفرلى بحق محمد صلى الله عليه وسلم قال الله تعالى يا ادم عليه السلام كيف عرفت محمدا صلى الله عليه وسلم قال لانك لـما خلقتنى بيدك ونفخت فى من روحك رفعت راسى فرايت على قوائم العرش مكتوبا لا اله الا الله محمد رسول الله صلى الله عليه وسلم فعلمت انك لـم تضف الى اسمك الا احب الخلق اليك قال الله تعالى صدقت يا ادم لولا محمد رسول الله صلى الله عليه وسلم ما خلقتك.

অর্থ: “হে মহান আল্লাহ পাক! আপনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ওসীলায় আমার দোয়া কবুল করুন। তখন মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, হে হযরত আদম আলাইহিস সালাম! আপনি কিভাবে আমার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে চিনলেন? উত্তরে হযরত আদম আলাইহিস সালাম তিনি বলেন, আয় মহান আল্লাহ পাক! আপনি যখন আমাকে কুদরতী হাত মুবারক-এ তৈরি করে আমার মধ্যে রূহ মুবারক ফুঁকে দিলেন, তখন আমি মাথা মুবারক উত্তোলন করে দেখলাম আপনার পবিত্র আরশে মুয়াল্লা উনার স্তম্ভে লিখা রয়েছে-

لا اله الا الله محمد رسول الله صلى الله عليه وسلم

তখন আমি বুঝতে পারলাম যে, আপনার নাম মুবারক উনার সাথে যাঁর নাম মুবারক লিখা রয়েছে, তিনিই আপনার সবচেয়ে বেশি খাছ ও প্রিয় বান্দা হবেন। তাই আমি উনার ওসীলা দিয়ে আপনার নিকট দোয়া চেয়েছি।

তখন মহান আল্লাহ পাক তিনি হযরত আদম আলাইহিস সালাম উনাকে লক্ষ্য করে বলেন, “আপনি সত্যই বলেছেন। যদি নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে সৃষ্টি না করতাম তবে আপনাকেও সৃষ্টি করতাম না।” সুবহানাল্লাহ! (আল্ মুস্তাদারক লিল হাকিম শরীফ, আছ ছহীহাহ্ শরীফ, মুখতাছারুল মুস্তাদরাক শরীফ, আত্ তাওয়াস্সুল, আদ্ দুররুল মানছূর শরীফ, কানযুল উম্মাল শরীফ)

عن حضرت ميسرة الفجر رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم كنت نبيا وادم بين الروح والجسد.

অর্থ: “হযরত মাইসারাতুল ফাজর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, আমি তখনো নবী ছিলাম যখন হযরত আদম আলাইহিস সালাম রূহ মুবারক ও শরীর মুবারক উনার মধ্যে ছিলেন।” (তারীখে বুখারী, আহমদ শরীফ, আলহাবী, ইত্তেহাফুচ্ছাদাত, তাযকিরাতুল মাউজুয়াত শরীফ, কানযুল উম্মাল শরীফ, দাইলামী শরীফ, ত্ববরানী শরীফ, আবু নঈম শরীফ, মিশকাত শরীফ, মিরকাত শরীফ ১১/৫৮)

পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

كنت نبيا وادم بين الـماء والطين

অর্থ: আমি তখনো নবী ছিলাম যখন হযরত আদম আলাইহিস সালাম তিনি পানি ও মাটিতে ছিলেন। (মিশকাত শরীফ, মিরকাত শরীফ ১১/৫৮)

পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

عن حضرت جابر رضى الله تعالى عنه قال قلت يا رسول الله بابى انت وامى اخبرنى عن اول شىء خلق الله تعالى قبل الاشياء قال يا جابر ان الله تعالى قد خلق قبل الاشياء نور نبيك

অর্থ: “হযরত জাবির রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে বললাম, ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবান হোক, আপনি আমাকে জানিয়ে দিন যে, মহান আল্লাহ পাক তিনি সর্বপ্রথম কোন জিনিস সৃষ্টি করেছেন? তিনি বললেন, হে হযরত জাবির রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু! নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক তিনি সবকিছুর পূর্বে আপনার নবী পাক, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নূর মুবারক সৃষ্টি করেছেন।”

প্রখ্যাত ও মশহূর তাফসীরকারক হযরত আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মশহূর ও বিখ্যাত “তাফসীরে রুহুল বয়ান শরীফ-এ” একখানা পবিত্র হাদীছ শরীফ উল্লেখ করেন-

عن حضرت ابى هريرة رضى الله تعالى عنه انه عليه الصلاة والسلام سال جبريل عليه السلام فقال يا جبريل كم عمرك من السنين فقال يا رسول الله صلى الله عليه وسلم لست اعلم غير ان فى الحجاب الرابع نجما يطلع فى كل سبعين الف سنة مرة رايته اثنين وسبعين الف مرة فقال يا جبريل عليه السلام وعزة ربى انا ذلك الكوكب.

অর্থ: “হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি একদিন কথা প্রসঙ্গে হযরত জিবরায়ীল আলাইহিস সালাম উনার বয়স মুবারক সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন, জবাবে হযরত জিবরায়ীল আলাইহিস সালাম তিনি বলেন, আমি শুধু এতটুকু জানি যে, মহান আল্লাহ পাক উনার হিজাবে আযমত উনার চতুর্থ হিজাব মুবারক-এ একটি নূরানী তারকা ৭০ হাজার বৎসর পরপর একবার উদয় হতো, আমি সে তারকাটি ৭২ হাজার বার উদয় হতে দেখেছি। তখন সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, মহান আল্লাহ পাক উনার কসম! আমিই সেই নূরানী তারকা।” অর্থাৎ ঐ তারকা মুবারকই হলেন নূরে হাবীবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি।

উপরোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার আলোচনা দ্বারা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হলো যে, মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন হুযুুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সমগ্র কায়িনাত সৃষ্টির পূর্বে নবী ও রসূল হিসাবে সৃষ্টি হয়েছেন। সুবহানাল্লাহ!

অর্থাৎ নূরে হাবীবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনিই মহান আল্লাহ পাক উনার নবী, রসূল ও হাবীব আর তিনিই মহান আল্লাহ পাক উনার সর্বপ্রথম সৃষ্টি।

তবে চল্লিশ বৎসর দুনিয়াবী বয়স মুবারক-এ আনুষ্ঠানিকভাবে নুবুওওয়াত ও রিসালত প্রকাশ করা হয়েছে বা তিনি যে মহান আল্লাহ পাক উনার নবী, রসূল ও হাবীব সেটা আনুষ্ঠানিকভাবে কুল কায়িনাতকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে।

মুহম্মদ যুফার আলী

ভোলাহাট

 

সুওয়াল: কেউ কেউ বলে থাকে যে, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার যিন্দিগী মুবারক দু’ভাগে বিভক্ত। ১. ব্যক্তিগত যিন্দিগী, ২. নুবুওওয়াতী যিন্দিগী। তাদের এ বক্তব্য কতটুকু সঠিক? দয়া করে জানাবেন।

জাওয়াব: মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সম্পর্কে তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

وما محمد الا رسول

অর্থ: “নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল ব্যতীত কিছু নন।” (পবিত্র সূরা আলে ইমরান শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ১৪৪)

তিনি আরো ইরশাদ মুবারক করেন-

وما ينطق عن الـهوى ان هو الا وحى يوحى

অর্থ: “হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ওহী ব্যতীত নিজের থেকে কোন কথা বলেননা।” (পবিত্র সূরা নজম শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ৩, ৪)

স্বয়ং নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

الا وانا حبيب الله

অর্থ: “সাবধান! আমি হলাম মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।” (তিরমিযী শরীফ, দারিমী শরীফ, মিশকাত শরীফ)

অর্থাৎ আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি মহান আল্লাহ পাক উনার নবী, রসূল ও হাবীব হিসেবেই সৃষ্টি হয়েছেন। আর তিনি পরিপূর্ণরূপে ওহী মুবারক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

কাজেই যিনি নবী, রসূল ও হাবীব হিসেবে সৃষ্টি হয়েছেন এবং উনার সম্পূর্ণ যিন্দিগী মুবারক ওহী মুবারক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাহলে উনার সম্পর্কে একথা কি করে বলা যেতে পারে যে, উনার ব্যক্তিগত যিন্দিগী রয়েছে? নাঊযুবিল্লাহ!

প্রকৃতপক্ষে উনার সম্পূর্ণ যিন্দিগী মুবারকই নুবুওওয়াতী, রিসালতী ও হাবীবী যিন্দিগী মুবারক। সুবহানাল্লাহ!

কোন নবী কিংবা রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের ব্যক্তিগত যিন্দিগী রয়েছে এ প্রকারের প্রশ্ন করা ও আক্বীদা পোষণ করা উভয়টিই কাট্টা কুফরীর অন্তর্ভুক্ত।

কারণ, হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের স্বপ্নও ওহী মুবারক উনার অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ উনারা ঘুমের মধ্যেও নবী-রসূল হিসেবেই থাকেন, ব্যক্তি হিসেবে নয়। আর সজাগ অবস্থায় অর্থাৎ চলা-ফেরা, উঠা-বসা, খাওয়া-দাওয়া, আলাপ-আলোচনা, ওয়ায-নছীহত ইত্যাদি সর্বাবস্থায় তো অবশ্যই উনারা নবী ও রসূল হিসেবে অবস্থান করেন। তাই সর্বাবস্থায়ই উনাদের প্রতি ওহী মুবারক নাযিল হয়েছে। এমনকি আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উম্মুল মু’মিনীন আলাইহিন্নাস সালাম উনাদের বিছানা মুবারক-এ থাকা অবস্থায়ও উনার প্রতি ওহী মুবারক নাযিল হয়েছে।

তাহলে এটা কি করে বলা যেতে পারে যে, নবী ও রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের ব্যক্তিগত যিন্দিগী মুবারক রয়েছে?

আরো উল্লেখ্য, যদি বলা হয় কোন হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের ব্যক্তিগত যিন্দিগী মুবারক রয়েছে, তাহলে এটা প্রমাণ করতে হবে যে, তিনি কখন নবী হিসেবে থাকেন আর কখন সাধারণ ব্যক্তি হিসেবে থাকেন? অর্থাৎ তিনি কত সময় ব্যাপী নবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আর কত সময়ব্যাপী ব্যক্তি হিসেবে ব্যক্তিগত দায়িত্ব পালন করেন? তা কস্মিনকালেও প্রমাণ করা সম্ভব নয়।

কারণ, আমরা পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, পবিত্র ইজমা ও পবিত্র ক্বিয়াস দ্বারা প্রমাণ পাই যে, হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালাম উনাদের প্রতি চব্বিশ ঘন্টাই ওহী মুবারক নাযিল হয়েছে। এমনকি স্বপ্নেও উনাদের প্রতি ওহী মুবারক নাযিল হতো ও হয়েছে। যার কারণে হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালাম উনাদের স্বপ্নও ওহী মুবারক উনার অন্তর্ভুক্ত। এর বহু প্রমাণ রয়েছে।

উদাহরণ স্বরূপ মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

قال يبنى انى ارى فى الـمنام انى اذبحك

অর্থ: “হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তিনি বলেন, হে আমার ছেলে (হযরত ঈসমাঈল আলাইহিস সালাম!) নিশ্চয়ই আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি আপনাকে যবেহ (কুরাবানী) করছি।” (পবিত্র সূরা ছফফাত শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ১০২)

অতঃপর হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম উনার ছেলে হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম উনাকে মিনা ওখানে নিয়ে শোয়ায়ে কুরবানী করার উদ্দেশ্যে গলা মুবারক-এ ছুরি চালাচ্ছিলেন। তখন মহান আল্লাহ পাক পুনরায় নাযিল করলেন-

قد صدقت الرؤيا.

অর্থ: “নিশ্চয়ই আপনি আপনার স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছেন।” (পবিত্র সূরা ছফফাত শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ১০৫)

অতএব, প্রমাণিত হলো যে, কোন হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালাম উনাদের ব্যক্তিগত যিন্দিগী বলতে কোন যিন্দিগীই ছিলনা। উনাদের সম্পূর্ণ যিন্দিগী মুবারকই ছিলো নুবুওওয়াতী ও রিসালতী যিন্দিগী মুবারক। সুতরাং ব্যক্তিগত যিন্দিগী ছিলো বলে মত পোষণ করা ও বিশ্বাস করা উভয়টিই কাট্টা কুফরীর অন্তর্ভুক্ত।

 

মুহম্মদ খইরুল ইসলাম, ঢাকা

মুহম্মদ আব্দুল্লাহ, সিলেট

মুহম্মদ আব্দুর রউফ, বগুড়া

সুওয়াল : মাসিক মদীনা সেপ্টেম্বর- ২০১২ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রশ্নোত্তর বিভাগে নিম্নোক্ত প্রশ্নোত্তর ছাপা হয়।

প্রশ্ন : আমাদের দেশে রবীউল আউয়াল মাসে বেশ ধুমধামে মীলাদ অনুষ্ঠান করা হয়। এখানে উপস্থিত থাকা যাবে কিনা?

উত্তর: প্রচলিত মীলাদ অনুষ্ঠানে বেশ কিছু বিষয় শরীয়তের পরিপন্থী হয় বিধায় উলামায়ে কিরাম প্রচলিত মীলাদ বিদআত বলেছেন।

আমাদের সুওয়াল হলো উক্ত প্রশ্ন ও উত্তর সঠিক হয়েছে কি? জানিয়ে বাধিত করবেন।

জাওয়াব : মাসিক মদীনা পত্রিকার উপারোক্ত প্রশ্ন ও উত্তর উভয়টিই কুফরী হয়েছে। কেননা মীলাদ শরীফ মাহফিলে উপস্থিত থাকাটা যেখানে রহমত, মাগফিরাত, নাজাত লাভের কারণ এবং সর্বোপরি নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার শাফায়াত ওয়াজিব হওয়ার কারণ সেখানে উক্ত মাহফিলে উপস্থিত থাকা যাবে কিনা এ প্রশ্ন করাটা যেমন কুফরী তদ্রুপ মীলাদ শরীফ মাহফিলকে বিদয়াত বলে উত্তর প্রদান করাটাও কুফরী।

‘মীলাদ’ শরীফ উনার লুগাতী বা আভিধানিক অর্থ হলো ‘জন্মের সময়।’ আর ইছতিলাহী বা ব্যবহারিক অর্থ হলো সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, রহমতুল্লিল আলামীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বিলাদত শরীফ উপলক্ষে ছানা-ছিফত করা ও উনার প্রতি ছলাত পাঠক করা এবং সালাম পেশ করা যা মহান আল্লাহ পাক উনার ও উনার হাবীব নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদেরই নির্দেশ মুবারক উনার অন্তর্ভুক্ত।

যেমন এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি ‘পবিত্র সূরা ফাত্হ’ শরীফ ৮, ৯নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন-

اِنَّا اَرْسَلْنٰكَ شَاهِدًا وَّمُبَشِّرًا وَّنَذِيرًا. لِّتُؤْمِنُوْا بِاللهِ وَرَسُولِه وَتُعَزِّرُوْهُ وَتُوَقِّرُوْهُ وَتُسَبِّحُوْهُ بُكْرَةً  وّ َاَصِيلا.

অর্থ: (হে আমার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম!) নিশ্চয়ই আমি আপনাকে সাক্ষী, সুসংবাদদাতা এবং সতর্ককারীরূপে পাঠিয়েছি যেন (হে মানুষ!) তোমরা মহান আল্লাহ তায়ালা উনার উপর এবং উনার রসূল, নূরে মুজসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উপর ঈমান আনো এবং তোমরা উনার মুবারক খিদমত করো ও উনার তা’যীম-তাকরীম মুবারক করো এবং উনার ছানা-ছিফত মুবারক করো সকাল-সন্ধ্যা অর্থাৎ দায়িমীভাবে। (পবিত্র সূরা ফাত্্হ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৮-৯)

এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি আরো ইরশাদ মুবারক করেন-

إِنَّ اللّٰهَ وَمَلائِكَتَهٗ يُصَلُّوْنَ عَلَى النَّبِىِّ يٰاَيُّهَا الَّذِينَ اٰمَنُوْا صَلُّوْا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا  تَسْلِيْمًا ۝

অর্থ: “নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক এবং উনার ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারা নূরে মুজাসসাম হাবীবূল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি ছলাত পাঠ করেন। হে মু’মিনগণ! আপনারাও উনার প্রতি ছলাত তথা দুরূদ শরীফ পাঠ করুন এবং সালাম দেয়ার মত সালাম দিন  অর্থাৎ আদবের সাথে তথা দাঁড়িয়ে সালাম পেশ করুন।” (পবিত্র সূরা আহযাব শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৫৬)

পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

عَنْ حضرت اِبْنِ مَسْعُوْدٍ رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اَوْلَى النَّاسِ بِىْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ  اَكْثَرُهُمْ عَلىَّ صَلٰوةً.

অর্থ: হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, “ঐ ব্যক্তিই ক্বিয়ামতের দিন আমার সবচেয়ে নিকটে থাকবে, যে ব্যক্তি আমার প্রতি অধিক পরিমাণে ছলাত পাঠ করবে।” (তিরমিযী শরীফ, মিশকাত শরীফ)

পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

عَنْ حضرت اِبْنِ مَسْعُوْدٍ رَضِىَ اللهُ تَعَالىٰ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اِنَّ لِلّهِ مَلٰئِكَةً سَيَّاحِيْنَ فِى الاَرْضِ يُبَلِّغُوْنِىْ مِنْ اُمَّتِىَ السَّلامَ.

অর্থ: হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, “মহান আল্লাহ পাক উনার কিছু সংখ্যক ফেরেশতা রয়েছেন, যারা পৃথিবীতে ভ্রমণ করে বেড়ান এবং আমার উম্মতের প্রদত্ব সালাম আমার নিকট পৌঁছে দেন।” (নাসায়ী শরীফ, সুনানুদ দারিমী শরীফ, মিশকাত শরীফ)

প্রমাণিত হলো যে, মীলাদ শরীফ পাঠ করা অর্থাৎ সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ছানা-ছিফত মুবারক করা ও উনার প্রতি ছলাত মুবারক পাঠ করা ও সালাম মুবাক পেশ করা পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদেরই মুবারক নির্দেশ বা আমল।

মূলত মীলাদ শরীফ  নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার যামানাতেই ছিল।

যেমন এ  প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

عَنْ حضرت اَبِى الدَّرْدَاءِ رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُ اَنَّهٗ مَرَّ مَعَ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اِلٰى بَيْتِ عَامِرِ الاَنْصَارِىِّ وَكَانَ يُعَلِّمُ وَقَائِعَ وِلادَتِهٖ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لاَبْنَائِهٖ وَعَشِيْرَتِهٖ وَيَقُوْلُ هٰذَا الْيَوْمَ هٰذَا الْيَوْمَ فَقَالَ عَلَيْهِ الصَّلٰوةُ وَالسَّلامُ اِنَّ اللهَ فَتَحَ لَكَ اَبْوَابَ الرَّحْمَةِ وَالْمَلائِكَةُ كُلُّهُمْ يَسْتَغْفِرُوْنَ لَكَ  مَنْ فَعَلَ فِعْلَكَ نَجٰى نَجٰتَكَ.

অর্থ: হযরত আবু দারদা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত আছে যে, একদা তিনি নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সাথে হযরত আমির আনছারী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার গৃহে উপস্থিত হয়ে দেখতে পেলেন যে, তিনি উনার সন্তানাদি এবং আত্মীয়-স্বজন, জ্ঞাতি-গোষ্ঠী, পাড়া-প্রতিবেশী উনাদেরকে নিয়ে আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বিলাদত শরীফ উনার ঘটনাসমূহ শুনাচ্ছেন এবং বলছেন, এই দিবস; এই দিবস অর্থাৎ এই দিবসে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যমীনে তাশরীফ এনেছেন এবং ইত্যাদি ইত্যাদি ঘটনা ঘটেছে। এতদশ্রবণে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, “নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ তায়ালা তিনি উনার রহমতের দরজা আপনার জন্য উম্মুক্ত করেছেন এবং সমস্ত হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম আপনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছেন এবং যে কেউ আপনার মত এরূপ কাজ করবে, সেও আপনার মত নাযাত (ফযীলত) লাভ করবে।” সুবহানাল্লাহ! (আত তানবীর ফী মাওলিদিল বাশীর ওয়ান নাযীর, মাওলূদুল কাবীর, দুররুল মুনাযযাম, সুবুলুল হুদা ফী মাওলিদিল মুস্তফা ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)

এ সম্পর্কে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

عَنْ حضرت اِبْنِ عَبَّاسٍ رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُمَا اَنَّهٗ كَانَ يُحَدِّثُ ذَاتَ يَوْمٍ فِىْ بَيْتِهٖ وَقَائِعَ وِلادَتِهٖ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِقَوْمٍ ، فَيَسْتَبْشِرُوْنَ وَيُحَمِّدُوْنَ اللهَ وَيُصَلُّوْنَ عَلَيْهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَاِذَا جَاءَ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ حَلَّتْ لَكُُمْ  شَفَاعَتِىْ.

অর্থ: হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি একদা উনার নিজগৃহে সমবেত হযরত ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমসহ মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বিলাদত শরীফ উনার ঘটনাসমূহ শুনাচ্ছিলেন। এতে শ্রবণকারীগণ আনন্দ ও খুশি প্রকাশ করছিলেন এবং মহান আল্লাহ পাক উনার প্রশংসা তথা তাসবীহ-তাহলীল পাঠ করছিলেন এবং নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উপর ছলাত-সালাম পাঠ ও পেশ করছিলেন। এমন সময় তিনি সেখানে উপস্থিত হলেন এবং (মীলাদ শরীফ অনুষ্ঠান দেখে) বললেন: “তোমাদের জন্য আমার শাফায়াত ওয়াজিব।” সুবহানাল্লাহ! (আত তানবীর ফী মাওলিদিল বাশীর ওয়ান নাযীর, মাওলূদুল কাবীর, দুররুল মুনাযযাম, সুবুলুল হুদা ফী মাওলিদিল মুস্তফা ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)

প্রতিভাত হলো, মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার যামানাতেই হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ উনারা মীলাদ শরীফ উনার মাহফিল করেছেন এবং উক্ত মাহফিলে স্বয়ং নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উপস্থিত হয়ে মীলাদ শরীফ পাঠকারীগণ উনাদেরকে রহমত, মাগফিরাত, নাযাত ও শাফায়াত লাভের সুসংবাদ দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, ক্বিয়ামত পর্যন্ত যারা মীলাদ শরীফ পাঠ করবে তাদের জন্যও একই সুসংবাদ প্রদান করেছেন। যার কারণে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বিছাল শরীফ উনার পর হযরত খুলাফায়ে রাশিদীন উনাদের প্রথম চার খলীফা আলাইহিমুস সালাম উনারা উনাদের খিলাফতকালে মীলাদ শরীফ পাঠের ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেছেন।

যেমন এ প্রসঙ্গে বিশ্বখ্যাত ইমাম, মুহাদ্দিছ, মুফাসসির হযরতুল আল্লামা আহমদ শিহাবুদ্দীন হাইতামী (হাইছামী) রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার লিখিত বিশ্ব সমাদৃত, সর্বজন স্বীকৃত ও সুপ্রসিদ্ধ মীলাদ শরীফ উনার কিতাব “আন নি’মাতুল কুবরা আলাল আলাম ফী মাওলিদি সাইয়্যিদি উলদি আদম” উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে-

قَالَ حضرت اَبُوْ بَكْرِنِ الصِّدِِّيْقِ عليه السلام مَنْ اَنْفَقَ دِرْهَمًا عَلٰى قِرَائَةِ  مَوْلِدِ النَّبِىِّ صَلّٰى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ رَفِيْقِىْ  فِىْ الْجَنَّةِ.

অর্থ: হযরত আবু বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মীলাদ শরীফ পাঠ উপলক্ষে এক দিরহাম ব্যয় করবে, সে জান্নাতে আমার বন্ধু হবে।” সুবহানাল্লাহ!

وَقَالَ حضرت عُمَرُ عليه السلام  مَنْ عَظَّمَ مَوْلِدَ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ  عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَدْ  اَحْيَا الاِسْلامَ.

অর্থ: হযরত উমর ফারূক্ব আলাইহিস সালাম তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মীলাদ শরীফ উনাকে বিশেষ মর্যাদা দিল, সে মূলত দ্বীন ইসলাম উনাকেই পুনরুজ্জীবিত করলো।” সুবহানাল্লাহ!

وَقَالَ حضرت عُثْمَانُ عليه السلام مَنْ اَنْفَقَ  دِرْهَمًا عَلٰى قِرَائَةِ مَوْلِدِ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَكَاََنَّمَا شَهِدَ  غَزْوَةَ  بَدْرٍ وَحُنَيْنٍ.

অর্থ: হযরত উছমান যুন নূরাইন আলাইহিস সালাম তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মীলাদ শরীফ পাঠ উপলক্ষে এক দিরহাম খরচ করল, সে যেন বদর ও হুনাইন যুদ্ধে শরীক থাকলো।” সুবহানাল্লাহ!

وَقَالَ حضرت عَلِىٌّ كرم الله وجهه عليه السلام ٗمَنْ عَظَّمَ مَوْلِدَ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَكَانَ سَبَبًا لِِّقِرَائَتِهٖ لايَخْرُجُ مِنَ الدُّنْيَا اِلا بِالاِيْمَانِ وَيَدْخُلُ الْجَنَّةَ بِغَيْرِ حِسَابٍ.

অর্থ: হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহূ আলাইহিস সালাম তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মীলাদ শরীফ উপলক্ষে পঠিত মাহফিলকে বিশেষ মর্যাদা প্রদান করলো, সে ব্যক্তি অবশ্যই ঈমান নিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিবে এবং বিনা হিসেবে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” সুবহানাল্লাহ!

অতএব, যারা বলে যে, হযরত খুলাফায়ে রাশিদীন তথা হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ উনাদের যামানায় মীলাদ শরীফ উনার কোনরূপ অস্তিত্ব ছিল না, তাদের সে কথা সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা এবং তা হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ উনাদের প্রতি মিথ্যারোপের কারণে কাট্টা কুফরী।

হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ উনাদের পরবর্তী তাবিয়ীনগণ উনাদের যুগে এবং তৎপরবর্তী প্রত্যেক যুগেই অনুসরণীয় ইমাম-মুজতাহিদ ও আওলিয়ায়ে কিরামগণ উনারা মীলাদ শরীফ পাঠের ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছেন।

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট তাবিয়ী হযরত হাসান বছরী রহমতুল্লাহি আলাইহি: যিনি শতাধিক হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের সাক্ষাত পেয়েছিলেন। যিনি চতুর্থ খলীফা হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহূ আলাইহিস সালাম উনার মুরীদ, খলীফা ও ছাত্র ছিলেন তিনি বলেন-

وَدِدْتُّ لَوْ كَانَ لِىْ مِثْلُ جَبَلِ اُحُدٍ ذَهْبًا فَاَنْفَقْتُهٗ عَلٰى قِرَاءَةِ مَوْلِدِ النَّبِىِّ صَلّٰى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ.

অর্থ: “আমার একান্ত ইচ্ছা হয় যে, আমার যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ থাকতো তাহলে আমি তা নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মীলাদ শরীফ পাঠ উপলক্ষে ব্যয় করতাম।” সুবহানাল্লাহ! (আন নি’মাতুল কুবরা আলাল আলাম ফী মাওলিদি সাইয়্যিদি উলদি আদম)

শাফিয়ী মাযহাব উনার ইমাম হযরত ইমাম শাফিয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বর্ণনা করেন-

قَالَ اَلاِمَامُ الشَّافِعِىُّ رَحِمَهُ اللهُ مَنْ جَمَعَ لِمَوْلِدِ النَّبِىِّ صَلّٰى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ اِخْوَانًا وَهَيَّاَ طَعَامًا وَاَخْلٰى مَكَانًا وَعَمَلَ اِحْسَانًا وَصَارَ سَبَبًا لِقِرَائَتِهٖ بَعَثَهُ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مَعَ الصِّدِّيْقِيْنَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِيْنَ وَيَكُوْنُ فِىْ جَنَّاتِ النَّعِيْمِ.

অর্থ: হযরত ইমাম শাফিয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মীলাদ শরীফ উপলক্ষে লোকজন একত্রিত করলো এবং খাদ্য তৈরি করলো ও জায়গা নির্দিষ্ট করলো এবং উত্তমভাবে আমল করলো, উক্ত ব্যক্তিকে মহান আল্লাহ পাক তিনি হাশরের দিন ছিদ্দীক্ব, শহীদ, ছালিহীনগণ উনাদের সাথে উঠাবেন এবং তাঁর ঠিকানা হবে জান্নাতুল নায়ীমে।” সুবহানাল্লাহ! (আন নি’মাতুল কুবরা আলাল আলাম ফী মাওলিদি সাইয়্যিদি উলদি আদম)

মহান আল্লাহ পাক উনার খালিছ ওলী হযরত ইমাম সাররী সাক্বতী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন-

مَنْ قَصَدَ مَوْضعًا يُقْرَأُ فِيْهِ مَوْلِِدُ النَّبِىِّ صَلّٰى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَدْ قَصَدَ رَوْضَةً مِنْ رِيَاضِ الْجَنَّةِ لاَنَّهٗ مَا قَصَدَ ذٰلِكَ الْمَوْضعَ اِلا لِمُحَبَّةِ النَّبِىِّ صَلّٰى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ.

অর্থ: “যে ব্যক্তি মীলাদ শরীফ পাঠ বা মীলাদুন নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উদযাপন করার জন্য স্থান নির্দিষ্ট করল, সে যেন তাঁর জন্য জান্নাতে রওযা বা বাগান নির্দিষ্ট করলো। কেননা সে তা নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মুহব্বতের জন্যেই করেছে।”

নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন-

مَنْ اَحَبَّنِىْ كَانَ مَعِىَ فِى الْجَنَّةِ.

অর্থ: “যে ব্যক্তি আমাকে মুহব্বত করবে সে আমার সাথেই জান্নাতে থাকবে।” (তিরমিযী শরীফ, মিশকাত শরীফ)

সাইয়্যিদুত ত্বায়িফা হযরত জুনাইদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন-

مَنْ حَضَرَ مَوْلِدَ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَعَظَّمَ قَدَرَهٗ فَقَدْ فَازَ بِالاِيْمَانِ.

অর্থ: “যে ব্যক্তি মীলাদুন নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আয়োজনে উপস্থিত হল এবং উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করলো। সে তাঁর ঈমানের দ্বারা সাফল্য লাভ করবে অর্থাৎ সে বেহেশতী হবে।” সুবহানাল্লাহ!

বিশ্বখ্যাত আলিমে দ্বীন হযরত ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন-

مَا مِنْ شَخْصٍ قَرَاَ  مَوْلِدَ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلٰى مِلْحٍ اَوْ بُرٍّ اَوْشَىء اٰخَرَ مِنَ الْمَأكُوْلاتِ اِلا ظَهَرَتْ فِيْهِ الْبَركَةُ فِىْ كُلِّ شَىء.

অর্থ: “যে ব্যক্তি মীলাদ শরীফ পাঠ করে বা মীলাদুন নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উদযাপন করে লবণ, গম বা অন্য কোন খাদ্যদ্রব্যের উপর ফুঁক দেয়, উক্ত খাদ্যদ্রব্যে অবশ্যই বরকত প্রকাশ পাবে। এভাবে যে কোন কিছুর উপরই পাঠ করুক না কেন।” (তাতে বরকত হবেই)। সুবহানাল্লাহ!

মুসলমানদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে বেশি কিতাব লিখেছেন যিনি দশম হিজরী শতাব্দীর মুজাদ্দিদ ও ইমাম হযরত ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন-

مَا مِنْ مُسْلِمٍ قَرَاََ فِىْ بَيْتِهٖ مَوْلِدَ النَّبِىِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اِلا رَفَعَ اللهُ سُبْحَانَهٗ وَتَعَالٰى اَلْقَحَطَ وَالْوَبَاءَ وَالْحَرْقَ وَالْغَرَقَ وَالاَفَاتِ وَالْبَلِيَّاتِ وَالْبَغْضَ وَالْحَسَدَ وَعَيْنَ السُّوْءِ وَاللُّصُوْصِ عَنْ اَهْلِ ذٰلِكَ الْبَيْتِ فَاِذَا مَاتَ هَوَّنَ اللهُ عَلَيْهِ جَوَابَ مُنْكِرٍ وَنَكِيْرٍ وَيَكُوْنُ فِىْ مَقْعَدِ صِدْقٍ عِنْدَ مَلِيْكٍ مُّقْتَدِرٍ.

অর্থ: “যখন  কোন মুসলমান নিজ বাড়িতে মীলাদ শরীফ পাঠ করে তখন সেই বাড়ির অধিবাসীগণের উপর থেকে মহান আল্লাহ পাক তিনি অবশ্যই খাদ্যাভাব, মহামারি, অগ্নিকা-, ডুবে মরা, বালা-মুছিবত, হিংসা-বিদ্বেষ, কু-দৃষ্টি, চুরি ইত্যাদি উঠিয়ে নেন। যখন উক্ত ব্যক্তি মারা যান তখন মহান আল্লাহ পাক তিনি তাঁর জন্য মুনকার-নাকীরের সুওয়াল-জাওয়াব সহজ করে দেন। আর তাঁর অবস্থান হয় মহান আল্লাহ পাক উনার সান্নিধানে ছিদক্বের মাক্বামে।” সুবহানাল্লাহ!

এই উপমহাদেশে যিনি হাদীছ শরীফ শাস্ত্রের সর্বপ্রথম প্রচার-প্রসার করেছেন, ইমামুল মুফাসসিরীন ওয়াল মুহাদ্দিছীন ওয়াল ফুক্বাহা হযরত শায়েখ আব্দুল হক মুহাদ্দিছ দেহলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন-

مَنْ عَظَّمَ لَيْلَةَ مَوْلِدِهٖ بِمَاۤ اَمْكَنَهٗ مِنَ التَّعْظِيْمِ وَالاِكْرَامِ كَانَ مِنَ الْفَائزِيْنَ بِدَارِ السَّلامِ.

অর্থ: “যে ব্যক্তি নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বিলাদত শরীফ দিবসকে তা’যীম করবে এবং সে উপলক্ষে  খুশি প্রকাশ করবে সে চির শান্তিময় জান্নাতের অধিকারী হবে।” সুবহানাল্লাহ!

উল্লেখ্য, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যখন হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ উনাদের মজলিসে উপস্থিত হতেন তখন উনার সম্মানার্থে উনারা ‘ক্বিয়াম’ করতেন। যেমন এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ আছে-

عن حضرت محمد بن هلال رحمه الله تعالى عن ابيه ان النبى صلى الله عليه وسلم كان اذا خرج قمنا له حتى يدخل بيته اخرجه البزار ورجاله ثقات.

অর্থ: হযরত মুহম্মদ বিন হিলাল রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি স্বীয় পিতা উনার থেকে বর্ণনা করেন যে, “সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যখন ঘর মুবারক হতে বের হতেন তখন আমরা দাঁড়িয়ে যেতাম এবং যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি উনার ঘরে প্রবেশ না করতেন (আমরা দাঁড়িয়ে থাকতাম)।” এ হাদীছ শরীফখানা বাযযার বর্ণনা করেছেন, যার রাবী অত্যন্ত শক্তিশালী। (বাযযার শরীফ, মাজমাউল যাওয়ায়িদ শরীফ, ফিক্বহুস সুনানে ওয়াল আছার শরীফ)

এখন কেউ  প্রশ্ন করতে পারে যে, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ উনারা নূরে মুজাসসাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি স্বশরীর মুবারকে উপস্থিত হওয়ার কারণে উনার সম্মানার্থে ক্বিয়াম করেছেন। কিন্তু বর্তমানে মীলাদ শরীফ উনার সকল মজলিসেই কি তিনি উপস্থিত হন? যদি উপস্থিত না হন তবে ক্বিয়াম করা হয় কেন?

এর জবাবে বলতে হয় যে, মূলত মীলাদ শরীফ-এ যে ক্বিয়াম করা হয় তা আদব, শরাফত ও তা’যীম বা সম্মানার্থেই করা হয়। অর্থাৎ আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি সালাম পেশ করার সময় ক্বিয়াম করা বা দাঁড়িয়ে ‘সালাম’ দেয়াই সুন্নত ও আদব। চাই হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উপস্থিত থাকুন, আর অনুপস্থিত থাকুন। সর্বাবস্থায় দাঁড়িয়ে সালাম দেয়াই সুন্নত, আদব, শরাফত ও ভদ্রতা।

যেমন এ প্রসঙ্গে বিশ্বখ্যাত মুহাদ্দিছ হযরত ক্বাজী আয়ায রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি উনার সুপ্রসিদ্ধ কিতাব ‘শিফা শরীফ’-এ বর্ণনা করেছেন-

ان حرمة النبى صلى الله عليه وسلم بعد موته وتوقيره وتعظيمه لازم كما حال حياته وذلك عند ذكره صلى الله عليه وسلم ذكر حديث وسنة وسماع اسمه وسيرته ومعاملة اله وعترته.

অর্থ: “নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বিছাল শরীফ উনার পর উনার ইজ্জত, সম্মান, মর্যাদা ঠিক তেমনভাবে কর্তব্য হবে; যেমন উনার যমীনে অবস্থানকালে কর্তব্য ছিল এবং তা করতে হবে উনার ছানা-ছিফতকালে, পবিত্র হাদীছ শরীফ, সুন্নাহ শরীফ, নাম মুবারক, জীবনী মুবারক আলোচনাকালে এবং উনার পরিবারের অর্থাৎ আহাল ও ইয়ালগণ উনাদের আচার-ব্যবহার আলোচনার সময়ে।” (শিফা শরীফ, ২য় খ-, পৃষ্ঠা ৪০)

অতএব, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার তা’যীম-তাকরীম পৃথিবীতে থাকাকালে যেমন ছিল তেমনি উনার বিছাল শরীফ উনার পরও থাকবে। এ জন্যে হযরত ক্বাজী আয়ায রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার কিতাবে হযরত আবু ইবরাহীম রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বক্তব্যকে উল্লেখ করে লিখেন-

واجب على كل مؤمن متى ذكره او ذكر عنده ان يخضع ويخشع ويتوقر ويكن من حركته ويأخذ به نفسه لوكان بين يديه ويتادب ادبنا الله به.

অর্থ: “প্রত্যেক মু’মিনের জন্যে ওয়াজিব হল যে, যখনই সে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ছানা-ছিফত মুবারক করবে বা তার নিকট বা তার উপস্থিতিতে অথবা তার অনুপস্থিতিতে আলোচনা মুবারক করা হবে, যেন অত্যন্ত বিনয়ী হয়ে যায় এবং নড়া-চড়া বন্ধ করে ভাবমুগ্ধ অবস্থায় চূড়ান্ত আদব সহকারে এমনভাবে সম্মান প্রদর্শন করে যেমন নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি স্বশরীর মুবারকে তার সম্মুখে উপস্থিত হলে করতো এবং নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সম্মুখে যেমন আদব করার নির্দেশ মহান আল্লাহ পাক তিনি আমাদেরকে প্রদান করেছেন। ঠিক তেমনিভাবে আদব প্রদর্শন করতে হবে।” (শিফা শরীফ, ২য় খ-, পৃষ্ঠা ৪০)

এ প্রসঙ্গে আশিকে রসূল, হযরতুল আল্লামা শাহ আব্দুল হক ইলাহাবাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি তদীয় “দুররুল মুনাজ্জাম” কিতাবে লিখেন-

ان القيام عند وضعه صلى الله عليه وسلم لتعظيم النبى صلى الله عليه وسلم

অর্থ : “সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বরকতময় বিলাদত শরীফ আলোচনার সময় উনার সম্মানার্থে বা তা’যীম-তাকরীমের জন্যেই ক্বিয়াম শরীফ করা হয়।”

মাওলানা আশরাফ আলী থানবীসহ সকল উলামায়ে দেওবন্দের পীর ও মুর্শিদ, শায়খে আরব ওয়াল আযম হযরতুল আল্লামা হাজী ইমদাদুল্লাহ্ মুহাজিরে মক্কী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার “হাফতে মাসায়িল”  কিতাবে উল্লেখ করেন যে-

مولود شریف کو ذریعۃ برکات سمجھ کر ہر سال منعقد کرتا ہوں اور قیام کے وقت ہے حد لطف ولذت پاتا ہوں

অর্থ : “মীলাদ শরীফের মাহফিলকে বরকত লাভের উসীলা মনে করে আমি প্রতি বৎসর মীলাদ শরীফ উনার মজলিস করি এবং মীলাদ শরীফ মাহফিলে ক্বিয়াম করার সময় আমি অশেষ আনন্দ ও স্বাদ উপভোগ করি।”

তাছাড়া বড় কাটরা ও লালবাগ মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা, মুজাহিদে আ’যম, খাদিমুল ইসলাম, হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী ক্বিয়াম শরীফ সম্পর্কে উনার “তাসাউফ তত্ত্ব” কিতাবে লিখেন যে, “পবিত্র মীলাদ শরীফ উনার মধ্যে ক্বিয়াম শরীফ করা আদব, শরাফত বা ভদ্রতা।”

অতএব, প্রমাণিত হলো পবিত্র মীলাদ শরীফ উনার আমল পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, পবিত্র ইজমা ও ক্বিয়াস সম্মত অর্থাৎ শরীয়ত ও সুন্নাহ সম্মত। উক্ত আমলকে কোন মুসলমান বিদআত বলতে পারে না। যারা বলবে তারা কেউই মুসলমানের অন্তর্ভুক্ত নয়।

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ