সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ

সংখ্যা: ১৯৭তম সংখ্যা | বিভাগ:

খন্দকার সেলিম আহমদ

পাহাড় কাঞ্চনপুর, টাঙ্গাইল

 

সুওয়াল: হাটহাজারী মাদরাসা থেকে প্রকাশিত অখ্যাত মাসিক পত্রিকা ফেব্রুয়ারী-২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় জিজ্ঞাসা-সমাধান বিভাগে, মাসিক আল বাইয়্যিনাত-অক্টোবর ২০০৩ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রদত্ত “মীলাদ-ক্বিয়াম” সম্পর্কিত বক্তব্যের সমালোচনা করতে গিয়ে  এবং একই বিষয়ে এপ্রিল-২০০৫ ঈসায়ী ও মে-২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় এছাড়াও মাসিক মদীনা পত্রিকা ফেব্রুয়ারী-২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রশ্নোত্তর বিভাগে একই ধরনের জাওয়াব দেয়া হয়েছে।

তাদের বক্তব্যগুলোর মধ্যে যে বিষয়গুলো আমার নিকট সন্দেহজনক তা নিম্নে উল্লেখ করা হলো-

যেমন, মে-২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় জিজ্ঞাসা-সমাধান বিভাগে বলা হয়েছে, “সমাজে বহুল প্রচলিত যে মীলাদ দেখা যায়, তা সম্পূর্ণ কুরআন সুন্নাহর খিলাফ, যা কোন দিন ভালো কাজ হতে পারে না।” …

এখন আমাদের সুওয়াল হলো, সমাজে বহুল প্রচলিত যে মীলাদ শরীফ দেখা যায়, সে সম্পর্কে তাদের উল্লিখিত বক্তব্য কতটুকু দলীলসম্মত? কুরআন শরীফ, সুন্নাহ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াসের দৃষ্টিতে দলীলভিত্তিক জাওয়াব দিয়ে আমাদের আক্বীদা, আমল হিফাযতে সহায়তা করবেন বলে আমরা আশাবাদী।

জাওয়াব: সমাজে বহুল প্রচলিত মীলাদ শরীফ ও ক্বিয়াম শরীফ সম্পর্কে হাটহাজারী মাদরাসার অখ্যাত মাসিক পত্রিকার জিজ্ঞাসার সমাধানে এবং অপর একটি পত্রিকার প্রশ্নোত্তর বিভাগে যা বলা হয়েছে তা শুদ্ধ তো হয়ইনি, বরং সম্পূর্ণই মিথ্যা, ভুল, মনগড়া ও দলীলবিহীন এবং অনুসরণীয় ইমাম-মুজতাহিদ ও ফক্বীহগণের সর্বজনমান্য ও স্বীকৃত বিশ্ব বিখ্যাত ফিক্বাহ ও ফতওয়ার কিতাবসমূহের বক্তব্যের বিপরীত ও বিরুদ্ধমত। যা ইতঃপূর্বে আমাদের “মাসিক আল বাইয়্যিনাত শরীফ”-এর অনেক সংখ্যায় খ-ন করে সঠিক ও দলীলভিত্তিক জাওয়াব দেয়া হয়েছে। আর “মাসিক আল বাইয়্যিনাত শীরফ”-এর জাওয়াবকে খ-ন করা হাটহাজারী মৌলভী ছাহেবদের পক্ষে আদৌ সম্ভব হয়নি, হবেও না ইনশাআল্লাহ।

এরপরেও হাটহাজারীর মৌলভী ছাহেব এবং তাদের সকল সমজাতীয়রা বার বার ‘মীলাদ শরীফ ও ক্বিয়াম শরীফ’ সম্পর্কে বিনা তাহক্বীকে ও বিনা দলীলে উক্ত ভুলেরই পুনরাবৃত্তি করে যাচ্ছে।

(ধারাবাহিক)

যেমন, উল্লিখিত প্রথম বক্তব্যের প্রথমেই তারা বলেছে, “সমাজে বহুল প্রচলিত যে মীলাদ দেখা যায়  তা সম্পূর্ণ কুরআন সুন্নাহর খিলাফ, যা কোন দিন ভালো কাজ হতে পারে না।” নাউযুবিল্লাহ।

এর জাওয়াবে বলতে হয় যে, কুরআন শরীফ-এর কোন আয়াত শরীফ-এ ‘সমাজে বহুল প্রচলিত মীলাদ শরীফকে কুরআন শরীফ-এর খিলাফ বলা হয়েছে এবং হাদীছ শরীফ-এর কোন হাদীছ শরীফ-এ ‘সমাজে বহুল প্রচলিত মীলাদ শরীফকে সুন্নাহ বা হাদীছ শরীফ-এর খিলাফ বলা হয়েছে, তা হাটহাজারী মৌলভী ছাহেবরা কুরআন শরীফ-এর আয়াত শরীফ, হাদীছ শরীফ-এর ইবারতসহ দলীল উল্লেখ করেনি। সুতরাং তাদের দলীলবিহীন, ইবারতবিহীন, মনগড়া ও মিথ্যা বক্তব্য মোটেই গ্রহনযোগ্য নয়।

নি¤েœ কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস এবং বুযুর্গদের আমল দ্বারা প্রমাণিত বিস্তারিত দলীল-আদিল্লাহ পেশ করা হলো-

স্মরণীয় যে, মীলাদ শরীফ ও ক্বিয়াম শরীফ-এর মূল উদ্দেশ্য হলো সংক্ষেপে আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার ছানা-ছিফত ও বিলাদত শরীফ সম্পর্কে আলোচনা করা এবং হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার প্রতি ছলাত-সালাম পাঠ করা।

এক কথায় মীলাদ শরীফ ও ক্বিয়াম শরীফ-বলতে কুরআন শরীফ তিলাওয়াত ও আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার ছানা-ছিফত, তা’রীফ, প্রশংসা, উনার মু’জিযা বর্ণনা, বিলাদত শরীফ-এর আলোচনা, না’ত, শে’র, কাছীদা শরীফ পাঠ ও উনার প্রতি ছলাত ও সালাম  প্রেরণ করা ইত্যাদি পাঠ করা হয়।

যেমন- মীলাদ শরীফ-এর প্রথমেই কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করা হয়।

অতঃপর সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার উপর ছলাত পাঠ করা হয়। কারণ ছলাত পাঠ করা আল্লাহ পাক ও উনার রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনাদেরই নির্দেশ।

তাছাড়া আমরা যেভাবে মজলিস করে মীলাদ শরীফ-এর মাহফিল করে থাকি তা খোদ আল্লাহ পাক-উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের যামানাতেই ছিল।

এছাড়াও হযরত খুলাফায়ে রাশিদীন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের থেকেও “মীলাদ শরীফ”-এর প্রমান রয়েছে। শুধু তাই নয়, হযরত খুলাফায়ে রাশিদীন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা স্বয়ং নিজেরাই “মীলাদ শরীফ”-এর তাকীদ করেছেন ও ফযীলত বর্ণনা করেছেন।

যেমন- এ প্রসঙ্গে বিশ্ব সমাদৃত ও সুপ্রসিদ্ধ “আন নি’মাতুল কুবরা আলাল আলাম” কিতাবে বর্ণিত রয়েছে-

قال ابو بكر الصديق رضى الله تعالى عنه من انفق درهما على قراءة  مولد النبى صلى الله عليه وسلم كان رفيقى  فى الجنة.

অর্থ: (“নবীদের পরে শ্রেষ্ঠ মানুষ) হযরত আবু বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার মীলাদ শরীফ পাঠ উপলক্ষ্যে এক দিরহাম ব্যয় করবে সে জান্নাতে আমার বন্ধু হয়ে থাকবে। সুবহানাল্লাহ!

قال عمر الفاروق رضى الله تعالى عنه من عظم مولد النبى صلى الله  عليه  وسلم فقد احيا الاسلام.

অর্থ: “হযরত উমর ফারূক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, যে ব্যক্তি হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার মীলাদ শরীফকে বিশেষ মর্যাদা দিল সে মূলতঃ ইসলামকেই পুনরুজ্জীবিত করলো।” সুবহানাল্লাহ!

قال عثمان ذو النورين رضى الله تعالى عنه  من انفق درهما على قراءة مولد النبى صلى الله عليه وسلم فكأنما شهد  غزوة  بدر وحنين.

অর্থ: “হযরত উছমান যুননূরাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, যে ব্যক্তি হাবীবুল্লাহ হুযূর ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার মীলাদ শরীফ পাঠ উপলক্ষে এক দিরহাম খরচ করল সে যেন বদর ও হুনাইন যুদ্ধে শরীক থাকলো।“ সুবহানাল্লাহ!

قال على كرم الله وجهه رضى الله تعالى عنه من عظم مولد النبى صلى الله عليه وسلم وكان سببا لقرائته لايخرج من الدنيا الا بالايمان ويدخل الجنة بغير حساب.

অর্থঃ “হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজহাহু রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, যে ব্যক্তি হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার মীলাদ শরীফ পাঠের কারণে বিশেষ মর্যাদা প্রদান করলো সে ব্যক্তি অবশ্যই ঈমান নিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিবে এবং বিনা হিসেবে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (সুবহানাল্লাহ।)

অতএব, উল্লিখিত বর্ণনা থেকে সুস্পষ্ট হলো যে, মীলাদ শরীফ ও ক্বিয়াম শরীফ শুধু ইজমা, ক্বিয়াস ও বুযুর্গদের আমল দ্বারাই প্রমাণিত নয় বরং মীলাদ শরীফ ও ক্বিয়াম শরীফ উভয়টি কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ দ্বারাই প্রমাণিত। আর কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ দ্বারা প্রমাণিত কোন বিষয়কে নাজায়িয বলা প্রকাশ্য কুফরী। মুসলমান হয়ে যারা কুফরী করে শরীয়তের দৃষ্টিতে তারা মুরতাদ ও কাফির।

 

মুহম্মদ হুসাইন

নরসিংদী

সুওয়াল: মাসিক মদীনা নভেম্বর-২০০৯ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রশ্নোত্তর বিভাগে নি¤েœাক্ত প্রশ্নোত্তর ছাপা হয়-

প্রশ্ন: মুসলমানগণ যে টুপি মাথায় পরেন তার আকৃতি সম্পর্কে যেমন গোল হওয়া চাই, না কিসতির মত লম্বা হওয়া চাই স্পষ্ট হাদীছ শরীফ আছে কিনা? হাদীছ শরীফ-এর নাম উল্লেখ করে জানাবেন আশা করি।

উত্তর: টুপি পরা সুন্নত। হযরত নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম টুপি পরেছেন এবং পাগড়ী পরার সময় পাগড়ীর নিচে টুপি পরতে তাগিদ দিয়েছেন। টুপি এবং পোশাক-পরিচ্ছদের ব্যাপারে তাই সুন্নত বলে স্বীকৃত যা সমকালীন নির্ভরযোগ্য ওলামা-মাশায়িখগণের মধ্যে সাধারণভাবে প্রচলিত। হাদীছ শরীফ-এ (শামায়িলে-তিরমিযী) বলা হয়েছে, হযরত নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মাথার টুপি ছিল চেপ্টা, যা মাথার সাথে লেগে থাকতো। সেই টুপির অনুকরণে ছাহাবীগণ এবং পরবর্তী যুগের ওলামা-মাশায়িখগণ কাপড়ের দ্বারা নির্মিত টুপি তৈরি করেছেন। কারো টুপি গোল ছিল, কারো টুপি কিসতি আকৃতির ছিল, কারো টুপি পাঁচ কল্লি বা তিন কল্লির ছিল। এইসব ধরনের টুপি যেহেতু ওলামা-মাশায়িখগণের মধ্যে প্রচলিত ছিল এবং এ যুগেও রয়েছে। সুতরাং এসব ধরনের টুপিই সুন্নত অনুযায়ী মনে করে পরা যেতে পারে। অনুসরণযোগ্য ওলামাগণের পছন্দনীয় পোশাকাদি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করা অভিপ্রেত নয়।

মাসিক মদীনা পত্রিকার উক্ত প্রশ্নের উত্তরে যে বিষয়গুলো আমার কাছে আপত্তিকর মনে হয়, তাহলো-

১. আল্লাহ পাক-উনার রসূল, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে টুপি ও পোশাক-পরিচ্ছদের ব্যাপারে কোন সুন্নতের বর্ণনা নেই।

২. টুপি ও পোশাক-পরিচ্ছদের ব্যাপারে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমদেরকে বাদ দিয়ে সমকালীন আলিমদেরকে অনুসরণ করতে হবে।

৩. শামায়িলে তিরমিযী-এর বরাতে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার নামে মিথ্যারোপ করা হয়েছে।

৪. হাদীছ শরীফ-এ বর্ণিত ‘কুম্মাতুন (كمة) ও বুতহুন (بطح) শব্দের মনগড়া অর্থ ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

৫. হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারাও কিসতি, পাঁচ কল্লি, তিন কল্লি টুপি পরিধান করেছেন।

৬. সমকালীন আলিমগণের মধ্যে কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী আমল জারি থাকলেও সেটাই অনুসরণ করতে হবে। বিরোধিতা করা যাবেনা।

উপরোক্ত প্রতিটি বিষয়ের শরীয়তসম্মত জাওয়াব দিয়ে আমাদের ঈমান-আমল হিফাযতে সহায়তা করবেন বলে আমরা আশাবাদী।

জাওয়াব: মাসিক মদীনায় প্রদত্ত টুপি সম্পর্কিত প্রশ্ন-উত্তরের প্রেক্ষিতে আপনার পঞ্চম সুওয়াল হচ্ছে-

৫. হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারাও কিসতি, পাঁচ কল্লি, তিন কল্লি টুপি পরিধান করেছেন। নাঊযুবিল্লাহ!

এর জবাবে বলতে হয় যে, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের মুবারক টুপি সম্পর্কিত মাসিক মদীনার সম্পাদক মাহিউদ্দীনের উক্ত বক্তব্য ভুল, দলীলবিহীন, ডাহা মিথ্যা।

শুধু তাই নয় তার উক্ত বক্তব্য সরাসরি হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের প্রতি সুস্পষ্ট মিথ্যারোপের শামিল। যা কাট্টা কুফরীর অন্তর্ভুক্ত। কারণ হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা কখনো কিসতি, পাঁচ কল্লি, তিন কল্লি টুপি পরিধান করেননি।

দ্বিতীয়ত: মাসিক মদীনার সম্পাদক মাহিউদ্দীন সাহেব যদি সত্যবাদীই হয়ে থাকে তবে পরবর্তী সংখ্যায় প্রমাণ পেশ করুক কোন কিতাবের কত পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারাও কিসতি, পাঁচ কল্লি, তিন কল্লি টুপি পরিধান করেছেন। কিন্তু মাসিক মদীনার সম্পাদক মাহিউদ্দীন সাহেবের পক্ষে তা কস্মিনকালেও সম্ভব হবে না।

সুতরাং আবারো প্রমাণিত হলো যে, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের মুবারক টুপি সম্পর্কিত মাসিক মদীনার সম্পাদক মাহিউদ্দীনের উক্ত বক্তব্য হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের প্রতি সুস্পষ্ট মিথ্যারোপের শামিল। যা কাট্টা কুফরীর অন্তর্ভুক্ত ও জাহান্নামী হওয়ার কারণ।

নি¤েœ কিসতি, পাঁচ কল্লি, তিন কল্লি টুপি-এর শরয়ী ফায়ছালা তুলে ধরা হলো। আর এতেই প্রমাণিত হবে যে, কিসতি, পাঁচ কল্লি, তিন কল্লি টুপি কাফির, বেদ্বীন ও হিন্দু মারওয়ারীদের খাছ টুপি।

কিস্তি বা লম্বা টুপি

শরীয়তের দৃষ্টিতে কিস্তি বা লম্বা টুপি পরিধান করা হারাম। কারণ কিস্তি বা লম্বা টুপি কাফির, বেদ্বীন ও হিন্দু মারওয়ারীদের খাছ টুপি। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত মুফাসসির তাজুল মুফাসসিরীন, ইমাম ক্বাযী বায়যাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার প্রসিদ্ধ তাফসীরের কিতাব ‘তাফসীরে বায়জাবী’ এর মধ্যে সূরা বাক্বারার এ আয়াত শরীফ-

ان الذين كفروا سواء عليهم

এর তাফসীরে উল্লেখ করেন-

لبس الغيار وشد الزنار ونحوهما كفرا.

অর্থ: গিয়ার অর্থাৎ কিস্তি বা লম্বা টুপি পরিধান করা ও পৈতা বা টাই বাধা এবং এতদুভয়ের অনুরূপ পোশাক পরিধান করা কুফরী।” (তাফসীরে বায়জাবী পৃষ্ঠা-২৩)

উল্লেখ্য, অন্যান্য কিতাবে গিয়ার (الغيار) শব্দের বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও আহকাম বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন- তাফসীরে বায়জাবী-এর বিখ্যাত শরাহ, হাশিয়ায়ে মুহিউদ্দীন শায়খ যাদাহ” কিতাবের ১ম খ-ের ১০৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-

الغيار… هو قلنسوة طويلة كانت تلبس فى ابتداء الاسلام وهى الان من شعار اهل الكفر مختصة بهم كالزنار المختصة بالنصرى.

অর্থ: গিয়ার, তা হলো কিস্তি বা লম্বা টুপি, যা ইসলামের প্রাথমিক যুগে ব্যবহার করা হতো এবং তা বর্তমানে কাফিরদের খাছ শেয়ার বা আলামত। যেরূপ নাছারাদের খাছ আলামত হচ্ছে টাই।”

অনুরূপ “হাশিয়াতুশ শিহাব” আল মুসাম্মাহ ইনায়াতুল ক্বাজী ওয়া কিফাইয়াতুর রাজী আলা তাফসীরিল বায়জাবী ১ম জিলদ ২৬৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে-

الغيار قلنسوة طويلة كانت تلبس قبل الاسلام وهى من شعار الكفرة.

অর্থ: গিয়ার হচ্ছে কিস্তি বা লম্বা টুপি, যা ইসলাম পূর্ব যুগে ব্যবহার করা হতো। আর তা কাফিরদেরই শেয়ার বা আলামত। অনুরূপ তাকরীরুল হাবী ফী হল্লে বায়জাবী ২য় খ-ের ৩৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে।

আর এ প্রসঙ্গে বাহরুল উলূম, ফখরুল ফুক্বাহা, রঈসুল মুহাদ্দিসীন, তাজুল মুফাসসিরীন, হাফিজুল হাদীছ, মুফতিয়্যুল আ’যম, শায়খুল মিল্লাত ওয়াদ দ্বীন, মুবাহিছুল আ’যম হযরতুল আল্লামা  শাহ ছূফী মুহম্মদ রুহুল আমীন বশীরহাটি রহমতুল্লাহি আলাইহি কর্তৃক প্রণীত বিশ্ব বিখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য দলীল সমৃদ্ধ ফতওয়ার কিতাব ‘ফতওয়ায়ে আমীনিয়াতে’ উল্লেখ করেন, কিস্তি (লম্বা) টুপি খাছ মারওয়ারিদের (হিন্দুদের) পোশাক …..।’

হুজ্জাতুল ইসলাম, হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বিখ্যাত কিতাব ‘আল মুরশিদুল আমীন’ কিতাবে লিখেন, ইবলীস যখন হযরত মুসা আলাইহিস সালাম উনার সাথে সাক্ষাৎ করে, তখন ইবলীসের মাথায় কিস্তি বা লম্বা টুপি ছিল।

কিস্তি বা লম্বা টুপি হিন্দুদের মাঝে বিস্তার লাভ করার বা কিস্তি বা লম্বা টুপির উৎপত্তি সম্পর্কে কিতাবে উল্লেখ আছে যে, বাদশা আকবরের সময় যখন হিন্দুরা তার দরবারে আসা-যাওয়া করতো, তখন তারা সাধারণত ধূতি, পৈতা ও টিকলী পরিধান করেই আসতো। বাদশা দেখলো এরূপ পোশাকহীন বা শরীর খোলা অবস্থায় বাদশাহর দরবারে প্রবেশ করা বাদশাহর শানের খিলাফ। তাই বাদশাহ তাদেরকে পোশাক পরিধান করে আসার নির্দেশ দেয় এবং মুসলমানদের খিলাফ পোশাক ব্যবহার করতে বলে। হিন্দুরা তখন কোণা ফাড়া পাঞ্জাবী, ধূতি ও কিস্তি বা লম্বা টুপি পরিধান করতে লাগলো। মুসলমানরা যেহেতু গোল টুপি ব্যবহার করতো সেহেতু তারা কিস্তি বা লম্বা টুপিকে গ্রহন করলো, আর কোনা ফাড়া পাঞ্জাবী ব্যবহার করার কারণ দু’টি- ১. মুসলমানদের কোর্তা গোলা বিধায়, তারা কোণা ফাড়া পাঞ্জাবী ব্যবহার করে, যাতে মুসলমানদের সাথে মিল না হয়, ২. তারা যেহেতু ধূতি পরিধান করে, আর ধূতির লেজকে পাঞ্জাবীর পকেটে ঢুকিয়ে রাখে, তাই পাঞ্জাবীর কোণা যদি ফাড়া না হয় তবে ধূতির লেজ পকেটে ঢুকানো হলে পাঞ্জাবী উঠে থাকে, তাই তারা কোণা ফাড়া পাঞ্জাবী ব্যবহার করে।

অতএব প্রমাণিত হলো যে, কিস্তি বা লম্বা টুপি ও কোণা ফাড়া পাঞ্জাবী হিন্দুদেরই পোশাক এবং তারাই এর উৎপত্তিকারক।

অপরদিকে কোণা ফাড়া পাঞ্জাবী ও কিস্তি বা লম্বা টুপি দেওবন্দ সিলসিলার লোকদের মধ্যে বিস্তার লাভ করার কারণ সম্পর্কে বলা হয় যে, দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা কাসেম নানুতুবী সাহেব একজন মজ্জুব হালের লোক ছিলেন। তার জীবনীতে উল্লেখ আছে যে, তিনি এক মাহফিলে যাওয়ার পর মাহফিল শেষে লোকজন তাকে জিজ্ঞাসা করলো, আপনার নাম কি? তিনি বললেন, খুরশীদ হাসান! জিজ্ঞাসা করা হলো আপনার বাড়ী কোথায়? তিনি বললেন, এলাহাবাদ! সকলে চলে যাওয়ার পর তার এক ছাত্র বললো, হুযূর! এটা কি মিথ্যা কথা হলো না? কারণ আপনার নাম কাসেম নানুুতুবী অথচ আপনি বললেন, খুরশীদ হাসান। আর আপনার বাড়ী হলো নানুতুবে। অথচ আপনি বললেন, এলাহাবাদ। তখন মাওলানা কাসেম নানুতুবী সাহেব বলেন, আমি সত্যই বলেছি, কারণ আবযাদ অক্ষর অনুযায়ী আমার নাম খুরশীদ হাসান। তাই আমি বলেছি আমার নামা খুরশীদ হাসান। আর এলাহাবাদ অর্থ আল্লাহ পাক উনার আবাদ। দুনিয়ার প্রতিটি স্থানই মূলতঃ আল্লাহ পাক উনার আবাদ। তাই আমি বলেছি আমার বাড়ী এলাহাবাদ। এরূপ বলার কারণ হলো লোকে যেন আমাকে না চিনে। মূলত তিনি নিজেকে গোপন রাখার জন্যই এরূপ করতেন। যার পেছনে দুটি কারণ ছিল। প্রথমত: উনি মজ্জুব ছিলেন এবং দ্বিতীয়ত: যেহেতু তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে জড়িত ছিলেন সেহেতু ব্রিটিশরা যাতে তাকে সনাক্ত করতে না পারে।

ঠিক এজন্য তিনি কিস্তি বা লম্বা টুপি ও কোণা ফাড়া পাঞ্জাবী পরিধান করতেন। আর তখন থেকেই দেওবন্দ মাদ্রাসার ছাত্ররা তাকে অনুসরণ করে কিস্তি বা লম্বা টুপি ও কোণা ফাড়া পাঞ্জাবী পরিধান করতে থাকে। যা এখনো পর্যন্ত তাদের মধ্যে জারি রয়েছে। উল্লেখ্য মাওলানা কাসেম নানুতুবী যেহেতু মজ্জুব এবং অবস্থার শিকার ছিলেন সুতরাং তাকে মাজুর হিসেবে গণ্য করে সুন্নতী পোশাক পরিধান করাই ওলামায়ে দেওবন্দের উচিত এবং কুরআন-সুন্নাহকে বাদ দিয়ে এ ব্যাপারে মাওলানা কাসেম নানুতুবী সাহেবকে অনুসরণ করা তাদের জন্য আদৌ শুদ্ধ নয়। মূলতঃ ওস্তাদের অনুসরণ তখনই ফায়দাকর যখন ওস্তাদের অনুসৃত কাজটি সুন্নত হয়ে থাকে।

অতএব, প্রমাণিত হলো যে, কিস্তি বা লম্বা টুপি হিন্দু মারওয়ারী বা বিধর্মীদের খাছ টুপি। সুতরাং কিস্তি বা লম্বা টুপি পরিধান করাতে বিধর্মীদের সাথে সদৃশ্য হয় বিধায় তা পরিধান করা হারাম। কেননা হাদীছ শরীফ এ ইরশাদ হয়েছে-

عن عبد الله بن عمر رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من تشبه بقوم فهو منهم

অর্থ: হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বর্ণনা করেন। হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি যে সম্প্রদায়ের সাথে সাদৃশ্য বা মিল রাখবে, সে ব্যক্তি তাদেরই দলভুক্ত হবে। অর্থাৎ তার হাশর-নশর তাদের সাথেই হবে। (আবু দাউদ, মসনদে আহমদ)

সুতরাং কেউ যদি কিস্তি বা লম্বা বা দোপাট্টা টুপি পরিধান করে, তাতে সুন্নতের অনুসরণ তো হবেই না বরং তা হিন্দু মারওয়ারীদের সাথে সাদৃশ্য হওয়ার কারণে কাট্টা হারাম। কেননা বেদ্বীন বা বিধর্মীদের সাথে কোন ব্যাপারে সাদৃশ্য রাখা শরীয়তের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ হারাম।

যেমন এ প্রসঙ্গে ফিক্বাহর বিখ্যাত কিতাব তাহতাবী কিতাবের ৩য় খ-ের ৪৬০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-

والتشبه بهم حرام

অর্থাৎ ইহুদী-নাছারা, হিন্দু-বৌদ্ধ ও বেদ্বীন-বদদ্বীনদের সাথে সাদৃশ্য রাখা হারাম।”

উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা অকাট্যভাবেই প্রমাণিত হলো যে, কিস্তি বা লম্বা টুপি পরিধান করা হারাম ও কুফরী। কেননা তাতে কাফির ও হিন্দু মারওয়ারীদের সাথে সাদৃশ্য হয় ও তাদের খাছ শিয়ার বা আমলকে অনুসরণ করা হয়, যা শরীয়তের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণই হারাম।

কাজেই, ‘হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারাও কিসতি, পাঁচ কল্লি, তিন কল্লি টুপি পরিধান করেছেন’ মাসিক মদীনার সম্পাদক মাহিউদ্দীনের উক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণই ভুল, দলীলবিহীন, ডাহা মিথ্যা। পাশাপাশি এটাও প্রমাণিত হলো যে, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের মুবারক টুপি সম্পর্কিত মাসিক মদীনার সম্পাদক মাহিউদ্দীনের উক্ত বক্তব্য হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের প্রতি সুস্পষ্ট মিথ্যারোপের শামিল। যা কাট্টা কুফরীর অন্তর্ভুক্ত ও জাহান্নামী হওয়ার কারণ।

(বিঃ দ্রঃ চার টুকুরা বিশিষ্ট সাদা ও গোল টুপিই হচ্ছে খাছ সুন্নতি টুপি। এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে মাসিক আল বাইয়্যিনাত শরীফ-এর ৫৩, ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭, ৫৮, ৫৯তম সংখ্যাগুলো পাঠ করলে টুপি সম্পর্কিত প্রশ্নোল্লিখিত বিষয়সহ যাবতীয় বিষয়ে সুস্পষ্ট দলীলভিত্তিক ফায়সালা পেয়ে যাবেন।)

 

মুসাম্মত সানজিদা আক্তার

সভানেত্রী- ছাত্রী আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাত

মুহম্মদপুর, ঢাকা।

সুওয়াল: অখ্যাত মাসিক রাহমানী পয়গাম এপ্রিল/২০০৩ ঈসায়ী সংখ্যায় জিজ্ঞাসা-জবাব বিভাগে নিম্নোক্ত ১২৪৭ নম্বর জিজ্ঞাসার জবাব ছাপা হয়।

জিজ্ঞাসা: ছাহাবী আবু সাঈদ খুদরী ও আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা বলেন যে, রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন আমার মৃত্যুর পর পূর্ব দেশগুলির মধ্য হতে কোন একটি দেশ হতে আমার উম্মতের ভিতর হতে একটি দল বের হবে। এই দলের সদস্যগণ হবে অশিক্ষিত ও মূর্খ। এদের মধ্যে কোন শিক্ষিত লোক গেলে সেও হয়ে যাবে মূর্খের মত। তাদের বক্তৃতা হবে বহু বহু গুণের ফযীলতের। তাদের মত বক্তৃতা বা বয়ান কারো হবে না। …… তারা কুরআনের উপর আমল কিম্বা কুরআন প্রতিষ্ঠার একটু চেষ্টাও করবে না কখনো। উক্ত অখ্যাত পত্রিকা হাদীছ শরীফ ছহীহ স্বীকার করলেও মন্তব্য করেছে যে, প্রচলিত তাবলীগের কার্যক্রম পুরোপুরি শরীয়তসম্মত। ইসলাম পরিপন্থী কোন কিছু এতে নেই।

উক্ত অখ্যাত পত্রিকার উল্লিখিত “জিজ্ঞাসা-জবাবের” প্রেক্ষিতে আমার সুওয়াল বা জানার বিষয় হলো-

…. (৪) প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগীদের পৃষ্ঠপোষকতায় বা পরিচালনায় যারা রয়েছে তারা সকলেই হক্কানী আলিম, তাদের এ দাবি কতটুকু সঠিক? আসলে হক্কানী আলিমের সংজ্ঞা বা পরিচিতি কি?

কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও ক্বিয়াসের দৃষ্টিতে উল্লিখিত সুওয়ালগুলোর দলীলভিত্তিক জাওয়াব দিয়ে আমাদের আক্বীদা, আমল হিফাযতে সহায়তা করবেন বলে আমরা আশাবাদী।

জাওয়াব: প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগ জামায়াত সম্পর্কে উক্ত অখ্যাত পত্রিকার জবাব শুদ্ধ হয়নি। বরং ভুল, মনগড়া ও দলীলবিহীন হয়েছে।

তাই নিম্নে সুওয়ালে বর্ণিত বিষয়গুলোর দলীলভিত্তিক জাওয়াব দেয়া হলো-

ছয় উছূলী তাবলীগ সম্পর্কে প্রশ্নে উল্লিখিত অখ্যাত পত্রিকার অপব্যাখ্যা ও মিথ্যাচারিতার খ-নমূলক জবাব

প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগ সম্পর্কে অখ্যাত পত্রিকার জিজ্ঞাসার জবাবের প্রেক্ষিতে আপনার চতুর্থ সুওয়াল হলো-

(৪) “প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগের পৃষ্ঠপোষকতায় বা পরিচালনায় যারা রয়েছে তারা সকলেই হক্কানী আলিম, তাদের এ দাবি কতটুকু সঠিক? আসলে হক্কানী আলিমের সংজ্ঞা বা পরিচিতি কি?

আপনার উক্ত সুওয়ালের প্রেক্ষিতে বলতে হয় যে, প্রচলিত ছয় উছূলীদের উক্ত দাবি সম্পূর্ণই অবান্তর, মিথ্যা ও দলীলবিহীন। কারণ গত দুই সংখ্যায় প্রদত্ত হক্কানী আলিমের সংজ্ঞা বা পরিচিতিমূলক আলোচনা দ্বারা অকাট্যভাবেই প্রমাণিত হয়েছে যে, হক্কানী আলিম বা সত্যিকার নায়িবে নবী তিনিই (১) যিনি ইসলামের প্রতিটি বিষয়ে আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত অনুযায়ী আক্বীদা পোষণ করেন, (২) ইলমে ফিক্বাহ অর্জন করার সাথে সাথে একজন হক্কানী শায়খ বা মুর্শিদের নিকট বাইয়াত গ্রহণ করে তাছাউফ চর্চা করত অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে আল্লাহভীতি বা তাক্বওয়া অর্জন করেছেন, (৩) অর্জিত ইলম অনুযায়ী পরিপূর্ণ আমল করেন, (৪) সুন্নতের পূর্ণ  পায়রবী করেন, (৫) হারাম-নাজায়িয ও শরীয়তবিরোধী কাজে লিপ্ত হননা। কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ-এর দৃষ্টিতে তাঁরাই আলিম বা নায়িবে নবী।

অথচ প্রচলিত ছয় উছূলীদের কথিত আলিমদের মধ্যে উল্লিখিত গুণাবলীসমূহের কোনটাই বিদ্যমান নেই। আমরা যদি উল্লিখিত পাঁচটি বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করি তবে বিষয়টি আরো সুস্পষ্ট হয়ে যাবে।

পূর্ব প্রকাশিতের পর

হক্কানী-রব্বানী আলিম হওয়ার জন্য চতুর্থ শর্ত হচ্ছে-

(৪) “সুন্নতের পরিপূর্ণ ইত্তিবা বা অনুসরণ অনুকরণ করা।”

কুরআন শরীফ ও সুন্নাহ শরীফ-এর আলোচনা দ্বারা স্পষ্টই প্রমাণিত হয়েছে যে, মহান আল্লাহ পাক ও উনার হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার রিযামন্দী বা সন্তুষ্টি লাভ করতে হলে বা হক্কানী-রব্বানী আলিম হতে হলে, সুন্নতের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ও পুঙ্খানুপুঙ্খ এবং হুবহু অনুসরণ-অনুকরণ করতে হবে। কারণ সুন্নতের খিলাফ আমল করে কখনোই হক্কানী-রব্বানী আলিম হওয়া সম্ভব নয়।

যদি তাই হয়ে থাকে তবে প্রচলিত ছয় উছূলীরা যে দাবি করে থাকে “ছয় উছূলী তাবলীগের পরিচালনায় যারা রয়েছে তারা সকলেই হক্কানী আলিম” তাদের এ দাবি কি করে সত্য হতে পারে? তারা সবক্ষেত্রে সুন্নতের ইত্তিবা করা তো দূরের কথা পোশাক-পরিচ্ছদের ক্ষেত্রেই তো সুন্নত থেকে অনেক দূরে। অর্থাৎ তাদের মাথার টুপি থেকে শুরু করে সবগুলোই সুন্নতের খিলাফ। সুন্নতী পোষাকের কয়েকটি বিষয় নিয়ে দলীলভিত্তিক আলোচনা করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে।

৩. সুন্নতী ইমামাহ বা পাগড়ি

প্রচলিত ছয় উছূলীরা দায়িমীভাবে ইমামাহ বা পাগড়ি পরিধান করে না। কেউ কেউ নামাযের সময় নামকাওয়াস্তে বাঁধলেও তা সুন্নত মোতাবেক হয় না। কেননা পাগড়ি বাঁধার যেরূপ সুন্নত তরীক্বা রয়েছে তদ্রƒপ পাগড়ির রঙ ও পরিমাপেরও সুন্নত রয়েছে। তাই নি¤েœ পাগড়ি সম্পর্কে বিস্তারিত মাসয়ালা তুলে ধরা হলো-

ইমামাহ বা পাগড়ির বর্ণনা

পাগড়ি পরা নামাযের বাইরে ও ভিতরে উভয় অবস্থায়ই সুন্নত ও ফযীলতের কারণ।

নামাযের বাইরে পাগড়ি পরা সুন্নত হওয়ার ব্যাপারে হাদীছ শরীফের ছহীহ কিতাব হাশিয়ায়ে তিরমিযী শরীফে উল্লেখ আছে, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, “নিঃসন্দেহে পাগড়ি পরা (দায়িমী) সুন্নত।”

নামাযের মধ্যে পাগড়ি পরার ফযীলত সম্পর্কে কিতাবে আরো বর্ণিত রয়েছে যে, “নিশ্চয়ই পাগড়ি পরে দু’রাকায়াত নামায আদায় করা, পাগড়ি ছাড়া ৭০ রাকায়াত নামায আদায় করার চেয়ে অধিক ফযীলতপূর্ণ।”

পাগড়ির  ফযীলত থেকে যেন উম্মত মাহরূম না হয় সে জন্যে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিয়্যীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বিশেষ গুরুত্ব সহকারে উম্মতদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, “তোমরা পাগড়ি পর। নিশ্চয়ই পাগড়ি ইসলামের নিদর্শন এবং তা মুসলমান ও মুশরিকদের মাঝে পার্থক্যকারী।”

হযরত উবাদাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-উনার থেকে বর্ণিত আছে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিয়্যীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, “তোমরা পাগড়ি পরো। এতে সহনশীলতা ও গাম্ভীর্যতা বৃদ্ধি পায়।”

পাগড়ি পরা হচ্ছে আখিরী নবী ও রসূল, দো’জাহানের রসূল, ফখরে মওজুদাত, সরকারে কায়িনাত, নূরে মুজাসসাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার খাছ তথা “দায়িমী সুন্নত।”

শুধু তাই নয় পূর্ববর্তী নবী-রসূল আলাইহিমুস্্ সালাম উনারা সকলেই পাগড়ি পরেছেন এবং মহান আল্লাহ পাক উনার ফেরেশতা উনারাও দায়িমীভাবে পাগড়ি পরে থাকেন।

পাগড়ি বাঁধার সুন্নত তরীক্বা

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বর্ণনা করেন, আমি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু আনহু উনাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, “রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি কিভাবে পাগড়ি বাঁধতেন?” “উত্তরে তিনি বলেছিলেন, রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি পাগড়ির একটি প্রান্ত মাথা মুবারকে পেঁচাতেন ও তারই শেষ প্রান্ত পিছনে উপরে গুঁজে দিতেন। আর পাগড়ির শামলা উভয় কাঁধের মাঝখানে ঝুলাতেন।”

“বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম” বলে পাগড়ি পরা, পাগড়ি পরে দোয়া পড়া, নতুন পাগড়ি বাঁধতে হলে জুমুয়ার দিন থেকেই শুরু করা, পাগড়ি দাঁড়িয়ে বাঁধা, টুপির উপর পাগড়ি পরা সুন্নত।

সিজদার স্থানকে পাগড়ির পেঁচ থেকে মুক্ত রাখতে হবে। কেননা, আমাদের হানাফী মাযহাব মুতাবিক পাগড়ির উপর সিজদা করা মাকরূহ। গোলাকার করে মাথার উপরিভাগকে ফাঁকা রেখে পাগড়ি বাঁধা মাকরূহ। দিস্তারবন্দী তথা পাগড়ি বেঁধে দেয়া সুন্নতে রসুল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। আর কারো হাতে পাগড়ি বেঁধে নেয়া সুন্নতে ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম।

পাগড়ির সুন্নতী পরিমাপ

সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিয়্যীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার অধিকাংশ সময়ের (ঘরের ভিতরে) ব্যবহৃত পাগড়ি মুবারক ছিল তিন হাত দৈর্র্ঘ্য। পাঁচ ওয়াক্ত নামাযে ব্যবহৃত পাগড়ি ছিল সাত হাত। আর জুমুয়া, ঈদের দিন এবং কোন দেশের প্রতিনিধির সাথে সাক্ষাতের সময় ব্যবহার করতেন বার হাত লম্বা পাগড়ি মুবারক।

কাজেই, মাথার রুমাল, গামছা, তোয়ালে বা কোন কাপড়ের টুকরা দিয়ে পাগড়ির সুন্নত আদায় হবে না। কেননা, তাতে একই সাথে পাগড়ির মত দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও রং উপস্থিত থাকে না। পাগড়ি মওজুদ থাকা সত্ত্বেও আলস্যবশতঃ পাগড়ি ছাড়া নামায আদায় করা মাকরূহ।

পাগড়ির রঙ

সাদা, সবুজ ও কালো Ñএই তিন রংয়ের পাগড়ি পরা খাছ সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত। লাল, কুসুম, হলুদ ও জাফরানী রঙয়ের ইমামাহ বা পাগড়ি পরিধান করা হারাম ও মাকরূহ তাহরীমী।

আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পাগড়ি মুবারক ছিল তিন ধরনের। যথা (ক) তিন হাত (খ) সাত হাত ও (গ) বার হাত লম্বা। আর প্রস্থ ছিল অর্ধ হাত, এক হাত, দেড় হাত এবং দুই হাত। কোন কোন বর্ণনায় পাগড়ির প্রস্থ ছিল অর্ধ হাত বা এক বিঘত।

পাগড়ির শামলা

পাগড়ি বেঁধে তার শামলা ঝুলানো খাছ সুন্নতে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। পাগড়ির শামলা কমপক্ষে চার আঙুল আর ঊর্ধ্বে এক হাত পরিমাণ হওয়াই সুন্নত। এর চেয়ে কম-বেশি হওয়া সুন্নতের খিলাফ। তবে প্রায় একহাত পরিমাণ ঝুলানোই আফযল বা সর্বোত্তম।

পাগড়ির শামলা পিছনে পিঠের উপর উভয় কাঁধের মাঝখানে ও সামনের ডান দিকে সিনার উপর ঝুলিয়ে দেয়া সুন্নত। তবে আফযল তথা অধিক উত্তম হলো, দু’কাঁধের মাঝখানে পিঠের উপর ঝুলানো। মনে রাখতে হবে, সামনের বাম সিনার উপর শামলা ঝুলানো বিদয়াত।

অতএব, অসংখ্য দলীলের দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, পাগড়ি পরা দায়িমী সুন্নত। কেননা, আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দুনিয়াবী হায়াত মুবারকের অধিকাংশ সময়েই পাগড়ি মুবারক পরেছেন।

এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে মাসিক আল বাইয়্যিনাত এর (৮৩-৯৬)তম সংখ্যাগুলো পাঠ করুন সেখানে পাগড়ি সম্পর্কে প্রায় ১৫০০ দলীল পেশ করা হয়েছে।

উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, প্রচলিত ছয় উছূলীরা ইমামাহ বা পাগড়ির ক্ষেত্রে সুন্নতের ইত্তিবা করে না। বরং সুন্নতের খিলাফ আমল করে থাকে। সুন্নতের খিলাফ আমল করে হক্কানী আলিম দাবি করা মিথ্যাচার নয় কি? (চলবে)

মুহম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান

ফুলবাড়ী, কুড়িগ্রাম।

 

সুওয়াল: (১) শবে বরাত কি? (২) এ সম্পর্কে কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ-এ কোন বর্ণনা আছে কি? (৩) অনেকে শ’বে বরাত উদযাপনকে বিদয়াত  ও নাজায়িয বলে থাকে। তারা কারণ স্বরূপ বলে থাকে যে, কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ-এর কোথাও শবে বরাতের উল্লেখ নেই। আসলে কি তাই? সঠিক জাওয়াব দানে বাধিত করবেন।

জাওয়াব: (১) শবে বরাত হচ্ছে ইসলামের বিশেষ রাত্রিসমূহের মধ্যে একটি রাত্র। যা শা’বানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত্রিতে হয়ে থাকে। শবে বরাত-এর অর্থ হচ্ছে ‘মুক্তির রাত’ বা ‘নাজাতের রাত।’

(২) ‘শব’ ফার্সী শব্দ। যার অর্থ হচ্ছে, রাত। আর বরাত আরবী শব্দ যা উর্দূ, ফার্সী, বাংলা ইত্যাদি সব ভাষাতেই ব্যবহার হয়ে থাকে। যার অর্থ ‘মুক্তি’ ও ‘নাজাত’ ইত্যাদি। কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ-এর ভাষা যেহেতু আরবী তাই ফার্সী ‘শব’ শব্দটি কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ-এ না থাকাটাই স্বাভাবিক।

স্মর্তব্য যে, কুরআন শরীফ-এর ভাষায় ‘শবে বরাতকে’ ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ বা বরকতময় রজনী’ এবং হাদীছ শরীফ-এর ভাষায় শবে বরাতকে ‘লাইলাতুন নিছফি মিন শা’বান’ বা শা’বানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

যেমন আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ করেন-

انا انزلنه فى ليلة مبركة انا كنا منذرين. فيها يفرق كل امر حكيم. امرا من عندنا انا كنا مرسلين.

অর্থ: “নিশ্চয়ই আমি বরকতময় রজনীতে (শবে বরাতে) কুরআন শরীফ নাযিল করেছি অর্থাৎ নাযিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আর আমিই ভয় প্রদর্শনকারী। উক্ত রাত্রিতে আমার পক্ষ থেকে সমস্ত প্রজ্ঞাময় কাজ গুলো ফায়সালা করা হয়। আর নিশ্চয়ই আমিই প্রেরণকারী।” (সূরা দুখান-৩, ৪, ৫)

আর হাদীছ শরীফ-এ বর্ণিত রয়েছে-

عن ام المؤمنين حضرة عائشة عليها السلام قالت فقدت رسول الله صلى الله عليه وسلم ليلة فاذا هو بالبقيع فقال اكنت تخافين ان يحيف الله عليك ورسوله قلت يا رسول الله صلى الله عليه وسلم انى ظننت انك اتيت بعض نسائك فقال ان الله تعالى ينزل ليلة النصف من شعبان الى السماء الدنيا فيغفر لاكثر من عدد شعر غنم كلب.

অর্থ: উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম-উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আল্লাহ পাক-উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সাথে কোন এক রাত্রিতে রাত্রিযাপন করছিলাম। এক সময় উনাকে বিছানা মুবারক-এ না পেয়ে আমি মনে করলাম যে, তিনি হয়তো অন্য কোন উম্মুল মু’মিনীন আলাইহিন্নাস সালাম উনাদের হুজরা শরীফে তাশরীফ নিয়েছেন। অতঃপর আমি তালাশ করে উনাকে জান্নাতুল বাক্বীতে পেলাম। সেখানে তিনি উম্মতের জন্য আল্লাহ পাক-উনার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছেন। এ অবস্থা দেখে আমি স্বীয় হুজরা শরীফে ফিরে আসলে তিনিও ফিরে এসে আমাকে বললেন, আপনি কি মনে করেছেন, আল্লাহ পাক সুবহানাহূ ওয়া তায়ালা ও উনার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনারা আপনার সাথে আমানতের খিয়ানত করেছেন! আমি বললাম, ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমি ধারণা করেছিলাম যে, আপনি হয়তো অপর কোন হুজরা শরীফে তাশরীফ নিয়েছেন। অতঃপর হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক তিনি শা’বানের ১৫ তারিখ রাত্রিতে পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করেন অর্থাৎ রহমতে খাছ নাযিল করেন। অতঃপর তিনি বনী কালবের মেষের গায়ে যতো পশম রয়েছে তার চেয়ে অধিক সংখ্যক বান্দাকে ক্ষমা করে থাকেন।” (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, রযীন, মিশকাত)

অতএব প্রমাণিত হলো যে, কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফেই শবে বরাতের কথা উল্লেখ আছে। তবে কুরআন শরীফে বরাতের রাতকে ‘লাইলাতুম মুবারকাহ’ আর হাদীছ শরীফে ‘লাইলাতুন নিছফি মিন শা’বান’ বলা হয়েছে।

অনেকে বলে থাকে যে, সূরা দুখান-এর উক্ত আয়াত শরীফ দ্বারা শবে ক্বদরকে বুঝানো হয়েছে। কেননা উক্ত আয়াত শরীফে স্পষ্টই উল্লেখ আছে যে, “আমি কুরআন শরীফ নাযিল করেছি ….” আর কুরআন শরীফ যে ক্বদরের রাত্রিতে নাযিল হয়েছে তা ‘সূরায়ে ক্বদরেও’ উল্লেখ আছে।

মূলতঃ যারা উপরোক্ত মন্তব্য করে থাকে তারা ‘সূরা দুখান-এর’ উক্ত আয়াত শরীফ-এর সঠিক ব্যাখ্যা না জানা ও না বুঝার কারণেই করে থাকে। মহান আল্লাহ পাক যে ‘সূরা দুখান’-এ বলেছেন, “আমি বরকতময় রজনীতে কুরআন শরীফ নাযিল করেছি।” এর ব্যাখ্যামূলক অর্থ হলো, “আমি বরকতময় রজনীতে কুরআন শরীফ নাযিলের ফায়সালা করেছি।”

আর ‘সূরা ক্বদরে’ যে বলেছেন, “আমি ক্বদরের রাত্রিতে কুরআন শরীফ নাযিল করেছি।”

এর ব্যাখ্যামূলক অর্থ হলো, “আমি ক্বদরের রাত্রিতে কুরআন শরীফ নাযিল শুরু করি।”

অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক “লাইলাতুম মুবারকাহ বা শবে বরাতে” কুরআন শরীফ নাযিলের সিদ্ধান্ত নেন আর শবে ক্বদরে তা নাযিল করা শুরু করেন।

এজন্যে মুফাসসিরীনে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনারা শবে বরাতকে ليلة التجويز  অর্থাৎ ‘ফায়সালার  রাত।’ আর শবে ক্বদরকে ليلة التنفيذ অর্থাৎ ‘জারী করার রাত’ বলে উল্লেখ করেছেন। কেননা শবে বরাতে যে সকল বিষয়ের ফায়সালা করা হয় তা ‘সূরা দুখান-এর’ উক্ত আয়াত শরীফেই উল্লেখ আছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে-

فيها يفرق كل امر حكيم

অর্থাৎ- “উক্ত রজনীতে প্রজ্ঞাসম্পন্ন সকল বিষয়ের ফায়সালা করা হয়।”

হাদীছ শরীফেও উক্ত আয়াতাংশের সমর্থন পাওয়া যায়। যেমন ইরশাদ হয়েছে-

فيها ان يكتب كل مولود  من بنى ادم فى هذه السنة وفيها ان يكتب كل هالك من بنى ادم فى هذه السنة وفيها ترفع اعمالهم وفيها تنزل ارزاقهم.

অর্থাৎ- “বরাতের রাত্রিতে ফায়সালা করা হয় কতজন সন্তান আগামী এক বৎসর জন্ম গ্রহণ করবে এবং কতজন সন্তান মৃত্যু বরণ করবে। এ রাত্রিতে বান্দাদের আমলগুলো উপরে উঠানো হয় অর্থাৎ আল্লাহ পাক-উনার দরবারে পেশ করা হয় এবং এ রাত্রিতে বান্দাদের রিযিকের ফায়সালা করা হয়।” (বায়হাক্বী, মিশকাত)

কাজেই, আল্লাহ পাক তিনি যেহেতু বলেছেন যে, বরকতময় রজনীতে সকল কাজের ফায়সালা করা হয় আর উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনিও যেহেতু বলেছেন যে, বরাতের রজনীতেই সকল বিষয় যেমন- হায়াত, মউত, রিযিক, আমল ইত্যাদি যা কিছু মানুষের প্রয়োজন হয়ে থাকে তার ফায়সালা করা হয় সেহেতু বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, “সূরা দুখান-এর” উক্ত আয়াত শরীফ দ্বারা শবে বরাতকেই বুঝানো হয়েছে।

(৩) বরাতের রাত উদযাপন বা উক্ত রাতে খাছভাবে ইবাদত-বন্দেগী, দোয়া-ইস্তিগফার ও দিনে রোযা রাখা ইত্যাদির নির্দেশ কুরআন শরীফ ও সুন্নাহ শরীফে রয়েছে।

যেমন হাদীছ শরীফে বর্ণিত রয়েছে-

عن على رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم اذا كانت ليلة النصف من شعبان فقوموا ليلها وصوموا يومها فان الله تعالى ينزل فيها لغروب الشمس الى السماء الدنيا فيقول الا من مستغفر فاغفرله الا مسترزق فارزقه الا مبتلى فاعافيه الا كذا الا كذا حتى يطلع الفجر.

অর্থ: “হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহ পাক-উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, যখন শা’বানের ১৫ তারিখ রাত্রি অর্থাৎ বরাতের রাত্রি উপস্থিত হবে তখন তোমরা উক্ত রাত্রিতে নামায আদায় করবে এবং দিনে রোযা রাখবে। কেননা নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক তিনি উক্ত রাত্রিতে সূর্যাস্তের সময় পৃথিবীর আকাশে আসেন অর্থাৎ রহমতে খাছ নাযিল করেন। অতঃপর ঘোষণা করেন, “কোন ক্ষমা প্র্রার্থনাকারী আছো কি? আমি তাকে ক্ষমা করে দিবো।” “কোন রিযিক প্রার্থনাকারী আছো কি? আমি তাকে রিযিক দান করবো।” “কোন মুছিবতগ্রস্ত ব্যক্তি আছো কি? আমি তার মুছিবত দূর করে দিবো।” এভাবে ফজর পর্যন্ত ঘোষণা করতে থাকেন।” (ইবনে মাজাহ, মিশকাত)

কাজেই শবে বরাত উদ্যাপন করা বা উক্ত রাত্রিতে ইবাদত-বন্দেগী করা কুরআন শরীফ ও সুন্নাহ শরীফ-এরই নির্দেশের অন্তর্ভূক্ত। এটা মোটেও বিদয়াত ও নাজায়িয নয়। বরং সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত।

{দলীলসমূহ: (১) সূরা দুখান (২) তাফসীরে দুররে মনছূর, (৩) কুরতুবী, (৪) মাযহারী, (৫) তিরমিযী, (৬) ইবনে মাজাহ, (৭) বায়হাক্বী, (৮) মিশকাত, (৯) মিরকাত, (১০) আশয়াতুল লুময়াত, (১১) লুময়াত, (১২) ত্বীবী, (১৩) তালীক্ব, (১৪) মুযাহিরে হক্ব ইত্যাদি।}

মুহম্মদ মুনির হুসাইন

কুমিল্লা সদর, কুমিল্লা

সুওয়াল:  শবে বরাতকে কেন্দ্র করে সমাজের এক শ্রেণীর মানুষেরা আতশবাজি ও আলোকসজ্জা করে থাকে। শরীয়তের দৃষ্টিতে এটা জায়িয আছে কি-না?

জাওয়াব: শবে বরাতে আলোকসজ্জা ও আতশবাজি করা শরীয়ত সম্মত নয়। ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আলোকসজ্জা হচ্ছে গ্রীক ধর্মের একটি ধর্মীয় প্রথা। সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে হিন্দু ধর্মের ধর্মীয় প্রথা হিসেবে রূপ লাভ করে, যা শেষ পর্যন্ত দেয়ালী পূজা নামে মশহূর হয়। আলোকসজ্জা সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে মুসলমানদের মধ্যে প্রবেশ করে যা প্রকৃতপক্ষে দ্বীন ইসলামের শেয়ার বা তর্জ-তরীক্বার অন্তর্ভুক্ত নয়। আর আতশবাজিও দ্বীন ইসলামের কোন শেয়ারের অন্তর্ভুক্ত নয়। প্রকৃতপক্ষে আতশবাজিও হিন্দু ধর্মের একটি ধর্মীয় প্রথার অন্তর্ভুক্ত। তাই মুসলমানের জন্য এসব করা সম্পূর্ণরূপে হারাম ও নাজায়িয। কারণ হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে-

عن عبد الله بن عمر رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من تشبه بقوم فهو منهم.

অর্থ: “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, যে ব্যক্তি যে সম্প্রদায়ের সাথে মিল বা সাদৃশ্য রাখবে তার হাশর-নশর তাদের সাথেই হবে।” (আহমদ, আবূ দাউদ)

এ প্রসঙ্গে একটি ওয়াক্বিয়া বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, তা হলো হিন্দুস্তানে একজন জবরদস্ত আল্লাহ পাক-উনার ওলী ছিলেন। যিনি ইনতিকালের পর অন্য একজন বুযুর্গ ব্যক্তি উনাকে স্বপ্নে দেখে জিজ্ঞেস করেন, “হে আল্লাহ পাক-উনার ওলী, আপনি কেমন আছেন?” আল্লাহ পাক-উনার ওলী জাওয়াবে বলেন, “আপাতত আমি ভালই আছি, কিন্তু আমার উপর দিয়ে এক কঠিন সময় অতিবাহিত হয়েছে, যা বলার অপেক্ষা রাখেনা। আমার ইনতিকালের পর আমাকে ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারা সরাসরি আল্লাহ পাক-উনার সম্মুখে পেশ করেন। আল্লাহ পাক তিনি ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম-উনাদের বলেন, “হে ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম! তোমরা উনাকে কেন এখানে নিয়ে এসেছো”? ফেরেশ্তা আলাইহিমুস সালাম উনারা বলেন, “আয় আল্লাহ পাক! আমরা উনাকে খাছ বান্দা হিসেবে আপনার সাথে সাক্ষাৎ করানোর জন্য নিয়ে এসেছি।” এটা শুনে আল্লাহ পাক তিনি বললেন, “উনাকে এখান থেকে নিয়ে যাও, উনার হাশর-নশর হিন্দুদের সাথে হওয়া উচিৎ। কেননা তিনি পূজা করেছেন। আল্লাহ পাক-উনার ওলী বলেন, এটা শুনে আমি ভয় পেয়ে গেলাম এবং আমার সমস্ত শরীর ভয়ে কাঁপতে লাগলো। তখন আমি আল্লাহ পাক-উনার নিকট আরজু পেশ করলাম, “আল্লাহ পাক! আমার হাশর-নশর হিন্দুদের সাথে হবে কেন? আমি তো সবসময় আপনার এবং আপনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার ফরমাবরদার ছিলাম। কখনো ইচ্ছাকৃত নাফরমানি করিনি এবং কখনো পূজা করিনি আর মন্দিরেও যাইনি।” আল্লাহ পাক তিনি বললেন, “তুমি সেই দিনের কথা স্মরণ করো, যেদিন হিন্দুস্তানে হোলি পূজা হচ্ছিলো। তোমার সামনে-পিছনে, ডানে-বামে, উপরে-নীচে সমস্ত গাছ-পালা, তরু-লতা, পশু-পাখী, কীট-পতঙ্গ সবকিছুকে রঙ দেয়া হয়েছিলো। এমতাবস্থায় তোমার সামনে দিয়ে একটি গর্দভ (গাধা) হেঁটে যাচ্ছিলো যাকে রঙ দেয়া হয়নি। তখন তুমি পান চিবাচ্ছিলে, তুমি সেই গর্দভের গায়ে এক চিপটি পানের রঙ্গীন রস নিক্ষেপ করে বলেছিলে, “হে গর্দভ! তোমাকে তো কেউ রং দেয়নি এই হোলি পূজার দিনে, আমি তোমাকে রং দিয়ে দিলাম। এটা কি তোমার পূজা করা হয়নি? তুমি কি জানো না?”

من تشبه بقوم فهو منهم

অর্থ “যে ব্যক্তি যে সম্প্রদায়ের সাথে মিল রাখে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত হবে অর্থাৎ তার হাশর-নশর তাদের সাথে হবে।” কাজেই, “তোমার হাশর-নশর হিন্দুদের সাথে উচিৎ।”

যখন আল্লাহ পাক এ কথা বললেন তখন আমি লা-জাওয়াব হয়ে গেলাম এবং ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে বললাম, আয় আল্লাহ পাক! আমি এটা বুঝতে পারিনি, আমাকে কেউ বুঝিয়েও দেয়নি। দয়া করে আমাকে ক্ষমা করে দিন। কিছুক্ষণ পর আল্লাহ পাক বললেন, “হ্যাঁ তোমাকে অন্যান্য আমলের কারণে ক্ষমা করা হলো।”

কাজেই, মুসলমানদের জন্য শুধু শবে বরাতকেই কেন্দ্র করে নয় বরং কোন অবস্থাতেই আতশবাজি ও আলোকসজ্জা ইত্যাদি বিধর্মী বিজাতীয়দের কোন  আমল করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। {দলীলসমূহ ঃ- (১) আহমদ, (২) আবূ দাউদ, (৩) বযলুল মাজহূদ, (৪) আউনুল মা’বূদ, (৫) মাছাবাতা বিসসুন্নাহ, (৬) গ্রীক জাতির ইতিহাস, (৭) হিন্দু ধর্মের ইতিহাস ইত্যাদি।}

 

মুহম্মদ আলী হায়দার

ভোলাহাট, চাপাইনবাবগঞ্জ

 

সুওয়াল:  শবে বরাতে কি আমল করতে হবে? দয়া করে জানিয়ে বাধিত করবেন।

জাওয়াব: শবে বরাত হচ্ছে মুক্তি বা ভাগ্য অথবা নাজাতের রাত। অর্থাৎ বরাতের রাত্রিতে ইবাদত-বন্দেগী করে ও পরবর্তী দিনে রোযা রেখে আল্লাহ পাক ও উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনাদের সন্তুষ্টি অর্জন করাই মূল উদ্দেশ্য।

শবে বরাতে কোন্ কোন্ ইবাদত-বন্দেগী করতে হবে তা কুরআন শরীফ ও সুন্নাহ শরীফে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি। তবে ইবাদত-বন্দেগী করার জন্য নির্দেশ করা হয়েছে।

যেমন হাদীছ শরীফে বর্ণিত রয়েছে-

عن على رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم اذا كانت ليلة النصف من شعبان فقوموا ليلها وصوموا يومها فان الله تعالى ينزل فيها لغروب الشمس الى السماء الدنيا فيقول الا من مستغفر فاغفرله الا مسترزق فارزقه الا مبتلى فاعافيه الا كذا الا كذا حتى يطلع الفجر.

অর্থ: “হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহ পাক-উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, যখন শা’বানের ১৫ তারিখ রাত্রি অর্থাৎ বরাতের রাত্রি উপস্থিত হবে তখন তোমরা উক্ত রাত্রিতে নামায আদায় করবে এবং দিনে রোযা রাখবে। কেননা নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক তিনি উক্ত রাত্রিতে সূর্যাস্তের সময় পৃথিবীর আকাশে আসেন অর্থাৎ রহমতে খাছ নাযিল করেন। অতঃপর ঘোষণা করেন, “কোন ক্ষমা প্র্রার্থনাকারী আছো কি? আমি তাকে ক্ষমা করে দিবো।” “কোন রিযিক প্রার্থনাকারী আছো কি? আমি তাকে রিযিক দান করবো।” “কোন মুছিবতগ্রস্ত ব্যক্তি আছো কি? আমি তার মুছিবত দূর করে দিবো।” এভাবে ফজর পর্যন্ত ঘোষণা করতে থাকেন।” (ইবনে মাজাহ, মিশকাত)

হাদীছ শরীফে আরো বর্ণিত আছে-

عن ابى موسى الاشعرى رضى الله تعالى عنه عن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال ان الله تعالى ليطلع فى ليلة النصف من شعبان فيغفر لجميع خلقه الا لمشرك او مشاحن

অর্থ: “হযরত আবু মূসা আশআরী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি আল্লাহ পাক-উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার থেকে বর্ণনা করেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক তিনি শা’বানের ১৫ তারিখ রাত্রিতে ঘোষণা করেন যে, উনার সমস্ত মাখলূকাতকে তিনি ক্ষমা করে দিবেন। শুধু মুশরিক ও হিংসা-বিদ্বেষকারী ব্যতীত। (ইবনে মাজাহ, আহমদ, মিশকাত)

উপরোক্ত হাদীছ শরীফসমূহের সংক্ষিপ্ত বিষয়বস্তু হলো, রাত্রিতে ইবাদত-বন্দেগী করতে হবে এবং দিনে রোযা রাখতে হবে। যার মাধ্যমে আল্লাহ পাক বান্দাহকে ক্ষমা করে স্বীয় সন্তুষ্টি দান করবেন।

বরাতের রাত্রিতে যেসব ইবাদত করতে হবে তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হলো-

বরাতের নামায

শবে বরাতে ৪, ৬, ৮, ১০, ১২ রাকায়াত নফল নামায পড়া যেতে পারে।

ছলাতুত তাসবীহ নামায

অতঃপর ছলাতুত তাসবীহ-এর নামায পড়বে, যার দ্বারা মানুষের সমস্ত গুণাহখতা ক্ষমা হয়।

তাহাজ্জুদ নামায

অতঃপর তাহাজ্জুদের নামায পড়বে, যা দ্বারা আল্লাহ পাক-উনার নৈকট্য হাছিল হয়।

কুরআন শরীফ তিলাওয়াত

কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করবে, যার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা-উনার সন্তুষ্টি অর্জিত হয়। কেননা নফল ইবাদতের মধ্যে কুরআন শরীফ তিলাওয়াত হচ্ছে সর্বোত্তম আমল।

মীলাদ শরীফ ও দুরূদ শরীফ পাঠ

মীলাদ শরীফ ও দুরূদ শরীফ পাঠ করবে, যার দ্বারা আল্লাহ পাক-উনার রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিইয়ীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সন্তুষ্টি অর্জিত হয়।

যিকির-আযকার

যিকির-আযকার করবে, যার দ্বারা দিল ইছলাহ হয়।

কবর যিয়ারত

কবরস্থান যিয়ারত করবে, যার দ্বারা সুন্নত আদায় হয়। তবে কবর বা মাযার শরীফ যিয়ারত করতে গিয়ে সারারাত্র ব্যয় করে দেয়া জায়িয হবেনা। সুন্নত আদায়ের লক্ষ্যে নিকটবর্তী কোন কবরস্থান যিয়ারত করে চলে আসবে।

দান-ছদকা

গরীব-মিসকীনকে দান-ছদকা করবে ও লোকজনদের খাদ্য খাওয়াবে, যার দ্বারা হাবীবুল্লাহ হওয়া যায়।

হালুয়া-রুটি বা গোশত রুটি পাকানো

উল্লেখ্য, শবে বরাতে হালুয়া-রুটি অথবা অন্য কোন বিশেষ খাবার তৈরী করা শরীয়তে নাজায়িয নয়। শবে  বরাত উপলক্ষে বিশেষ করে আমাদের  দেশ ও তার আশ-পাশের দেশসমূহে যে রুটি-হালুয়ার ব্যাপক প্রচলন রয়েছে তার পিছনে ইতিহাস রয়েছে।

ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়েছে, পূর্ববর্তী যামানায় যখন বর্তমানের মতো বাজার, বন্দর, হোটেল-রেঁস্তরা ইত্যাদি সর্বত্র ছিলোনা তখন মানুষ সাধারণতঃ সরাইখানা, লঙ্গরখানা, মুসাফিরখানা ইত্যাদিতে ছফর অবস্থায় প্রয়োজনে রাত্রিযাপন করতেন। অর্থাৎ মুসাফিরগণ তাদের সফর অবস্থায় চলার পথে আত্মীয়-স্বজন বা পরিচিত জনের ঘর-বাড়ি না পেলে সাধারণতঃ সরাইখানা, মুসাফিরখানা ও লঙ্গরখানায় রাত্রিযাপন করতেন। আর এ সমস্ত মুসাফিরখানা, লঙ্গরখানা ও সরাইখানার দায়িত্বে যারা নিয়োজিত থাকতেন তারাই মুসাফিরদের খাবারের ব্যবস্থা করতেন।

বিশেষ করে মুসাফিরগণ শবে বরাতে যখন উল্লিখিত স্থানসমূহে রাত্রি যাপন করতেন তাদের মধ্যে অনেকেই রাত্রিতে ইবাদত-বন্দেগী করতেন ও দিনে রোযা রাখতেন। যার কারণে উল্লিখিত স্থানসমূহের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ খাবারের ব্যাবস্থা করতেন যাতে মুসাফিরদের রাত্রে ইবাদত-বন্দেগী করতে ও দিনে রোযা রাখতে অসুবিধা না হয়।

আর যেহেতু হালুয়া-রুটি ও গোশ্ত-রুটি খাওয়া সুন্নত সেহেতু তারা হালুয়া-রুটি বা গোশ্ত-রুটির ব্যবস্থা করতেন।

এছাড়াও আরবীয় এলাকার লোকদের প্রধান খাদ্য রুটি-হালুয়া বা রুটি-গোশ্ত। তারা ভাত, মাছ, ইত্যাদি খেতে অভ্যস্ত নয়। সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে শবে বরাত উপলক্ষে হালুয়া-রুটির প্রচলন আমাদের দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

উল্লেখ্য, কোন আমলের ক্ষেত্রেই বদ রছম বা বদ প্রথার অনুসরণ করা জায়িয নেই।

এখন মাসয়ালা হচ্ছে- কেউ যদি শবে বরাত উপলক্ষে রছম-রেওয়াজ না করে বা নিজের ইবাদত-বন্দেগীর ব্যাঘাত না ঘটিয়ে উক্ত হালুয়া-রুটির ব্যবস্থা করে তাহলে তা অবশ্যই জায়িয। শুধু জায়িয নয় বরং কেউ যদি তার নিজের ইবাদত-বন্দেগী ঠিক রেখে অন্যান্যদের জন্য যারা রাত্রিতে ইবাদত-বন্দেগী করবে ও দিনে রোযা রাখবে তাদের ইবাদত-বন্দেগী ও রোযা পালনের সুবিধার্থে হালুয়া-রুটি বা গোশ্ত-রুটি অথবা আমাদের দেশে প্রচলিত খাদ্যসমূহের কোন প্রকারের খাদ্যের ব্যবস্থা করে তা অবশ্যই অশেষ ফযীলত ও নেকীর কারণ হবে।

হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে-

عن عبد الله بن سلام رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم يا ايها الناس افشوا السلام واطعموا الطعام وصلوا الارحام وصلوا بالليل والناس نيام تدخلوا الجنة بسلام.

অর্থ: “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহ পাক-উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, হে লোক সকল! তোমরা সালামের প্রচলন করো, মানুষকে খাদ্য খাওয়াও, আত্মীয়তার সর্ম্পক রক্ষা করো এবং মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন নামায পড়ো তাহলে শান্তির সাথে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।” (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, দারিমী)

তবে সতর্ক থাকতে হবে যে, এই কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে যাতে এমন পরিশ্রম তথা এমন সময় ব্যয় না হয় যাতে করে কারো শবে বরাতের ইবাদতে ঘাটতি হয়। আরো সতর্ক থাকতে হবে যে, খাদ্য বিতরণ যেনো আত্মীয়-স্বজন বা প্রতিবেশীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে বরং এক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে যেনো অভাবগ্রস্তদের প্রাধান্য দেয়া হয়।

দোয়া-ইস্তিগফার

আল্লাহ পাক-উনার নিকট দোয়া করবে, যার কারণে আল্লাহ পাক খুশি হবেন ও উনার নিয়ামত লাভ হবে। আর সর্বশেষ খালিছ ইস্তিগফার ও তওবা করবে, যার মাধ্যমে বান্দাহর সমস্ত গুণাহ-খতা মাফ হয়ে আল্লাহ পাক-উনার খালিছ সন্তুষ্টি অর্জিত হয়। অর্থাৎ শ’বে বরাতের বারাকাত, ফুয়ূজাত, নিয়ামত, রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত ইত্যাদি হাছিল করা যায়।

স্মরণীয় যে, অনেক স্থানে দেখা যায় যে, লোকজন ছুবহে ছাদিকের পর আখিরী মুনাজাত করে থাকে। মূলতঃ মুনাজাত যে কোন সময়েই করা যায়। তবে বরাতের রাতে দোয়া কবুল করার যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তা ছুবহ্ েছাদিকের পূর্ব পর্যন্ত। এরপর বরাতের রাত অবশিষ্ট থাকেনা। কেননা, হাদীছ শরীফে স্পষ্টই বলা হয়েছে যে-

حتى يطلع الفجر

অর্থ: “ফজর বা ছুবহ্ েছাদিক পর্যন্ত আল্লাহ পাক তিনি দোয়া কবুল করেন।”

অতএব, সকলের উচিৎ হবে মূল বা আখিরী মুনাজাত ছুবহে ছাদিকের পূর্বেই করা। {দলীলসমূহ ঃ- (১) তাফসীরে কুরতুবী, (২) মাযহারী, (৩) রুহুল বয়ান, (৪) রুহুল মায়ানী, (৫) খাযিন, (৬) বাগবী, (৭) তিরমিযী, (৮) ইবনে মাজাহ, (৯) আহমদ, (১০) রযীন, (১১) মিশকাত, (১২) মিরকাত, (১৩) আশয়াতুল লুময়াত, (১৪) লুময়াত, (১৫) ত্বীবী, (১৬) ত্বালীক,  (১৭) মুযাহিরে হক্ব ইত্যাদি।}

 

মুহম্মদ আইনুদ্দীন

খাগড়াছড়ি

সুওয়াল:  “ছলাতুত্ তাসবীহ” নামাযের ফযীলত ও নিয়ম জানতে বাসনা রাখি।

জাওয়াব:  “ছলাতুত্ তাসবীহ” নামাযের বহু ফযীলত হাদীছ শরীফে বর্ণিত রয়েছে। যেমন হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে-

عن ابن عباس رضى الله تعالى عنه ان النبى صلى الله عليه وسلم قال للعباس بن عبد المطلب يا عباس يا عماه الا اعطيك الا امنحك الا اخبرك الا افعل بك عشر خصال اذا انت فعلت ذلك غفر الله لك ذنبك اوله واخره قديمه وحديثه خطأه وعمده صغيره وكبيره سره وعلانيته ان تصلى اربع ركعات … ان استطعت ان تصليها فى كل يوم مرة فافعل فان لم تفعل ففى كل جمعة مرة فان لم تفعل ففى كل سنة مرة فان لم تفعل ففى عمرك مرة.

অর্থ: “হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-উনার থেকে বর্ণিত। একদা হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি (আমার পিতা) হযরত আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-উনাকে বলেন, ‘হে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু! হে আমার চাচা! আমি কি আপনাকে দিবোনা, আমি কি আপনাকে দান করবোনা, আমি কি আপনাকে বলবোনা, আমি কি আপনার সাথে করবোনা দশটি কাজ? (অর্থাৎ শিক্ষা দিবোনা দশটি তাস্বীহ) যখন আপনি তা আমল করবেন আল্লাহ পাক আপনার প্রথম গুণাহ, শেষ গুণাহ, পুরাতন গুণাহ, নতুন গুণাহ, অনিচ্ছাকৃত গুণাহ, ইচ্ছাকৃত গুণাহ, ছোট গুণাহ, বড় গুণাহ, গোপন গুণাহ, প্রকাশ্য গুণাহ ইত্যাদি সকল গুণাহ-খতা ক্ষমা করে দিবেন। আপনি (ছলাতুত তাসবীহ-এর) চার রাকায়াত নামায পড়বেন। …. যদি সম্ভব হয় তবে প্রতিদিন একবার এ নামায আপনি পড়বেন। যদি সম্ভব না হয় তবে সপ্তাহে একবার, তাও যদি সম্ভব না হয় তবে বৎসরে একবার, তাও যদি সম্ভব না হয় তবে জীবনে অন্ততঃ একবার এ নামায আপনি পড়বেন।” (আবূ দাউদ, ইবনে মাজাহ, বায়হাকী ফী দাওয়াতিল কবীর, তিরমিযী, মিশকাত)

আর ‘ছলাতুত্ তাসবীহ’ নামাযের নিয়ম সম্পর্কে কিতাবে দু’টি মত উল্লেখ আছে। একটি হানাফী মাযহাব অনুযায়ী অপরটি শাফিয়ী মাযহাব অনুযায়ী।

এখানে আমাদের হানাফী নিয়মটিই উল্লেখ করা হলো-

প্রথমতঃ এই বলে নিয়ত করবে যে, “আমি ছলাতুত তাসবীহ-এর চার রাকায়াত সুন্নত নামায ক্বিবলামুখী হয়ে আদায় করছি।”

অতঃপর তাকবীরে তাহ্রীমা বেঁধে ছানা পাঠ করবে, ছানা পাঠ করে সূরা ক্বিরায়াত পাঠ করার পূর্বেই ১৫বার নিম্নোক্ত তাসবীহ পাঠ করবে-

سبحان الله والحمد لله ولا اله الا الله والله اكبر

উচ্চারণ: “সুব্হানাল্লাহি ওয়ালহাম্দু লিল্লাহি ওয়ালা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার।”

অতঃপর সূরা ক্বিরায়াত পাঠ করে রুকুতে যাওয়ার পূর্বে ১০বার, রুকুতে গিয়ে রুকুর তাসবীহ পাঠ করার পর ১০বার, রুকু থেকে উঠে (ক্বওমায়) সিজদায় যাওয়ার পূর্বে দাঁড়িয়ে ১০বার, অতঃপর সিজদায় গিয়ে সিজদার তাসবীহ পাঠ করে ১০বার, সিজদা থেকে উঠে দ্বিতীয় সিজদায় যাওয়ার পূর্বে (জলসায়) বসে ১০বার, অতঃপর দ্বিতীয় সিজদায় গিয়ে সিজদার তাসবীহ পাঠ করে ১০ বার অর্থাৎ এরূপভাবে প্রতি রাকায়াতে ৭৫ বার উক্ত তাসবীহ  পাঠ করবে।

অতঃপর পরবর্তী রাকায়াতের জন্য দাঁড়াবে। দাঁড়িয়ে প্রথমেই ১৫বার উক্ত তাসবীহ পাঠ করবে। তারপর প্রথম রাকায়াতের মতোই উক্ত তাসবীহগুলো আদায় করবে। অর্থাৎ চার রাকায়াত নামাযে মোট ৩০০ বার উক্ত তাসবীহ পাঠ করবে।

জরুরী মাসয়ালা

ছলাতুত তাসবীহ নামায আদায়কালীন হাতে তাসবীহ নিয়ে গণনা করা মাকরূহ। অঙ্গুলী টিপে টিপে তাসবীহগুলো গণনা করতে হবে।

কোন স্থানে তাসবীহ পড়তে ভুলে গেলে পরবর্তী তাসবীহ পাঠের সময় তা আদায় করে নিতে হবে। তবে শর্ত হচ্ছে ক্বওমায় ও জলসায় উক্ত তাসবীহ আদায় করা যাবেনা। যেমন, সূরা-ক্বিরায়াত পাঠের পূর্বে তাসবীহ ভুলে গেলে তা ক্বিরায়াতের পর আদায় করতে হবে। ক্বিরায়াতের পর তাসবীহ ভুলে গেলে রুকুতে আদায় করতে হবে। রুকুতে তাসবীহ ভুলে গেলে উক্ত তাসবীহ ক্বওমায় আদায় না করে প্রথম সিজদাতে গিয়ে আদায় করতে হবে। ক্বওমায় তাসবীহ ভুলে গেলে তাও প্রথম সিজদাতে গিয়ে আদায় করতে হবে। প্রথম সিজদাতে তাসবীহ ভুলে গেলে তা জলসায় আদায় না করে দ্বিতীয় সিজদাতে গিয়ে আদায় করতে হবে। জলসায় তাসবীহ ভুলে গেলে তাও দ্বিতীয় সিজদায় আদায় করতে হবে। আর দ্বিতীয় সিজদাতে তাসবীহ ভুলে গেলে সূরা-ক্বিরায়াত পাঠ করার পূর্বে আদায় করে নিতে হবে। আর ভুলে যাওয়া তাসবীহ প্রত্যেক স্থানে নির্ধারিত তাসবীহ আদায় করার পর আদায় করতে হবে।

{দলীলসমূহ ঃ- (১) আবূ দাউদ, (২) ইবনে মাজাহ্, (৩) বায়হাক্বী, (৪) তিরমিযী, (৫) মিশকাত, (৬) বযলুল মাজহুদ, (৭) আওনুল মা’বুদ, (৮) তুহ্ফাতুল আহওয়াযী, (৯) মা’য়ারিফুস্ সুনান, (১০) মিরকাত, (১১) লুময়াত, (১২) আশয়াতুল লুময়াত, (১৩) শরহুত্ ত্বীবী, (১৪) তা’লীকুছ ছবীহ্, (১৫) মুজাহিরে হক্ব, (১৬) ফতহুল ক্বাদীর, (১৭) বাহরুর রায়েক, (১৮) মারাকিউল ফালাহ্, (১৯) আলমগীরী, (২০) শরহে বিক্বায়া, (২১) হিদায়া, (২২) আইনুল হিদায়া ইত্যাদি}

 

খন্দকার মুহম্মদ আব্দুল হান্নান

পশ্চিম শান্তিবাগ, ঢাকা।

 

সুওয়াল:  শবে বরাতে ইবাদতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে সারারাত্র ওয়াজ মাহফিল করা শরীয়ত সম্মত কি-না?

জাওয়াব: শবে বরাত হচ্ছে ইসলামের বিশেষ রাত্রিসমূহের মধ্যে একটি রাত্রি। যা শা’বানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত্রিতে হয়ে থাকে। শবে বরাত-এর অর্থ হচ্ছে মুক্তির রাত্র বা নাজাতের রাত্র।

এ রাতে ওয়াজ-নছীহত করার আদেশও নেই। আবার নিষেধও করা হয়নি। তবে এ রাতে দোয়া কবুল করার ও ইবাদত বন্দেগী করার কথাই হাদীছ শরীফে ব্যক্ত হয়েছে। যেমন আখিরী রসূল, রহমতুল্লিল আলামীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন-

ان الدعاء يستجاب فى خمس ليال اول ليلة من رجب وليلة النصف من شعبان وليلة القدر المباركة وليلتى العيدين.

অর্থ: “নিশ্চয়ই পাঁচ রাত্রিতে দোয়া নিশ্চিতভাবে কবুল হয়ে থাকে। (১) রজব মাসের প্রথম রাতে, (২) শবে বরাতের রাতে, (৩) ক্বদরের রাতে, (৪) ঈদুল ফিতরের রাতে, (৫) ঈদুল আযহার রাতে।” (মা ছাবাতা বিসসুন্নাহ, আমালুল ইয়াত্তমি ওয়াল লাইলাতি)

হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে-

عن على رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم اذا كانت ليلة النصف من شعبان فقوموا ليلها وصوموا يومها فان الله تعالى ينزل فيها لغروب الشمس الى السماء الدنيا فيقول الا من مستغفر فاغفرله الا مسترزق فارزقه الا مبتلى فاعافيه الا كذا الا كذا حتى يطلع الفجر.

অর্থ: “হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহ পাক-উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, যখন শা’বানের ১৫ তারিখ রাত্রি অর্থাৎ বরাতের রাত্রি উপস্থিত হবে তখন তোমরা উক্ত রাত্রিতে নামায আদায় করবে এবং দিনে রোযা রাখবে। কেননা নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক তিনি উক্ত রাত্রিতে সূর্যাস্তের সময় পৃথিবীর আকাশে আসেন অর্থাৎ রহমতে খাছ নাযিল করেন। অতঃপর ঘোষণা করেন, “কোন ক্ষমা প্র্রার্থনাকারী আছো কি? আমি তাকে ক্ষমা করে দিবো।” “কোন রিযিক প্রার্থনাকারী আছো কি? আমি তাকে রিযিক দান করবো।” “কোন মুছিবতগ্রস্ত ব্যক্তি আছো কি? আমি তার মুছিবত দূর করে দিবো।” এভাবে ফজর পর্যন্ত ঘোষণা করতে থাকেন।” (ইবনে মাজাহ, মিশকাত)

উক্ত হাদীছ শরীফ-এর ব্যাখ্যায় ইমাম-মুজতাহিদগণ বলেন যে-

ليلة البراءة هى ليلة العفو والكرم، ليلة التوبة والندم، ليلة الذكر والصلوة، ليلة الصدقات والخيرات، ليلة الدعاء والزيارة، ليلة الصلاة على النبى صلى الله عليه وسلم، ليلة تلاواة القران الكريم.

অর্থ: “বরাতের রাত্র হলো ক্ষমা ও দয়ার রাত্র, তওবা ও লজ্জিত হওয়ার রাত্র, যিকির ও নামাযের রাত্র, ছদক্বা ও খয়রাতের রাত্র, দোয়া ও যিয়ারতের রাত্র, দুরূদ শরীফ তথা ছলাত-সালাম পাঠ করার রাত্র এবং কুরআন শরীফ তিলাওয়াতের রাত্র।”

কাজেই, বরাতের রাতে যেহেতু ওয়াজ নছীহতের আদেশও করা হয়নি এবং নিষেধও করা হয়নি, তাই মুছল্লীদেরকে বরাতের রাতের ফযীলত ও ইবাদত-বন্দেগীর নিয়ম-কানুন, তর্জ-তরীক্বা বাতিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত ওয়াজ-নছীহত করা অবশ্যই জায়িয। তাই বলে, সারা রাত্র ওয়াজ করে মুছল্লীদেরকে নামায, তিলাওয়াত, যিকির-আযকার, দোয়া মুনাজাত ইত্যাদি ইবাদত বন্দেগী হতে মাহরূম করা কখনোই শরীয়ত সম্মত নয়। বরং হাদীছ শরীফের খিলাফ। শুধু তাই নয় এতে হক্কুল ইবাদ নষ্ট করা হয়। আর হক্কুল ইবাদ নষ্ট করা কবীরা গুণাহর অন্তর্ভুক্ত। কারণ ওয়াজ বৎসরের যে কোন দিনেই করা যায়। কিন্তু বরাতের রাত্র বৎসরে মাত্র একবারই পাওয়া যায়। যদি কেউ পরবর্তী বৎসর হায়াতে থাকে তবেই সে বরাতের রাত্র পাবে। কাজেই এই মহামূল্যবান রাত্রকে শুধুমাত্র ওয়াজ করে ও শুনে অতিবাহিত করে দেয়া সুন্নতের খিলাফ।

আর সুন্নতের খিলাফ কাজ করে আল্লাহ পাক ও উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনাদের রেজামন্দী বা সন্তুষ্টি কস্মিনকালেও হাছিল করা সম্ভব নয়।

মূলকথা হলো, বরাতের রাত্র মূলতঃ ইবাদত-বন্দেগীর রাত্র, সারা রাত্র ওয়াজ করে ইবাদত বন্দেগীতে বিঘœ ঘটানো এবং মানুষদেরকে ইবাদত থেকে মাহরূম করা সম্পূর্ণই শরীয়তের খিলাফ। এ ধরণের কাজ থেকে বেঁচে থাকা সকলের জন্যেই দায়িত্ব ও কর্তব্য।

{দলীলসমূহ ঃ- (১) আহকামুল কুরআন জাস্সাস, (২) কুরতুবী, (৩) রুহুল মাআনী, (৪) রুহুল বয়ান, (৫) ইহ্ইয়াউ উলূমিদ্দীন, (৬) কিমিয়ায়ে সা’য়াদাত, (৭) ইবনে মাজাহ, (৮) মিশকাত, (৯) মাছাবাতা বিসসুন্নাহ, (১০) মিরকাত, (১১) আশয়াতুল লুময়াত, (১২) লুময়াত, (১৩) শরহুত্ ত্বীবী, (১৪) তালিকুছ ছবীহ, (১৫) মুযাহিরে হক্ব, (১৬) আমালুল ইয়াউমি ওয়াল লাইলাতি ইত্যাদি}

মাওলানা মুহম্মদ নজরুল ইসলাম জালালী

ভূইয়াপুর, টাঙ্গাইল

 

সুওয়াল: ফজর ও আছর নামাযের পর ইমাম ছাহেব মুক্তাদীর দিকে ঘুরে বসে দুআ বা মুনাজাত করেন। এ ব্যাপারে  শরীয়তের কি হুকুম? দয়া করে জানাবেন।

জাওয়াব: শরীয়তের হুকুম বা ফতওয়া হলো, যেসব নামাযে ফরযের পর সুন্নত নামায রয়েছে যেমন- যুহর, জুমুয়া, মাগরিব, ইশা সেসব নামাযে ইমাম ছাহেব ফরযের পর মুক্তাদীর দিকে ফিরে বা ঘুরে বসে মুনাজাত করবে না। বরং ক্বিবলামুখী হয়েই মুনাজাত করবে।

আর যেসব নামাযে ফরযের পর সুন্নত নামায নেই যেমন- ফজর ও আছর সেসব নামাযে ইমাম ছাহেব ফরয নামায শেষে মুক্তাদীর দিকে ঘুরে বসে মুনাজাত করবে।

কেননা স্বয়ং সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যেসব ফরয নামাযের পর সুন্নত নামায নেই সেসব ফরয নামাযে সালাম ফিরানোর পর হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসতেন অতঃপর দুআ করতেন। যেমন এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে বর্ণিত রয়েছে-

عن الاسواد العامرى رضى الله تعالى عنه عن ابيه قال صليت مع رسول الله صلى الله عليه وسلم الفجر فلما سلم انصرف ورفع يديه ودعا.

অর্থ: হযরত আওয়াদ আমিরী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি উনার পিতা হতে বর্ণনা করেন, উনার পিতা বলেন, আমি হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সাথে ফজর নামায পড়লাম। যখন তিনি নামায শেষ করে সালাম ফিরালেন তখন তিনি ঘুরে বসলেন এবং উভয় হাত মুবারক উঠিয়ে দুআ (মুনাজাত) করলেন। (মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ)

হাদীছ শরীফে আরো বর্ণিত রয়েছে-

عن زيد بن خالد رضى الله تعالى عنه قال صلى لنا رسول الله صلى الله عليه وسلم صلوة الصبح بالحديبية فلما انصرف اقبل على الناس.

অর্থ: হযরত যায়িদ ইবনে খালিদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আমাদেরকে নিয়ে হুদায়বিয়াতে ফজরের নামায আদায় করলেন। যখন নামায শেষ করলেন তখন মুছল্লীগণের দিকে ফিরে বসলেন। (বুখারী শরীফ)

আরো বর্ণিত রয়েছে-

عن سدى رحمة الله عليه قال سألت انسا كيف انصرف اذا صليت عن يمينى او عن يسارى قال اما انا فاكثر ما رأيت رسول الله صلى الله عليه وسلم ينصرف عن يمينه.

অর্থ: হযরত সুদ্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, আমি হযরত আনাস ইবনে মালিক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে জিজ্ঞেস করলাম, নামায শেষ করার পর কিভাবে মুখ ফিরাবো, আমার ডান দিকে, না বাম দিকে? তিনি বললেন, মূলতঃ আমি অধিকাংশ সময় হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনাকে উনার ডান দিকে ফিরে বসতে দেখেছি। (মুসলিম ও নাসায়ী)

عن قبيصة بن هلب رضى الله تعالى عنه انه صلى مع النبى صلى الله عليه وسلم فكان ينصرف عن شقيه اى حينا عن يمينه وحينا عن شماله.

অর্থ: হযরত কুবাইছা ইবনে হুলব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-উনার থেকে বর্ণিত। হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সাথে তিনি নামায আদায় করেছেন। তিনি বলেন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উভয় দিকে ঘুরে বসতেন। অর্থাৎ কখনো উনার ডান দিকে এবং কখনো উনার বাম দিকে ঘুরে বসতেন। (আবূ দাউদ শরীফ)।

উপরোক্ত হাদীছ শরীফসমূহ থেকে প্রতিভাত হলো যে, যেসব ফরয নামাযের পর সুন্নত নামায নেই সেসব নামাযে ইমাম ছাহেব সালাম ফিরানোর পর মুক্তাদীগণের দিকে ফিরে বসবেন। তবে প্রথম কাতারে যদি মাসবূক মুক্তাদী থাকে তাহলে ইমাম ছাহেব ডান দিকে অথবা বাম দিকে ফিরে বসবেন। আর ইমাম ছাহেব একজন মুক্তাদী নিয়ে নামায পড়লে সেক্ষেত্রে ইমাম ছাহেবকে পিছনে ফিরতে হবেনা। বরং একটু ডান দিকে ফিরে বসবেন অত:পর দুআ বা মুনাজাত করবেন। এটাই হলো শরীয়তের মাসয়ালা।

দলীলসমূহ: বুখারী, মুসলিম, নাসায়ী, আবূ দাউদ, ফতহুল বারী, তাইসিরুল ক্বারী, মাআরিফে মাদানিয়াহ, তাহতাবী, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, ফতহুল মুলহিম, শামী, কবীরী, দুররুল মুখতার, শরহে মুনিয়া, তাতারখানিয়া, খুলাছা, নূরুদ্দিরায়া, শরহে হিদায়া ইত্যাদি।

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ