সুওয়াল-জাওয়াব

সংখ্যা: ২১৪তম সংখ্যা | বিভাগ:

খন্দকার সেলিম আহমদ

পাহাড় কাঞ্চনপুর, টাঙ্গাইল

সুওয়াল: হাটহাজারী মাদরাসা থেকে প্রকাশিত অখ্যাত মাসিক পত্রিকা ফেব্রুয়ারী-২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় জিজ্ঞাসা-সমাধান বিভাগে, মাসিক আল বাইয়্যিনাত-অক্টোবর ২০০৩ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রদত্ত æমীলাদ শরীফ-ক্বিয়াম শরীফ” সম্পর্কিত বক্তব্যের সমালোচনা করতে গিয়ে এবং একই বিষয়ে এপ্রিল-২০০৫ ঈসায়ী ও মে-২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় এছাড়াও মাসিক মদীনা পত্রিকা ফেব্রুয়ারী-২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রশ্নোত্তর বিভাগে একই ধরনের জাওয়াব দেয়া হয়েছে।

তাদের বক্তব্যগুলোর মধ্যে যে বিষয়গুলো আমার নিকট সন্দেহজনক তা নিম্নে উল্লেখ করা হলো-

যেমন, হাটহাজারী মুখপত্র মে-২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় জিজ্ঞাসা-সমাধান বিভাগে বলা হয়েছে, বর্তমানে প্রচলিত মীলাদের মধ্যে এমন কিছু দিক বা ধারা রয়েছে যেগুলো শরীয়ত মনোনীত নয়।” …

এখন আমাদের সুওয়াল হলো, বর্তমানে প্রচলিত যে মীলাদ শরীফ দেখা যায়, সে সম্পর্কে তাদের উল্লিখিত বক্তব্য কতটুকু দলীলসম্মত? কুরআন শরীফ, সুন্নাহ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াসের দৃষ্টিতে দলীলভিত্তিক জাওয়াব দিয়ে আমাদের আক্বীদা, আমল হিফাযতে সহায়তা করবেন বলে আমরা আশাবাদী।

জাওয়াব: বর্তমানে প্রচলিত মীলাদ শরীফ ও ক্বিয়াম শরীফ সম্পর্কে হাটহাজারী মাদরাসার অখ্যাত মাসিক পত্রিকার জিজ্ঞাসা সমাধানে এবং অপর একটি পত্রিকার প্রশ্নোত্তর বিভাগে যা বলা হয়েছে তা শুদ্ধ তো হয়ইনি, বরং সম্পূর্ণই মিথ্যা, ভুল, মনগড়া ও দলীলবিহীন এবং অনুসরণীয় ইমাম-মুজতাহিদ ও ফক্বীহগণ উনাদের সর্বজনমান্য ও স্বীকৃত বিশ্ব বিখ্যাত ফিক্বাহ ও ফতওয়ার কিতাবসমূহের বক্তব্যের বিপরীত ও বিরুদ্ধ মত। যা ইতঃপূর্বে আমাদের মাসিক আল বাইয়্যিনাত শরীফ”-এর অনেক সংখ্যায় খণ্ডন করে সঠিক ও দলীলভিত্তিক জাওয়াব দেয়া হয়েছে। আর মাসিক আল বাইয়্যিনাত শরীফ”-এর জাওয়াবকে খণ্ডন করা হাটহাজারী মৌলভীদের পক্ষে আদৌ সম্ভব হয়নি, হবেও না ইনশাআল্লাহ। এরপরেও হাটহাজারীর মৌলভী এবং তাদের সকল সমজাতীয়রা বারবার ‘মীলাদ শরীফ ও ক্বিয়াম শরীফ’ সম্পর্কে বিনা তাহক্বীকে ও বিনা দলীলে উক্ত ভুলেরই পুনরাবৃত্তি করে যাচ্ছে।

(ধারাবাহিক)

যেমন, উল্লিখিত বক্তব্যের প্রথমেই তারা বলেছে, বর্তমানে প্রচলিত মীলাদের মধ্যে এমন কিছু দিক বা ধারা রয়েছে যেগুলো শরীয়ত মনোনীত নয়। যেমন, মীলাদকে দ্বীন মনে করা, … বিদআতের নামান্তর, যা পরিহার করা আবশ্যক।”

এর জাওয়াবে বলতে হয় যে,  হাটহাজারীর মৌলভীরা যে লিখেছে মীলাদ  শরীফকে দ্বীনমনে করা হয়, তাদের এ বক্তব্যের দলীল কোথায়? কোন কিতাবে মীলাদ শরীফকে দ্বীনবলা হয়েছে এবং কে মীলাদ শরীফকে দ্বীনবলেছে তার কোন প্রমাণ হাটহাজারীর মৌলভীরা পেশ করতে পারেনি। তাই প্রমাণিত হয় যে, তাদের এ বক্তব্য মনগড়া, বানোয়াট, কল্পনাপ্রসুত ও উদ্দেশ্যমূলক। তাই তা সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাজ্য।

দ্বিতীয়তঃ বলতে হয় যে, মীলাদ শরীফকে যদি কেউ দ্বীন মনে করে তাতেই বা অসুবিধা কোথায়?

কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা, ক্বিয়াসের কোথাও মীলাদ শরীফকে দ্বীন মনে করা বিদয়াত এ কথা উল্লেখ আছে কি? যদি থাকতো তাহলে তারা উল্লেখ করলো না কেন?

আসলে কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা, ক্বিয়াসের কোথাও  উল্লেখ নেই যে, মীলাদ শরীফকে দ্বীন মনে করা বিদয়াত । এ বক্তব্য তাদের সম্পূর্ণই বানানো ও দলীলবিহীন কথা। বরং কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা, ক্বিয়াস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মীলাদ শরীফ অবশ্যই দ্বীন। অর্থাৎ দ্বীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কারণ মীলাদ শরীফ হচ্ছে নূরে মুজাসসাম , হাবীবুল্লাহ্, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ছানা-ছিফত করা, উনার প্রতি ছলাত-সালাম  পাঠ করা, এবং উনার প্রতি যথাযথ তা’যীম-তাকরীম ও মুহব্বত প্রকাশ করার একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ আমল, যে আমল করার জন্য স্বয়ং মহান আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীন তিনি উনার কালাম পবিত্র কুরআন শরীফ-এর একাধিক আয়াত শরীফ-এ নির্দেশ করেছেন। যেমন, মহান আল্লাহ্ পাক রব্বুল আলামীন তিনি ইরশাদ করেন-

انا ارسلنك شاهدا ومبشرا ونذيرا لتؤمنوا بالله ورسوله وتعزروه  وتوقروه وتسبحوه بكرة واصيلا

অর্থ: (হে আমার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম!) নিশ্চয়ই আমি আপনাকে সাক্ষী, সুসংবাদদাতা এবং সতর্ককারী হিসেবে পাঠিয়েছি যেন (হে মানুষ!) তোমরা আল্লাহ পাক উনার উপর এবং উনার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উপর ঈমান আনো এবং তোমরা উনার খিদমত করো ও উনার তা’যীম-তাকরীম করো এবং উনার ছানা-ছিফত করো সকাল-সন্ধ্যা অর্থাৎ দায়িমীভাবে সদা সর্বদা। (সূরা ফাত্্হ : আয়াত শরীফ ৮, ৯)

মহান আল্লাহ্ পাক রব্বুল আলামীন তিনি আরো ইরশাদ করেন-

ان الله وملئكته يصلون على النبى يايها الذين امنوا صلوا عليه وسلموا تسليما

অর্থ: æনিশ্চয় আল্লাহ পাক ও উনার ফেরেশ্তা আলাইহিমুস সালাম উনারা নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উপর ছলাত পাঠ করেন, হে মু’মিনগণ! তোমরাও উনার (নবীজি ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার) প্রতি ছলাত বা দুরূদ শরীফ পাঠ করো এবং সালাম প্রেরণ করার মত প্রেরণ করো। (অর্থাৎ যথাযথ আদব ও তা’যীম-তাকরীমের সহিত ছলাত ও সালাম পাঠ করো।)” (সূরা আহযাব:  আয়াত শরীফ ৫৬)

‘তাফসীরে বাইযাবী’ শরীফ-এ উক্ত আয়াত শরীফ-এর ব্যাখ্যায় উল্লেখ করা হয়েছে-

(ان الله وملئكته يصلون على النبى) يعتنو باظهار شرفه وتظيم شانه (يايها الذين امنوا صلوا عليه) اعتنوا انتم ايضا فانكم اولى بذالك وقولوا اللهم صل على محمد (وسلموا تسليما) قولوا السلام عليك ايها النبى

অর্থঃ (æনিশ্চয়ই আল্লাহ পাক ও উনার ফেরেশ্তা আলাইহিমুস সালামগণ উনারা হযরত নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি ছলাত বা সালাম পাঠ করেন) আল্লাহ পাক এবং ফেরেশ্তা আলাইহিমুস সালাম উনারা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উচ্চতার বিকাশ এবং মহিমা বৃদ্ধির জন্য অর্থাৎ তা’যীমের জন্য যতবান। (হে মু’মিনগণ, তোমরাও উনার প্রতি ছলাত বা দরূদ শরীফ পাঠ করো) অতএব, হে ঈমানদারগণ তোমরাও উনার উচ্চতার বিকাশ ও তা’যীমের জন্য যত্নবান হও। এ কর্তব্য তোমাদেরই অধিক হওয়া উচিত। অতএব তোমরা ছলাত পাঠ করো অর্থাৎ আল্লাহুম্মা ছল্লি আলা মুহাম্মদ (এবং উনাকে সালাম দেয়ার মত দাও) অর্থাৎ বলো-আস্সালামু আলাইকুম আইউহান নাবিইয়্যু।”

উল্লিখিত আয়াত শরীফ দ্বয়ে মহান আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীন তিনি ঈমানদার বান্দা- বান্দিগণকে নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ছানা-ছিফত করতে উনার প্রতি ছলাত ও সালাম পাঠ করতে সরাসরি নির্দেশ দিয়েছেন। যা পালন করা সকল ঈমানদার বান্দা-বান্দিগণের জন্য ফরয। মীলাদ শরীফ-এর মাধ্যমেই উক্ত নির্দেশ পরিপূর্ণভাবে পালিত হয়। যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে কি করে বলা যেতে পারে যে, মীলাদ শরীফ দ্বীন নয়। তবে কি আল্লাহ পাক উনার নির্দেশ পালন করা দ্বীন বহির্ভুত কাজ? মহান আল্লাহ পাক উনার নির্দেশ পালন করাকে যারা দ্বীন বহির্ভুত কাজ বলবে তারা কি মুসলমান? (চলবে)

 

মুহম্মদ আলাউদ্দীন

সদর, চাঁদপুর

সুওয়াল: মাসিক মদীনার সম্পাদক মাহিউদ্দীন সেপ্টেম্বর, জুন, জুলাই-২০১১ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রশ্নোত্তর বিভাগে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে মাটির তৈরী প্রমাণ করতে গিয়ে যেসব বক্তব্য ও যুক্তি দিয়েছে নিম্নে তা উল্লেখ করা হলো।

৩। সমস্ত নবীগণই হযরত আদম আলাইহিস সালাম উনার সন্তান। তিনি যেহেতু মাটির তৈরী, তার সন্তানেরা কি করে নূরের তৈরী হতে পারে?

৪। কুরআন শরীফ-এর অনেক আয়াতে নূর শব্দ দ্বারা কুরআন শরীফ ও হেদায়েতের আলোকে বুঝানো হয়েছে। রসূল পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে নয়।

৫। রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রক্তে গোশতের গঠনে (মাটির) মানুষ ছিলেন বলে উনার শরীর মুবাক থেকে তায়েফ ও উহুদে রক্ত মুবারক ঝড়েছে। নূরের হলে রক্ত মুবারক ঝড়ার প্রশ্নই আসতো না।

মাসিক মদীনার সম্পাদক মাহিউদ্দীনের উল্লিখিত বক্তব্যসমূহের সঠিক জাওয়াব দিয়ে আমাদের ঈমান-আমল হিফাযতে সহায়তা করবেন বলে আমরা আশাবাদী।

জাওয়াব: মাটির তৈরী সম্পর্কে মাহিউদ্দীনের তৃতীয় বক্তব্য হচ্ছে-

৩। সমস্ত নবীগণই হযরত আদম আলাইহিস সালাম উনার সন্তান। তিনি যেহেতু মাটির তৈরী, তার সন্তানেরা কি করে নূরের তৈরী হতে পারে?

এর জাওয়াবে বলতে হয় যে, মাটির তৈরী সম্পর্কিত মাসিক মদীনা পত্রিকার সম্পাদক মাহিউদ্দীনের উক্ত বক্তব্য কুরআন শরীফ ও সুন্নাহ শরীফ-এর খিলাফ। কারণ হযরত আদম আলাইহিস সালাম তিনি মাটির তৈরী হলে উনার সন্তানেরা মাটির তৈরী হবেন এ ধারণা সম্পুর্ণই কুরআন শরীফ ও সুন্নাহ্্ শরীফ-এর খিলাফ। কেননা কুরআন শরীফ-এর যে সকল আয়াত শরীফ-এ মানুষ মাটির তৈরী বলা হয়েছে, সে সকল আয়াত শরীফ দ্বারা শুধুমাত্র  হযরত আদম আলাইহিস্্ সালাম উনাকেই বুঝানো হয়েছে। উনার সন্তানদেরকে নয়। যার প্রমাণ পূর্বে দেয়া হয়েছে।

দ্বিতীয়তঃ অন্যান্য মানুষ অর্থাৎ হযরত আদম আলাইহিস সালাম উনার সন্তানদের সৃষ্টির ব্যপারে কুরআন শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে-

فانا خلقناكم من تراب ثم من نطفة ثم من علقة ثم من مضغة مخلقة وغير مخلقة لنبين لكم

অর্থ: (হে লোক সকল! যদি তোমরা পুনরুত্থানের ব্যাপারে সন্দীহান হও, তবে (ভেবে দেখ) আমি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি। এরপর নুতফা থেকে, এরপর জমাট রক্ত থেকে এরপর পূর্ণাকৃতি বিশিষ্ট ও অপূর্ণাকৃতি বিশিষ্ট গোশত পি- থেকে। তোমাদের কাছে ব্যক্ত করার জন্যে।” (সূরা হজ্জ: আয়াত শরীফ ৫)

উপরোক্ত আয়াত শরীফ-এ বর্ণিত خلقناكم শব্দ দ্বারা মুলত হযরত আদম আলাইহিস সালাম উনাকেই বুঝানো হয়েছে। উনার সন্তানদেরকে নয়। বরং উনার সন্তানদেরকে কুদরতীভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে।

যেমন, এ প্রসঙ্গে ফক্বীহুল আছার, প্রখ্যাত মুফাস্সির আল্লামা আবুল লাইছ সামারকান্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি উনার বিখ্যাত তাফসীরগ্রন্থ æতাফসীরে সামারকান্দী” কিতাব-এর  ২য় খণ্ডের  ৩৮০ পৃষ্ঠায় লিখেন-

(فانا خلقناكم …) اى خلقناكم اباكم الذى هو اصل البشر يعنى حضرت ادم عليه السلام (من تراب) (ثم) خلقنا ذريته (من نطفة) وهو الـمنى

অর্থঃ- æ(আর নিঃসন্দেহে আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি) অর্থাৎ তোমাদের পিতা যিনি মানবজাতীর মূল অর্থাৎ æহযরত আদম আলাইহিস সালাম” উনাকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি। (অতঃপর নুত্্ফা থেকে) উনার সন্তানদেরকে সৃষ্টি করেছি। অর্থাৎ হযরত আদম আলাইহিস সালাম উনার সন্তানদেরকে মনি থেকে সৃষ্টি করেছি।

তৃতীয়তঃ হযরত আদম আলাইহিস সালাম উনাকে যদিও মাটির তৈরী বলা হয়েছে, হাক¦ীক্বত তিনিও নূরের তৈরী। কারণ মাটি নূরেরই একটি ছূরত।

যেমন পানির তিনটি ছূরত (১) পানির সাধারন অবস্থা তরল, (২) পানিকে তাপ দিলে তা বাতাস বা বায়বীয় পদার্থ হয়ে যায়, (৩) পানিকে ঠান্ডা করলে তা বরফ বা শক্ত পদার্থে পরিণত হয়ে যায়।

এখন যদি উক্ত বায়বীয় পদার্থকে ঠান্ডা করা হয় তাহলে তা পূর্বের মত তরল পদার্থ বা পানিতে পরিণত হবে। একইভাবে যদি বরফকে তাপ দেয়া হয় তাহলে উক্ত বরফ বা শক্ত পদার্থটিও তরল পদার্থে বা পানিতে পরিণত হয়ে যাবে। উল্লেখ্য, যেই পানি নূর থেকে সৃষ্টি সেই পানির যদি তিন তিনটি ছূরত হতে পারে তাহলে নূরে হাবীবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার থেকে সবকিছু সৃষ্টি উনার কত ছূরত হতে পারে, সেটা চিন্তা-ফিকিরের বিষয়। অর্থাৎ মাটি নূরের একটা ছূরত ও তার অংশ।

যেমন হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে-

كل شىء من نورى

অর্থ: আমার নূর অর্থাৎ নূরে মুহম্মদী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার থেকে সবকিছু সৃষ্টি হয়েছে। আর হযরত জাবির রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত হাদীছ শরীফ-এও তার প্রমান পাওয়া যায়।

যেমন হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে-

فلما اراد الله تعالى ان يخلق الخلق قسم ذالك النور اربعة اجزاء يخلق من الجزء الاول القلم ومن الثانى اللوح ومن الثالث العرش ثم قسم الرابع اربعة اجزاء يخلق من الاول حملة العرش ومن الثانى الكرسى ومن الثالث باقى الـملئكة ثم قسم الرابع اربعة اجزاء يخلق من الاول السموت ومن الثانى الارضين.

অর্থ: æ….. অতঃপর যখন মহান আল্লাহ্ পাক ‘মাখলুকাত’ সৃষ্টি করার ইচ্ছা পোষণ করলেন তখন সেই ‘নূর’ মুবারক (অর্থাৎ নূরে হাবীবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে একটি অংশ নিয়ে তাঁকে) চার ভাগ করলেন। প্রথম ভাগ দ্বারা ‘কলম’ দ্বিতীয় ভাগ দ্বারা ‘লওহে মাহ্ফুজ’ তৃতীয় ভাগ দ্বারা ‘আরশে মুয়াল্লা’ সৃষ্টি করলেন। চতুর্থ ভাগকে আবার চার ভাগ করেন। প্রথম ভাগ দ্বারা ‘আরশ বহনকারী ফেরেশ্তা, দ্বিতীয় ভাগ দ্বারা ‘কুরসী’ আর তৃতীয় ভাগ দ্বারা অন্যান্য সব ফেরেশ্তাদেরকে সৃষ্টি করেন। অতঃপর এ চতুর্থ ভাগকে আবার চার ভাগ করেন। প্রথম ভাগ দ্বারা ‘আসমান’ আর দ্বিতীয় ভাগ দ্বারা যমীন অর্থাৎ মাটি সৃষ্টি করেন ….।”

উপরোক্ত ছহীহ্ হাদীছ শরীফ-এর বর্ণনা দ্বারা সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হলো যে, মাটিসহ সমস্ত কিছু হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নূর মুবারক থেকে সৃষ্টি। এতে বুঝা যাচ্ছে মাটিও নূরের একটা অংশ।

চতুর্থত: নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে আলাদা। অর্থাৎ অন্যান্য মানুষের মতো নন। কারণ উনার সৃষ্টি নূর হিসেবে।

হযরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে খাজা হযরত আব্দুল্লাহ আলাইহিস সালাম পর্যন্ত সকলের মধ্যে অবস্থান নূর হিসেবে। উনার আম্মা উনার রেহেম শরীফ-এ আগমন, কুদরতীভাবে অবস্থান নূর হিসেবে সাথে সাথে যমীনে তাশরীফও নূর হিসেবে।

যেমন, কুরআন শরীফ-এ্র মহান আল্লাহ্ পাক তিনি ইরশাদ করেন-

قد جاءكم من الله نور وكتاب مبين

অর্থ: æনিশ্চয়ই তোমাদের নিকট মহান আল্লাহ্ পাক উনার পক্ষ হতে এক মহান নূর এবং একখানা সুস্পষ্ট কিতাব এসেছে।” (সূরা মায়িদা: আয়াত শরীফ- ১৫)

উল্লেখ্য, এ আয়াত শরীফ-এ মহান আল্লাহ পাক তিনি ‘নূর’ শব্দ দ্বারা সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ্্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে বুঝিয়েছেন, যেহেতু তিনি আপাদমস্তক নূর বা নূরের তৈরী। বিশ্বখ্যাত ও অনুসরণীয় সকল মুফাসসিরীনে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ উনাদের অভিমতও এটাই। নিম্নে বিশ্ববিখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য তাফসীরসমূহ হতে আয়াত শরীফে বর্ণিত ‘নূর’ শব্দের ছহীহ ও গ্রহণযোগ্য তাফসীর বা ব্যাখ্যা তুলে ধরা হলো-

যেমন এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত ছাহাবী রঈসুল মুফাস্সিরীন হযরত ইবনে আববাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন-

قد جاءكم من الله نور يعنى محمد صلى الله عليه وسلم

অর্থ: æনিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক উনার তরফ থেকে তোমাদের নিকট ‘নূর’ অর্থাৎ ‘মুহম্মদ’ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি এসেছেন।’’

হাদীছ শরীফ-এ স্বয়ং আখিরী রসূল হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি নিজেই নিজেকে নূরের তৈরি বলে উল্লেখ করেছেন বলে অনেক হাদীছ শরীফ বিদ্যমান রয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে-

عن حضرت جابر رضى الله تعالى عنه قال … اخبرنى عن اول شىء خلق الله تعالى قبل الاشياء قال يا جابر ان الله تعالى قد خلق قبل الاشياء نور نبيك

অর্থ: হযরত জাবির রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত …… আমাকে জানিয়ে দিন যে, আল্লাহ পাক সর্বপ্রথম কোন জিনিস সৃষ্টি করেন? তিনি বললেন, হে জাবির রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু! আল্লাহ পাক সবকিছুর পূর্বে আপনার নবী উনার নূরকে সৃষ্টি করেন। …….”

وبالجملة كان ذلك النور فى فطرة ادم عليه السلام محفوظا مؤدعا حتى بدا ذلك النور فى جبين عبد الـمطلب وابنه عبد الله منتقلا ثم نقله الى صدف رحم زوجته امة الزهرية.

অর্থ: মূলকথা হচ্ছে উক্ত নূরে হাবীবী’ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আদম আলাইহিস সালাম উনার পিঠ মুবারক-এ রক্ষিত ছিল। তারপর সেখান থেকে স্থানান্তরিত হয়ে ক্রমান্বয়ে হযরত আব্দুল মুত্তালিব আলাইহিস সালাম পর্যন্ত পৌঁছলো, অতঃপর উক্ত æনূরে হাবীবী” ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে হযরত আমিনা আলাইহাস সালাম উনার পবিত্র রেহেম শরীফ-এ পৌঁছে দেন মহান আল্লাহ পাক।

عن حضرت ابى العجفاء (قال النبى صلى الله عليه وسلم) رأت مى حين وضعتنى سطع منها نور اضات له قصور بصرى.

অর্থ: হযরত আবুল উজাফা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, æআমার বিলাদত শরীফ-এর সময় আমার মাতা দেখেন যে, একখানা নূর মুবারক উনার থেকে আলাদা হয়ে বছরা শহরের দালান-কোঠাসমূহ আলোকিত করে ফেলেছে।”

উপরোক্ত বিস্তারিত ও দলীলভিত্তিক আলোচনা দ্বারা সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হলো যে, মহান আল্লাহ পাক তিনি হযরত আদম আলাইহিস সালাম উনাকে সরাসরি মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। আর উনার সন্তানদেরকে কুদরতীভাবে সৃষ্টি করেছেন। অর্থাৎ সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, হযরত হাওয়া আলাইহাস সালাম ও হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম উনারা ব্যতীত সকল মানুষকেই কুদরতীভাবে রেহেমে সৃষ্টি করা হয়েছে।

কাজেই, মাসিক মদীনা পত্রিকার সম্পাদক মাহিউদ্দীন যে বলেছে, æসমস্ত নবীগণই হযরত আদম আলাইহিস সালাম উনার সন্তান। তিনি যেহেতু মাটির তৈরী, তার সন্তানরা কি করে নূরের তৈরী হতে পারে?” তার এ বক্তব্য ডাহা মিথ্যা, দলীলবিহীন ও তাফসীর র্বি রায় হওয়ার কারণে কুফরী বলেই প্রমাণিত হলো। (চলবে)

 

মুহম্মদ ইবরাহীম সোহেল

কেরানীগঞ্জ, ঢাকা

 

সুওয়াল: জাকির নায়েক উরফে কাফির নায়েক সে তার বক্তব্যে যবন, ম্লেচ্ছ, অস্পৃশ্য হিন্দুদেরকে ভাই বলে সম্বোধন করেছে এবং বলেছে, আমরা হিন্দু ভাইদের ভালবাসি। নাঊযুবিল্লাহ! এ বিষয়ে শরীয়তের ফায়সালা কি?

জাওয়াব: কোন মুসলমানের জন্য কাফির-মুশরিকদেরকে ভাই বলে সম্বোধন করা জায়িয নেই এবং তাদেরকে মুহব্বত করা বা ভালবাসাও জায়িয নেই। সম্পূর্ণরূপে হারাম ও কুফরীর অন্তর্ভুক্ত।

মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ করেন-

يايها الذين امنوا لا تتخذوا اليهود والنصرى اولياء بعضهم اولياء بعض ومن يتولـهم منكم فانه منهم.

অর্থ: হে ঈমানদারগণ! তোমরা ইহুদী ও খ্রিস্টানদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করোনা। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।” (সূরা মায়িদা: আয়াত শরীফ ৫১)

এ আয়াত শরীফ-এর মধ্যে যদিও শুধুমাত্র ইহুদী ও খ্রিস্টানদের সাথে বন্ধুত্ব বা মুহব্বত করতে নিষেধ করা হয়েছে কিন্তু আয়াত শরীফ-এর হুকুম হচ্ছে আম বা ব্যাপক অর্থাৎ সকল কাফির, মুশরিক, বেদ্বীন-বিজাতীয়দের সাথে বন্ধুত্ব, ভালোবাসার সম্পর্ক, সম্বন্ধ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ।

উল্লেখ্য, ভাইয়ের মতো বা ভাইয়ের তুল্য ব্যক্তিকে ‘বন্ধু’ বলা হয়। আরবীতে ‘ওলী’ অর্থ ‘বন্ধু’। সুতরাং, যেখানে বন্ধু সম্পর্ক ও সম্বন্ধ নিষেধ করা হয়েছে সেখানে বন্ধু অপেক্ষা আরো গাঢ় ও গভীর সম্বোধন হলো ‘ভাই’ তা কি বৈধ হবে? কখনই নয়। বরং তা আরো শক্ত নিষেধ।

স্মরণীয় যে, সমস্ত কাফির-মুশরিকরাই মুসলমানদের শত্রু। তন্মধ্যে ইহুদী ও মুশরিকরা হচ্ছে সবচেয়ে বড় বা ঘোরতর শত্রু।

যেমন মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ করেন-

لتجدن اشد الناس عداوة للذين امنوا اليهود والذين اشركوا

অর্থ: তোমরা তোমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু হিসেবে পাবে ইহুদীদেরকে অতঃপর যারা মুশরিক তাদেরকে। (সূরা মায়িদা: আয়াত শরীফ ৮২)

এ আয়াত শরীফ-এর মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তিনি মুসলমানদের সবচেয়ে বড় শত্রু কারা তা বলে দিয়েছেন; যেনো মুসলমানরা তাদের শত্রুতা থেকে সতর্কতা অবলম্বন করতে পারে।

উল্লেখ্য, সমস্ত কাফির-মুশরিকরাই যেহেতু মহান খালিক্ব মালিক রব আল্লাহ পাক উনার শত্রু, মহান আল্লাহ পাক উনার মনোনীত নবী ও রসূল নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার শত্রু এবং মহান আল্লাহ পাক উনার মুহব্বতের বান্দা মু’মিন-মুসলমান উনাদের শত্রু; তাই তাদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহন করতে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ করেন-

يايها الذين امنوا لا تتخذوا عدوى وعدوكم اولياء

অর্থ: হে ঈমানদারগণ! তোমরা আমার শত্রু এবং তোমাদের শত্রুকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না। (সূরা মুমতাহিনা: আয়াত শরীফ ১)

উল্লেখ্য, কাফির-মুশরিকদেরকে ভাই-বন্ধু বলে সম্বোধন করা এবং তাদেরকে মুহব্বত বা ভালবাসার কথা শরীয়তের কোথাও নেই। বরং শরীয়তে নিষেধ রয়েছে। তাহলে যে মুসলমান হবে সে কী করে কাফির-মুশরিককে ভাই বলে সম্বোধন করতে পারে ও ভালবাসতে পারে?

মূলত: কোন কাফির মুশরিককে ভাই বলা ও ভালবাসার অর্থ হচ্ছে মহান আল্লাহ পাক উনার ও উনার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের মুখালিফ বা বিরোধী হওয়া। কারণ মহান আল্লাহ পাক তিনি এবং উনার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনারা যাদেরকে শত্রু বলে ঘোষণা করেছেন; কিন্তু সে তাদেরকে মিত্র বলে প্রচার করছে। নাউযুবিল্লাহ! এবং মহান আল্লাহ পাক তিনি এবং উনার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনারা যাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন; অথচ সে তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করছে। নাঊযুবিল্লাহ!

কাজেই, মহান আল্লাহ পাক উনার ও উনার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের কোন আদেশকে প্রকাশ্যে অমান্যকারী ব্যক্তি আদৌ মুসলমান নয়।

এছাড়া কাফির-মুশরিকদেরকে ভালবাসার অর্থ হলো শিরিক-কুফরকে ভালবাসা। মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ করেন-

ان الشرك لظلم عظيم

অর্থ: নিশ্চয়ই শিরিক হচ্ছে সবচেয়ে বড় নাফরমানী বা বড় গুনাহ। (সূরা লুক্বমান: আয়াত শরীফ ১৩)

তিনি আরো ইরশাদ করেন-

ان الله لا يغفر ان يشرك به ويغفر ما دون ذلك لـمن يشاء

অর্থ:  নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক তিনি উনার সাথে শিরিক করার গুনাহ ক্ষমা করেন না। এছাড়া অন্যসব গুনাহ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন। (সূরা নিসা: আয়াত শরীফ ১১৬)

অর্থাৎ শিরিক হচ্ছে সবচেয়ে বড় নাফরমানী বা গুনাহ।

হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে-

عن حضرت العرس بن عميرة رضى الله تعالى عنه عن النبى صلى الله عليه وسلم قال اذا عملت الخطيئة فى الارض من شهدها فكرهها كان كمن غاب عنها ومن غاب فرضيها كان كمن شهدها.

অর্থ: হযরত উরস্ বিন উমাইরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, æযখন পৃথিবীতে কোথাও কোন পাপ কাজ সংঘটিত হয়, তখন যে ব্যক্তি উক্ত স্থানে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও উহাকে ঘৃণা করে, সে ব্যক্তি এরূপ যেন উহা হতে দূরে ছিল। আর যে ব্যক্তি দূরে থেকেও উক্ত পাপের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করে, সে এরূপ যেন তথায় উপস্থিত ছিল।” (আবূ দাউদ, মিশকাত)

অর্থাৎ গুনাহর কাজ যে স্থানেই সংঘটিত হোক না কেন, তাতে যে ব্যক্তি সম্মতি প্রকাশ করবে অথবা সমর্থন করবে, সে ব্যক্তিই সেই গুনাহে গুনাহগার হবে। সেখানে তার উপস্থিত থাকা বা না থাকা উভয়টিই সমান।

কাজেই, যারা কোন কাফির মুশরিকদেরকে ভাই-বন্ধু বলে সম্বোধন করবে এবং তাদেরকে ভাল বাসবে, তারা আদৌ মুসলমান থাকতে পারে না। বরং তারা তাদেরই অন্তর্ভুক্ত। কেননা হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে-

الـمرء مع من احب

অর্থাৎ যে যাকে মুহব্বত করে বা ভালবাসে সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত। (মুয়াত্তা, বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, মুসনাদে আহমদ, আবূ দাউদ ইত্যাদি)

কাজেই, জাকির নায়েক ওরফে কাফির নায়েকের বক্তব্য দ্বারা একথা দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট যে, সে কাফির মুশরিকদেরই মদদপুষ্ট ও এজেন্ট। যা তার বক্তব্য, লিখনী, আক্বীদা, আমল-আখলাক্ব, সীরত-ছূরত, বেশভুষা, পোশাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদির মাধ্যমেও প্রতিভাত হয়।

হাদীছ শরীফ-এ আরো ইরশাদ হয়েছে-

عن حضرت عبد الله بن عمر رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من تشبه بقوم فهو منهم

অর্থ: হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি যে সম্প্রদায়ের সাথে মিল রাখে, সে তাদের দলভুক্ত এবং তার হাশর-নশর তাদের সাথেই হবে।” (মুসনাদে আহমদ, সুনানে আবূ দাউদ)

অতএব বলার অপেক্ষা রাখে না, জাকির নায়েক উরফে কাফির নায়েকের এ বক্তব্য æআমরা হিন্দু ভাইদেরকে ভালবাসি” প্রকাশ্য কুফরী হয়েছে। শরীয়তের ফতওয়া হচ্ছে- কোন মুসলমান নামধারী ব্যক্তি কুফরী করলে সে মুরতাদ হয়ে যায়।  মুরতাদের শাস্তি হচ্ছে- তার যিন্দিগীর সমস্ত আমল বরবাদ হয়ে যাবে। বিয়ে করে থাকলে তার স্ত্রী তালাক হয়ে যাবে। হজ্জ করে থাকলে তা বাতিল হয়ে যাবে। তার ওয়ারিছ সত্ত্ব বাতিল হয়ে যাবে। তার তওবার জন্য সময়সীমা হচ্ছে তিনদিন। এর মধ্যে তওবা না করলে ইসলামী খিলাফতের তরফ থেকে তার একমাত্র শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদ-। সে মারা গেলে তার গোসল, কাফন, দাফন, জানাযা, কোনটিই জায়িয নেই। বরং তাকে কুকুর-শৃগালের মত গর্তে পুঁতে রাখতে হবে।

{দলীলসমূহ- (১) আহকামুল কুরআন লিল জাস্সাস, (২) কুরতুবী, (৩) রুহুল মায়ানী, (৪)  রুহুল বয়ান, (৫) মাযহারী, (৬) কবীর, (৭) খাযিন, (৮) বাগবী, (৯)  আহমদী, (১০) ইবনে কাছীর, (১১) তাবারী, (১২) যাদুল মাছীর, (১৩) বুখারী, (১৪) মুসলিম, (১৫) বায়হাক্বী, (১৬) মিশকাত, (১৭) ফতহুল বারী, (১৮) উমদাতুল ক্বারী, (১৯) শরহে নববী, (২০) মিরকাত, (২১) আশয়াতুল লুময়াত, (২২) লুময়াত, (২৩) ত্বীবী, (২৪) তালীকুছ ছবীহ, (২৫) মুযাহিরে হক্ব, (২৬) ফিকহুল আকবর, (২৭) শরহে আকাইদে নছফী, (২৮) আকাইদে হাক্কাহ, (২৯) তাকমীলুল ঈমান ইত্যাদি}

 

মুহম্মদ হাফিজুর রহমান

নবীগঞ্জ, হবিগঞ্জ

সুওয়াল: নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম এবং পীর-আওলিয়ায়ে কিরাম উনাদেরকে ওসীলা গ্রহণ করা জায়িয আছে কি না?

জাওয়াব: হ্যা, হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম এবং হযরত পীর-বুযুর্গ বা আওলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনাদেরকে ওসীলা গ্রহণ করা অবশ্যই জায়িয রয়েছে।

মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ করেন-

يايها الذين امنوا اتقوا الله وابتغوا اليه الوسيلة

অর্থ : হে ঈমানদারগণ! তোমরা মহান আল্লাহ পাক উনাকে ভয় করো এবং মহান আল্লাহ পাক উনাকে পাওয়ার জন্য বা উনার মতে-পথে চলার জন্য ওসীলা গ্রহণ করো। (সূরা মায়িদা: আয়াত শরীফ ৩৫)

আলোচ্য আয়াত শরীফ-এ উল্লেখিত ‘ওসীলা’ শব্দের ব্যাখ্যায় হযরত মুফাসসিরীনে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত, জিহাদ প্রভৃতি নেক আমল উল্লেখ করেছেন। হ্যা, প্রত্যেক নেক আমলই ওসীলার অন্তর্ভুক্ত সত্য কথাই; তবে এসব ওসীলার ওসীলা হচ্ছেন হযরত পীরানে তরীক্বত বা আওলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম। আর উনারা যে ওসীলা সে বিষয়টি তাফসীরে রূহুল বয়ান-এ উল্লেখ করা হয়েছে-

والوصول لا يحصل الا بالوسيلة وهى العلماء الحقيقة ومشائخ الطريقة

অর্থ: ওসীলা ব্যতীত আল্লাহ পাক উনার নৈকট্য লাভ করা যায় না। আর ওসীলা হচ্ছেন হক্কানী-রব্বানী আলিম বা তরীক্বার পীর-মাশায়িখগণ উনারা।

উল্লেখ্য, তরীক্বার পীর-মাশায়িখ বা আওলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনাদের নিকট বাইয়াত হয়ে ক্বলবী যিকির ও লতিফাসমূহের যিকির-সবক আদায়ের মাধ্যমে রিয়াসহ অন্তরের যাবতীয় বদ খাছলত দূর করে ইখলাছ হাছিল না করা পর্যন্ত কোন নেক আমল মহান আল্লাহ পাক উনার জন্য করা সম্ভব হবে না এবং তা উনার নিকট কবুলও হবে না।

ইখলাছ ব্যতীত কোন আমল মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট কবুলযোগ্য নয়। এ প্রসঙ্গে কালামুল্লাহ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে-

وما امروا الا ليعبدوا الله مـخلصين له الدين

অর্থ: æতাদেরকে (বান্দা-বান্দি-উম্মত) আদেশ করা হয়েছে, তারা যেনো মহান আল্লাহ পাক উনার ইবাদত করে শুধুমাত্র উনারই সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ইখলাছের সাথে বা একনিষ্ঠভাবে।” (সূরা বাইয়্যিনাহ : আয়াত শরীফ ৫)

আর হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে-

عن حضرت ابى امامة الباهلى رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم ان الله لا يقبل من العمل الا ما كان له خالصا وابتغى به وجهه

অর্থ: æহযরত আবূ উমামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বর্ণনা করেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক তিনি ওই আমল কবুল করবেন না, যা ইখলাছের সাথে মহান আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করা না হয়।” (নাসায়ী, দায়লামী)

হাদীছ শরীফ-এ আরো ইরশাদ হয়েছে-

عن حضرت ابى هريرة رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم ان الله لا ينظر الى صوركم و اموالكم ولكن ينظر الى قلوبكم

অর্থ: æহযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক তিনি ইরশাদ করেন, নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক তিনি তোমাদের আকৃতি ও ধন-সম্পদের প্রতি লক্ষ্য করেন না, বরং তোমাদের অন্তরের (ইখলাছের) দিকে লক্ষ্য করেন।” (মুসলিম, মিশকাত, মাছাবীহুস সুন্নাহ, শরহে নববী, মিরকাত)

আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আরো ইরশাদ করেন-

اخلص دينك يكفيك العمل القليل

অর্থ: æইখলাছের সাথে আমল করো। অল্প আমলই তোমার জন্য যথেষ্ট হবে।” (তারগীব, ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন, ক্বিমিয়ায়ে সায়াদাত)

স্মরণীয় যে, ইখলাছের বিপরীত হচ্ছে রিয়া অর্থাৎ যে আমল মহান আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টি ব্যতীত অন্য উদ্দেশ্যে করা হয় তার নামই হচ্ছে গইরুল্লাহ বা রিয়া (লৌকিকতা)। গইরুল্লাহ বা রিয়ার জন্য আমল করা হলে সেটা যত বড় আমলই হোক তা মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট কবুল হওয়া কিংবা তা ওসীলা হিসেবে গৃহীত হওয়া তো দূরের কথা বরং সে আমলই তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করানোর কারণ হবে। নাউযুবিল্লাহ!

যেমন এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ করেন-

فويل للمصلين. الذين هم عن صلاتـهم ساهون. الذين هم يرائون.

অর্থ: æওইসব মুছল্লী বা নামাযীর জন্য জাহান্নাম, যেসব মুছল্লী অলসতার সাথে এবং লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে নামায আদায় করে।” (সূরা মাউন : আয়াত শরীফ ৪, ৫, ৬ )

এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে-

عن حضرت ابى هريرة رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم ان اول الناس يقضى عليه يوم القيامة رجل استشهد فاتى به فعرف نعمته فعرفها فقال فما عملت فيها قال قاتلت فيك حتى استشهدت قال كذلك ولكنك قاتلت لان يقال جرى فقد قيل ثم امر به فسحب على وجهه حتى القى فى النار ورجل تعلم العلم وعلمه وقرا القران فاتى به فعرفه نعمه فعرفها قال فما عملت فيها قال تعلمت العلم وعلمته وقرات فيك القران قال كذبت ولكنك تعلمت العلم ليقال انك عالـم وقرات القران ليقال هو قارى فقد قيل ثم امر به فسحب على وجهه حتى القى فى النار ورجل وسع الله عليه واعطاه من اصناف الـمال كله فاتى به فعرف نعمه فعرفها قال فما عملت فيها قال ما تركت من سبيل تحب ان ينفق فيها الا انفقت فيها لك قال كذبت ولكنك فعلت ليقال هو جواد فقد قيل ثم امر به فسحب على وجهه ثم القى فى النار.

অর্থ: æক্বিয়ামতের দিন তিনজন লোককে প্রথমে বিচারের জন্য আনা হবে। প্রথম যে ব্যক্তিকে আনা হবে, সে হলো একজন শহীদ। তাকে জিজ্ঞেস করা হবে, ‘হে ব্যক্তি! তোমাকে আমি এত শক্তি-সামর্থ্য দিলাম, তা দিয়ে তুমি কি করেছ?’ সে বলবে, ‘আয় আল্লাহ পাক! আমি জিহাদ করতে করতে আপনার জন্য শহীদ হয়েছি।’ আল্লাহ পাক তিনি বলবেন, ‘মিথ্যা কথা! তুমি আমার জন্য জিহাদ করনি, মানুষ তোমাকে বড় পালোয়ান বা শক্তিশালী বলবে, সেজন্য তুমি জিহাদ করেছ, যুদ্ধ করেছ। আর মানুষ তোমাকে শহীদ বলেছে (তোমার বদলা তুমি পেয়েছ)।’ তখন মহান আল্লাহ পাক তিনি হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকে বলবেন, ‘হে হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম আপনারা! এ লোকটাকে চুলে ধরে জাহান্নামে নিক্ষেপ করুন।’ তাই করা হবে। নাঊযুবিল্লাহ!

দ্বিতীয় আরেকজন লোককে আনা হবে, যাকে ইলম দান করা হয়েছে। সে কুরআন শরীফ ছহীহ-শুদ্ধভাবে পড়তে শিখেছে এবং তা অন্যকে শিক্ষা দিয়েছে। মহান আল্লাহ পাক তিনি তাকে বলবেন, ‘হে আলিম ছাহেব, ক্বারী ছাহেব! তোমাকে এত ইলম দেয়া হয়েছিল, শুদ্ধ করে কুরআন শরীফ পাঠ করতে শিক্ষা দেয়া হয়েছিল, তুমি কি করলে?’ সে ব্যক্তি বলবে, ‘আয় আল্লাহ পাক! আমি আপনার জন্য ইলম শিক্ষা করেছি এবং তা অন্যকে শিক্ষা দিয়েছি, আর আপনার জন্যই আমি কুরআন শরীফ শুদ্ধ করে পাঠ করেছি।’ মহান আল্লাহ পাক তিনি বলবেন, ‘মিথ্যা কথা! বরং মানুষ তোমাকে বড় আলিম, বড় ক্বারী ছাহেব বলবে, সে জন্যেই তুমি ইলম অর্জন করেছ, কুরআন শরীফ শুদ্ধ করে পড়া শিখেছ। কাজেই মানুষ তোমাকে বড় আলিম, বড় ক্বারী ছাহেব বলেছে (তোমার বদলা তুমি পেয়েছ)।’ তখন মহান আল্লাহ পাক তিনি হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকে বলবেন, ‘হে হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম! আপনারা এ লোকটাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করুন।’ তখন তার চুলে ধরে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। নাঊযুবিল্লাহ!

এরপর তৃতীয় আরেক জনকে আনা হবে, যাকে অনেক সম্পদ দান করা হয়েছে। তাকে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলবেন, ‘হে ব্যক্তি! তোমাকে আমি দুনিয়াতে অনেক সম্পদের মালিক করেছিলাম, তার বিনিময়ে তুমি কি আমল করেছ?’ সে ব্যক্তি বলবে, ‘আয় আল্লাহ পাক! আমি আপনার পছন্দনীয় এমন কোনো পথ নেই, যে পথে দান-খয়রাত করিনি।’ অর্থাৎ আপনি যতগুলো রাস্তা পছন্দ করতেন- মসজিদ, মাদরাসা, লঙ্গরখানা, ইয়াতীমখানা, গরিব-মিসকীন, রাস্তা-ঘাট, পুল, পানির ব্যবস্থা ইত্যাদি সমস্ত ক্ষেত্রেই আমি কম-বেশি দান করেছি। কোনো প্রার্থীকে আমি খালি হাতে ফিরিয়ে দেইনি। সবাইকে কম-বেশি দান করেছি, একমাত্র আপনার সন্তুষ্টির জন্য। মহান আল্লাহ পাক তিনি বলবেন, ‘মিথ্যা কথা! তুমি এজন্য দান করেছ যে, লোকে তোমাকে দানশীল বলবে। আর তোমাকে তা বলা হয়েছে।’ মহান আল্লাহ পাক তিনি তখন বলবেন, ‘হে হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম আপনারা! এ দানশীল ব্যক্তিকেও জাহান্নামে নিক্ষেপ করুন।’ তখন হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারা তাকেও চুলে ধরে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।” নাঊযুবিল্লাহ! (মুসলিম, মিশকাত, মাছাবীহুস সুন্নাহ, শরহে নববী, মিরকাত)

উল্লেখিত আয়াত শরীফ ও হাদীছ শরীফ থেকে প্রমাণিত হলো, মহান আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে অর্থাৎ ইখলাছের সাথে আমল না করে বরং রিয়া বা গইরুল্লাহর উদ্দেশ্যে আমল করার কারণে নামাযী, শহীদ, আলিম-ক্বারী ও দানশীল প্রত্যেকের জন্য জাহান্নাম অবধারিত। নাউযুবিল্লাহ!

যেমন হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে-

الناس كلهم هلكى الا الـمؤمنون والـمؤمنون كلهم هلكى الا العالـمون والعالـمون كلهم هلكى الا العاملون والعاملون كلهم هلكى الا الـمخلصون

অর্থ: সমস্ত মানুষ হালাক বা ধ্বংস ঈমানদারগণ ব্যতীত এবং ঈমানদারগণও হালাক আলিমগণ ব্যতীত এবং আলিমগণও হালাল আমলকারীগণ ব্যতীত এবং আমলকারীগণও হালাক মুখলিছগণ তথা ইখলাছ অর্জনকারীগণ ব্যতীত। অর্থাৎ ইখলাছের সাথে আমলকারীগণই কেবল হালাকী থেকে পরিত্রাণ লাভ করবে। (বায়হাক্বী, ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন, তাহক্বীকে হাদীছ, মিরকাত শরীফ)

কাজেই, তরীক্বতের পীর বা আওলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনাদের নিকট বাইয়াত ও ছোহবত গ্রহণ ব্যতীত যেহেতু ইখলাছ অর্জন করা যায় না, সেহেতু সমস্ত ওসীলার ওসীলা হচ্ছেন উনারা।

মহান আল্লাহ পাক তিনি উনার কালাম কুরআন শরীফ-এর প্রথম সূরা সূরাতুল ফাতিহা-এর মধ্যে ইরশাদ করে দিয়েছেন, তোমরা আমাকে পাওয়ার জন্য আমার দেয়া সরল-সঠিক পথের জন্য আমার নিকট এভাবে দোয়া করো যে, আয় বারে ইলাহী-

اهدنا الصراط الـمستقيم. صراط الذين انعمت عليهم

অর্থ : আপনি আমাদেরকে সঠিক-সরল পথ দান করুন- ঐ সকল লোক উনাদের পথ যাদেরকে আপনি নিয়ামত দিয়েছেন।

এখন কাদেরকে মহান আল্লাহ পাক তিনি নিয়ামত দিয়েছেন, সে প্রসঙ্গে কুরআন শরীফ-এর সূরা নিসা ৬৯নং আয়াত শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে-

انعم الله عليهم من النبيين والصديقين والشهداء والصالـحين

অর্থ : মহান আল্লাহ পাক তিনি হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম এবং হযরত ছিদ্দীক্বীন, শুহাদা ও ছালিহীন রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনাদেরকে নিয়ামত দিয়েছেন।

উল্লেখ্য, হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনারা হলেন এক স্তর। আর হযরত ছিদ্দীক্বীন, শুহাদা ও ছালিহীন তথা পীর-বুযুর্গ আওলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনারা হলেন আরেক স্তর অর্থাৎ পরবর্তী স্তর।

এই দুই স্তর বা শ্রেণী উনাদের ওসীলা বা মাধ্যম ব্যতীত কারো পক্ষে ঈমানদার মুসলমান হওয়া বা থাকা, নাজাত পাওয়া, জান্নাত পাওয়া সর্বোপরি মহান আল্লাহ পাক ও উনার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের সন্তুষ্টি লাভ করা সম্ভব নয়। যেমন এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে-

والله ورسوله احق ان يرضوه ان كانوا مؤمنين

অর্থ : যদি তারা (বান্দা-বান্দি-উম্মত) মু’মিন-মু’মিনা হয়ে থাকে তাহলে তারা যেনো মহান আল্লাহ পাক উনাকে ও উনার রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদেরকে সন্তুষ্ট করে। কেননা উনারাই সন্তুষ্টি পাওয়ার সমধিক হকদার। (সূরা তওবা: আয়াত শরীফ ৬২)

অতএব, উপরে উল্লেখিত বর্ণনার দ্বারা প্রতিভাত হলো যে, বান্দা-বান্দি ও উম্মতের জন্য সমস্ত ওসীলার ওসীলা হচ্ছেন পীর-মাশায়িখ আওলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনারা। শুধু তাই নয় দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জাহানে কল্যাণ বা কামিয়াবী হাছিলের জন্য প্রথম ওসীলা হচ্ছেন হযরত নবী ও রসূল আলাইহিমুস সালাম। অতঃপর উনার যারা মনোনীত নায়িব বা ওলীআল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনারা।

মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ করেন-

واتبع سبيل من اناب الى

অর্থ : ঐ ব্যক্তির পথ অনুসরণ করে চলো যিনি আমার দিকে রুজু হয়েছেন বা রয়েছেন অর্থাৎ যিনি আল্লাহওয়ালা বা ওলীআল্লাহ হয়েছেন। (সূরা লুক্বমান: আয়াত শরীফ ১৫)

 

মুহম্মদ সোহেল আহমদ

সাভার, ঢাকা।

 

সুওয়াল: আপনারা বলে থাকেন, ‘লাইলাতুর রগায়িব’ অন্যান্য দিন ও রাত্রি থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ? অথচ অধিকাংশ মুসলমান বিশ্বাস করে ‘লাইলাতুল ক্বদর’ অন্য রাতের তুলনায় বেশি ফযীলতপূর্ণ। কোনটি সঠিক? দয়া করে জানাবেন।

জাওয়াব: প্রথমত: সমস্ত ইজ্জত-হুরমত, ফযীলত, ছানা-ছিফত ও প্রশংসার মালিক স্বয়ং খালিক, মালিক, রব আল্লাহ পাক সুবহানাহূ ওয়া তায়ালা  তিনি।

যেমন কুরআন শরীফ এ ইরশাদ হয়েছে-

ان العزة لله جميعا وهو السميع العليم

অর্থ: নিশ্চয়ই সমস্ত ইজ্জত-সম্মান মহান আল্লাহ পাক উনার জন্য এবং তিনি সবকিছু শোনেন ও সবকিছু জানেন। (সূরা ইউনুস: আয়াত শরীফ ৬৫)

এরপর মহান আল্লাহ পাক উনার যিনি হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি। অত:পর যারা মু’মিন-মুসলমান উনারা ইজ্জত-সম্মানের মালিক বা অধিকারী যেমন কুরআন শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে-

ولله العزة ولرسوله وللمؤمنين ولكن الـمنافقين لا يعلمون

অর্থ: আর মহান আল্লাহ পাক উনার জন্যই সমস্ত ইজ্জত-সম্মান এবং উনার রসূল নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার জন্য এবং মু’মিন মুসলমানদের জন্য। কিন্তু মুনাফিকরা এ সম্পর্কে আদৌ অবগত বা অবহিত নয়। (সূরা মুনাফিকূন: আয়াত শরীফ ৮)

মূলত: সৃষ্টিরাজির ভিতরে সবচাইতে ইজ্জত-সম্মানের অধিকারী হচ্ছেন মহান আল্লাহ পাক উনার যিনি হাবীব নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি। এরপর সৃষ্টিরাজির মধ্যে ব্যক্তি হোক, বস্তু হোক, স্থান হোক, সময় হোক যার যতবেশি তায়াল্লুক-নিসবত নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সাথে তার ততবেশি ফযীলত বা সম্মান। সুবহানাল্লাহ!

উদাহরণস্বরূপ, হযরত উম্মাহাতুল মু’মিনীন আলাইহিন্নাস সালাম। নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পরেই হচ্ছে উনাদের মর্যাদা। মহান আল্লাহ পাক তিনি ব্যতীত কায়িনাতের সকলেই ও সবকিছুই নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত। আর সমস্তু উম্মতের মা  হচ্ছেন নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহহি আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার যাঁরা পবিত্রা আহলিয়া- আযওয়াজ আলাইহিন্নাস সালাম উনারা। সুবহানাল্লাহ!

কাজেই, ‘লাইলাতুল ক্বদর’ ফযীলতপ্রাপ্ত হয়েছে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ইজ্জত-সম্মান, ফযীলতের কারণেই। অতীতের কোন নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের উম্মতের জন্য ‘লাইলাতুল ক্বদর’ ছিল না।

তদ্রƒপ ‘লাইলাতুর রগায়িব’ এ ফযীলতপূর্ণ রাতটি অন্যান্য ফযীলতপূর্ণ দিন ও রাতের চেয়ে বেশি ফযীলতের অধিকারী হয়েছে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কারণেই। সুবহানাল্লাহ!

এ রাতটি অন্যান্য ফযীলতপূর্ণ দিন-রাতের চাইতে বেশি ফযীলতপ্রাপ্ত এই কারণে যে, এই রাতের সাথে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সম্পর্ক-তায়াল্লুক, নিসবত রয়েছে। এ রাতটিই নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যে দুনিয়ার যমীনে আগমন করেছেন তার আগাম শুভ লক্ষণ প্রকাশ করেছিল। সুবহানাল্লাহ!

কাজেই, এ রাতটি না হলে অন্যান্য রাত ও দিনের ফযীলত কখনোই খুঁজে পাওয়া যেতো না। তাহলে এ রাতটি কেন অন্য সমস্ত ফযীলতপূর্ণ রাত ও দিন অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও ফযীলতপূর্ণ হবে না? অবশ্যই হবে।

স্মরণীয় যে, কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ-এ বর্ণিত চারটি হারাম বা সম্মানিত মাসের অন্যতম রজব মাসের পহেলা তারিখ এবং পহেলা জুমুআর রাতটিই হচ্ছে লাইলাতুর রগায়িব। এই মহিমান্বিত ও অতীব সম্মানিত রাতটিতে কুল-মাখলূক্বাতের নবী ও রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, রহমতুল্লিল আলামীন, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উনার সম্মানিতা আম্মা সাইয়্যিদাতু নিসায়িল আলামীন, ত্বাহিরাহ, তইয়িবাহ, রদ্বিয়াহ, মারদ্বিইয়াহ, হাবীবাতুল্লাহ, সাইয়্যিদাতুস সাইয়্যিদাত হযরত আমিনাহ আলাইহাস সালাম উনার পাক-পবিত্রতম রেহেম শরীফ-এ তাশরীফ আনেন। সুবহানাল্লাহিল আকবার! অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক উনার প্রথম সৃষ্টি হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ওজূদ- নূর মুবারক সম্পূর্ণ কুদরতীভাবে সাইয়্যিদুল বাশার সাইয়্যিদুস সাদাহ হযরত খাজা আব্দুল্লাহ যবীহুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার নিকট থেকে উনার পুত-পবিত্রা আহলিয়া সাইয়্যিদাতুস সাইয়্যিদাত হযরত আমিনাহ আলাইহাস সালাম উনার রেহেম শরীফ-এ স্থানান্তরিত হন। সুবহানাল্লাহ!

মূলত ‘লাইলাতুর রগায়িব’ এ ফযীলতপূর্ণ মর্যাদাম-িত রাতটির নিসবত বা সম্পর্ক যেহেতু সরাসরি নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার যমীনে তাশরীফ আনার সাথে সম্পর্কযুক্ত তাই এ রাতের মর্যাদা উম্মতকে ফযীলত-মর্যাদা-মর্তবা অর্জনের জন্য দেয়া ‘লাইলাতুল ক্বদরের চাইতে লক্ষ কোটিগুণ বেশি।

মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ করেন-

انا اعطيناك الكوثر

অর্থ: নিশ্চয়ই আমি আপনাকে কাওছার হাদিয়া করেছি। (সূরাতুল কাওছার: আয়াত শরীফ ১)

এ আয়াত শরীফ-এর ব্যাখ্যায় হযরত মুফাসসিরীনে কিরাম উনারা অনেকেই অনেক কিছু বলেছেন ও লিখেছেন। তবে যিনি মুফাসসিরকুল শিরমণী রঈসুল মুফাসসিরীন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি ‘কাওছার’ শব্দের ব্যাখ্যায় দুটি অর্থ বর্ণনা করেছেন। একটি হলো ‘হাউযে কাওছার’ যার পানি স্বয়ং নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যাকে পান করার অনুমতি দিবেন কেবল তিনিই পান করবেন এবং সেই পানি পান করার পর জান্নাতে প্রবেশ করা পর্যন্ত আর পিপাসা লাগবে না। আর কাওছার-এর আরেকটি অর্থ বর্ণনা করেছেন ‘খইরে কাছীর’ তথা অধিক উত্তম বা ভালাই বা কল্যাণ। অর্থাৎ নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার রহমতপূর্ণ ছোহবতে, নিসবতে, স্পর্শে যা কিছু এসেছে সবকিছুই সবচেয়ে উত্তম, সর্বোৎকৃষ্ট হয়েছে এবং সবচেয়ে ফযীলতপূর্ণ হয়েছে। সুবহানাল্লাহ!

আর এ কারণেই লাইলাতুর রাগায়িব অন্য সকল ফযীলতপূর্ণ দিন ও রাতের চেয়ে শ্রেষ্ঠতম এবং সবচেয়ে ফযীলতপূর্ণ রাত হিসেবে সাব্যস্ত হয়েছে। সুবহানাল্লাহ!

উল্লেখ্য, লাইলাতুল ক্বদরের ফযীলত সম্পর্কে সরাসরি কুরআন শরীফ-এ উল্লেখ রয়েছে সত্যিই। আর লাইলাতুর রগায়িব শরীফ-এর বর্ণনা যদিও সরাসরি কুরআন শরীফ-এ উল্লেখ নেই; তবে এ কথা অবশ্যই সত্য যে, লাইলাতুর রগায়িব শরীফ-এর মাধ্যমে যেহেতু নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার যমীনে আগমনের বিষয়টি সুনিশ্চিত হয়েছে তাই এ রাতটির মর্যাদা লাইলাতুল ক্বদর অপেক্ষা লক্ষ-কোটি গুণ বেশি ফযীলতপূর্ণ। কেননা নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যদি যমীনে আগমন না করতেন তাহলে কুরআন শরীফ নাযিল হতো না, লাইলাতুল ক্বদরসহ কোন ফযীলতপূর্ণ দিন-রাতেরও আগমন ঘটতো না। তাই, অনুসরণীয় ইমাম-মুজতাহিদ, আওলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনারা অনেকেই ফতওয়া দিয়েছেন যে, লাইলাতুর রগায়িব হচ্ছে সমস্ত ফযীলতপূর্ণ দিন-রাতের চাইতে শ্রেষ্ঠ ও ফযীলতপ্রাপ্ত। সুবহানাল্লাহ!

যেমন বিশেষ করে এ বিষয়ে ফতওয়া প্রদান করেছেন হিজরী তৃতীয় শতকের মহান মুজাদ্দিদ, হাম্বলী মাযহাবের যিনি ইমাম হযরত ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি। তিনি বলেন, æলাইলাতুর রগায়িব শরীফ-এর ফযীলত শবে ক্বদর, শবে বরাত এবং অন্যান্য ফযীলত পূর্ণ দিন-রাতের চেয়েও বেশি।” তিনি যখন এ বক্তব্য পেশ করলেন, তখন সমসাময়িক আলিম-উলামা, ইমাম-মুজতাহিদগণ উনারা উনার নিকট এসে বললেন,  হুযূর! শবে ক্বদর, শবে বরাত এবং অন্যান্য ফযীলতপূর্ণ দিন-রাত্রির ফযীলত কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু লাইলাতুর রগায়িব শরীফ বা শবে রগায়িব শরীফ-এর বর্ণনা তো কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফে নেই, তাহলে কিভাবে এ রাত্রির ফযীলত উল্লিখিত ফযীলতপূর্ণ দিন-রাত্রির চেয়ে বেশি হতে পারে? তখন হযরত ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বললেন, আপনারা কি জানেন, লাইলাতুর রগায়িব শরীফ কোন রাত্রিকে বলে? উনারা জানেন না বলে স্বীকার করলেন। তখন তিনি লাইলাতুর রগায়িব শরীফ-এর পরিচয় তুলে ধরে বললেন যে, লাইলাতুর রগায়িব শরীফ হচ্ছে ঐ রাত্রি যে রাত্রিতে মহান আল্লাহ পাক তিনি উনার হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আম্মা আলাইহাস সালাম উনার রেহেম শরীফে তাশরীফ নিয়েছেন। এ রাত্রির ফযীলত অন্যান্য সমস্ত ফযীলতপূর্ণ দিন-রাত্রির চেয়ে বেশি এই জন্য যে, যদি হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উনার আম্মা আলাইহাস সালাম উনার রেহেম শরীফে অতঃপর যমীনে তাশরীফ না আনতেন তাহলে শবে ক্বদর, শবে বরাত এবং অন্যান্য ফযীলতপূর্ণ দিন-রাত কোনটিই আসতোনা। নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আগমনের ওসীলাতেই শবে ক্বদর, শবে বরাতসহ সমস্ত ফযীলতপূর্ণ দিন-রাত্রি এসেছে। কাজেই লাইলাতুর রগায়িব শরীফ-এর ফযীলত সবচেয়ে বেশি। সুবহানাল্লাহ! তিনি যখন লাইলাতুর রগায়িব শরীফ-এর পরিচয় ও ফযীলত তুলে ধরলেন, তখন সকল আলিম-উলামা, ইমাম-মুজতাহিদগণ নির্দিধায় মেনে নিলেন।

অতঃপর একই ফতওয়া প্রদান করেন হিজরী ষষ্ঠ শতকের মহান মুজাদ্দিদ, যিনি সুপ্রসিদ্ধ ক্বাদিরিয়া তরীক্বার ইমাম- গওছুল আ’যম, সাইয়্যিদুল আওলিয়া হযরত বড়পীর ছাহিব রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি।

অতঃপর এ উপমহাদেশে সর্বপ্রথম যিনি হাদীছ শরীফ শাস্ত্রের প্রচার প্রসার করেছেন, যিনি ক্বাদিরিয়া তরীক্বার বিশিষ্ট বুযুর্গ, ইমামুল মুহাদ্দিছীন হযরত শাহ আব্দুল হক মুহাদ্দিছ দেহলবী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনিও অনুরূপ ফওতয়া প্রদান করেন।

অতঃপর যিনি বর্তমান পঞ্চদশ হিজরী শতাব্দীর  মহান মুজাদ্দিদ, মুজাদ্দিদ আ’যম, আওলাদে রসুল ইমাম রাজারবাগ শরীফ-এর হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা আলাইহিস সালাম তিনি। তিনি উনার তাজদীদী মুখপত্র মাসিক আল বাইয়্যিনাত শরীফ এবং দৈনিক আল ইহসান শরীফ-এর মধ্যে লাইলাতুর রগায়িব শরীফ সবচাইতে বেশি ফযীলতপূর্ণ রাত সে সম্পর্কে মুবারক লিখনী প্রকাশ করেন। সুবহানাল্লাহ!

অতএব, অনুসরণীয় হযরত ইমাম-মুজতাহিদ, মুজাদ্দিদ আওলিয়ায়ে কিরাম উনাদের মতের বিপরীতে সাধারণ মু’মিন মুসলমানের বিশ্বাস ও মতামত আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়।

(দলীলসমূহ: গুনিয়াতুত ত্বালিবীন, রযীন, মাছাবাতা বিসসুন্নাহ, আল বাইয়্যিনাত শরীফ, আল ইহসান শরীফ, আমালুল ইয়াওমি ওয়াল লাইল, ফাদ্বায়িলূশ শুহূরি ওয়াল আইইয়াম ইত্যাদি)

 

মুহম্মদ আনোয়ার হুসাইন

সদর, চাঁদপুর

 

সুওয়াল: অনেকে কোন বিষয় গ্রহন করা বা মানার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র কুরআন শরীফ কিংবা বুখারী শরীফ অথবা ছিহাহ সিত্তাহ হাদীছ শরীফ-এর কিতাবের দলীল তলব করে থাকে। তারা মনে করে থাকে, এসব কিতাবের মধ্যে থাকলে তা গ্রহনযোগ্য; অন্যথায় তা গ্রহনযোগ্য নয়। এ সম্পর্কে সঠিক জাওয়াব দানে বাধিত করবেন।

জাওয়াব: শরীয়তের দলীল হলো, কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস। শুধু কুরআন শরীফ ও ছিহাহ সিত্তাহ বা বুখারী শরীফ শরীয়তের দলীল নয়। কেউ প্রমান করতে সক্ষম হবে না যে, শরীয়তের কোথাও ছিহাহ সিত্তাহ বা বুখারী শরীফকে অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। বরং বলা হয়েছে, কুরআন শরীফ এবং হাদীছ শরীফকে অনুসরণ করার জন্য। সুতরাং, হাদীছ শরীফ- তা ছিহাহ সিত্তাহ’র হোক অথবা অন্য কোন কিতাবের হোক তা অবশ্যই অনুসরণীয় ও গ্রহণযোগ্য। কারণ শুধু ছিহাহ সিত্তাহই হাদীছ শরীফ-এর কিতাব নয়। ছিহাহ সিত্তাহ’র বাইরেও বহু হাদীছ শরীফ-এর কিতাব রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে কিতাবে উল্লেখ আছে যে, হযরত ইমাম নববী, হযরত ইবনুস সালাহ, হযরত শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিছ দেহলভী রহমতুল্লাহি আলাইহিম প্রমুখ বিখ্যাত মুহাদ্দিছগণ বলেন যে, ছিহাহ সিত্তাহ ছাড়াও ৫০-এর অধিক ছহীহ বা বিশুদ্ধ হাদীছ শরীফ-এর কিতাব রয়েছে। নিম্নে ছহীহ বুখারী ও ছহীহ মুসলিম শরীফ-এর ন্যায় কতকগুলো ছহীহ হাদীছ শরীফ-এর কিতাবের নাম উল্লেখ করা হলো। যেমন- (১) ছহীহ ইবনে খুযায়মা, (২) ছহীহ ইবনে হাব্বান, (৩) ছহীহ ইবনে উয়ায়না, (৪) ছহীহ ইবনুস সাকান, (৫) ছহীহ মুন্তাকা, (৬) মুখ্তাসারেজিয়াহ, (৭) ছহীহ যুরকানী, (৮) ছহীহ ইস্ফেহানী (৯) ছহীহ ইসমাঈলী, (১০) মুস্তাদ্রাক ইবনে হাকিম, (১১) মুসনাদে ইমাম আ’যম রহমতুল্লাহি আলাইহি, (১২) মুয়াত্তায়ে ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহি (১৩) মুওয়াত্তায়ে ইমাম মুহম্মদ, (১৪) কিতাবুল আছার, (১৫) কিতাবুল খিরাজ, (১৬) কিতাবুল হিজাজ, (১৭) কিতাবুল আ’মালী, (১৮) মুসনাদে শাফিয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি, (১৯) মুসনাদে আবূ ইয়ালী, (২০) মুসনাদে আব্দুর রাজ্জাক, (২১) মুসনাদে আবূ বকর ইবনে আবী শায়বা, (২২) মুসনাদে আব্দ ইবনে হুমায়িদ, (২৩) মুসনাদে আবূ দাউদ তায়ালাসী, (২৪) সুনানু দারে কুত্নী, (২৫) সুনানে দারিমী, (২৬) সুনানে বায়হাক্বী, (২৭) মা’রিফাতু সুনানে বায়হাক্বী, (২৮) মা’য়ানিয়ুল আছার-তহাবী, (২৯) মুশ্ফিক্বিয়ুল আছার-তহাবী, (৩০) মু’জামুল কবীর-তিব্রানী, (৩১) মু’জামুল আওসাত-তিবরানী, (৩২) মু’জামুছ ছগীর-তিব্রানী, (৩৩) কিতাবুল ই’তিক্বাদ, (৩৪) কিতাবুদ্ দোয়া, (৩৫) মুসনাদে হারিস ইবনে উমামা, (৩৬) মুসনাদে বাজ্জাজ, (৩৭) সুনানে আবী মুসলিম, (৩৮) সুনানে সাঈদ বিন মনছূর, (৩৯) শরহুস্ সুন্নাহ, (৪০) শিফা, (৪১) হুলইয়া, (৪২) তাহ্যীবুল আছার ও (৪৩) আল মুখাতারা ইত্যাদি কিতাবসমূহ হাদীছ শরীফের ছহীহ কিতাবের অন্তর্ভুক্ত।

অতএব, প্রমাণিত হলো যে, ছিহাহ সিত্তাহর বাইরেও বহু ছহীহ হাদীছ শরীফ-এর কিতাব রয়েছে। তাছাড়া ছিহাহ সিত্তাহর সকল হাদীছ শরীফই ছহীহ নয় বরং তাতে দ্বয়ীফ এমনকি মওজূ হাদীছ শরীফও রয়েছে।

মূলকথা হলো- এমন কোন হাদীছ শরীফ-এর কিতাব নেই, যে কিতাবের সকল হাদীছ শরীফ ছহীহ বা বিশুদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে সকল মুহাদ্দিছগণ একমত হয়েছেন। বরং কোন একখানা হাদীছ শরীফকে কোন একজন ছহীহ বলেছেন, অন্য একজন সেটাকে দ্বয়ীফ বা হাসান বলেছেন। যেমন- ইমাম বুখারী ও মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহিমা উনারা এমন বহু হাদীছ শরীফ ছহীহ নয় বলে ছেড়ে দিয়েছেন, অথচ সেগুলো হযরত ইমাম আবূ দাউদ, হযরত ইমাম তিরমিযী, হযরত  ইমাম নাসায়ী, হযরত ইমাম ইবনে মাজাহ, হযরত ইমাম দারু কুতনী রহমতুল্লাহি আলাইহিম প্রমুখ ইমামগণ উনারা ছহীহ বলে গ্রহণ করেন। (সায়িকাতুল মুসলিমীন)

আবার এমন অনেক হাদীছ শরীফ রয়েছে, যেগুলো হযরত ইমাম বুখারী ও হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহিমা ছহীহ বলে গ্রহণ করেন। কিন্তু ছিহাহ সিত্তাহর অন্যান্য ইমামগণ সেগুলো ছহীহ নয় বলে পরিত্যাগ করেন।

আর তাই বিখ্যাত মুহাদ্দিছ হযরত মুল্লা আলী ক্বারী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, হযরত ইমাম সাখাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি æআলফিয়া” কিতাবের হাশিয়ায় উল্লেখ করেন যে, æছহীহ বুখারী শরীফ-এর ৮০ জন ও ছহীহ মুসলিম শরীফ-এর ১৬০ জন রাবীর বর্ণনাকৃত হাদীছ শরীফ দ্বয়ীফ বলে প্রমাণিত হয়েছে।” (নুয্হাতুন্ নাজার)

হযরত ইমাম নববী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, æহযরত ইমাম দারু কুত্নী, হযরত আবূ আলী ও হযরত আবূ দাউদ দামেস্কী রহমতুল্লাহি আলাইহিম ছহীহ বুখারী শরীফ ও ছহীহ মুসলিম শরীফ-এর ২০০ হাদীছ শরীফকে দ্বয়ীফ বলে উল্লেখ করেন।” (মুক্বাদ্দিমায়ে শরহে মুসলিম)

হযরত ইমাম কুস্তলানী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, æছহীহ বুখারীতে এরূপ হাদীছ শরীফও রয়েছে, যা কারো মতে ছহীহ, আর কারো মতে দ্বয়ীফ।” (শরহে বুখারী)

কাশফুয যুনূন, মুক্বাদ্দিমায়ে ফাতহুল বারী ইত্যাদি কিতাবে ছহীহ বুখারী শরীফ-এর কিছু কিছু হাদীছ শরীফকে দ্বয়ীফ বলে প্রমাণ করা হয়েছে।

শুধু তাই নয়, ছহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে ২০জন মরজিয়া, ২৩জন কদ্রিয়া, ২৮জন শিয়া, ৪জন রাফিজী, ৯জন খারিজী, ৭জন নাসিবী ও ১জন জহ্মিয়া কর্তৃক হাদীছ শরীফ বর্ণিত হয়েছে। (সায়িকাতুল মুসলিমীন)

অতএব প্রমাণিত হলো যে, সকল ছহীহ হাদীছ শরীফ-এর কিতাবেই কারো কারো মতে কিছু সংখ্যক দ্বয়ীফ হাদীছ শরীফ রয়েছে। কাজেই, দ্বয়ীফ হাদীছ শরীফ মাত্রই পরিত্যাজ্য বা বাতিল নয়। কারণ কোন হাদীছ শরীফকে কেউ দ্বয়ীফ বলেছেন এবং অন্য আরেকজন সেটাকে ছহীহ বলেছেন। এ দ্বারা দু’টি বিষয় স্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হলো- (১) ছিহাহ সিত্তাহই শুধু ছহীহ হাদীছ শরীফ-এর কিতাব নয় বরং ছিহাহ সিত্তাহর বাইরেও বহু ছহীহ হাদীছ শরীফ-এর কিতাব রয়েছে।

(২) ছিহাহ সিত্তাহর সকল হাদীছ শরীফ ছহীহ হওয়ার ব্যাপারে সকল মুহাদ্দিছীনে কিরাম একমত নন বরং কারো মতে ছিহাহ সিত্তাহসহ সকল ছহীহ হাদীছ শরীফের কিতাবেই দ্বয়ীফ হাদীছ শরীফ রয়েছে। কাজেই যারা বলে, ছিহাহ সিত্তাহ ব্যতীত অন্য কোন হাদীছ শরীফ-এর কিতাব ছহীহ বা নির্ভরযোগ্য নয়, তাদের এ কথা নিতান্তই অজ্ঞতার পরিচায়ক।

তবে একথা সত্য যে, তুলনামূলকভাবে অন্যান্য হাদীছ শরীফ-এর কিতাব হতে ছিহাহ সিত্তাহ’র মধ্যে এবং বিশেষ করে বুখারী শরীফ-এর মধ্যে ছহীহ হাদীছ শরীফ-এর সংখ্যা বেশি রয়েছে।

তাই বলে ছিহাহ সিত্তাহ বা বুখারী শরীফে শরীয়তের কোন বিষয় উল্লেখ না থাকলে যে তা পরিত্যাজ্য বা অশুদ্ধ হবে একথা আদৌ শুদ্ধ নয়। কারণ ছিহাহ সিত্তাহ’র মধ্যে শরীয়তের সকল বিষয়ের বর্ণনা নেই এবং না থাকাটাই স্বাভাবিক। কেননা ছিহাহ সিত্তাহ’র মধ্যে তাকরার বাদ দিয়ে সর্বমোট প্রায় দশ হাজার হাদীছ শরীফ রয়েছে। তবে কি সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আনুষ্ঠানিক নুবুওওয়াত প্রকাশের ২৩ বৎসর দুনিয়াবী যিন্দিগী মুবারকে মাত্র দশ হাজার কথা বলেছেন? কস্মিনকালেও নয়।

উল্লেখ্য, যারা সর্বদা ছিহাহ সিত্তাহর দোহাই দেয়, তারাই আবার এমন অনেক আমল করছে, যার বর্ণনা ছিহাহ সিত্তাহ এ নেই। এর বহু প্রমাণ রয়েছে। কেননা শরীয়তের সকল বিষয়ের ফায়সালা ছিহাহ সিত্তাহ’র মধ্যে নেই। যেমন তারাবীহ নামায ২০ রাকায়াতই পড়তে হবে এ বর্ণনা ছিহাহ সিত্তাহ’র মধ্যে নেই। এ বর্ণনা অন্য ছহীহ হাদীছ শরীফ-এর কিতাবে রয়েছে।

সুতরাং, ছিহাহ সিত্তাহ বা বুখারী শরীফ-এর ছহীহ হাদীছ শরীফ-এর যেরূপ হুকুম, অন্যান্য কিতাবের ছহীহ হাদীছ শরীফেরও তদ্রূপ হুকুম। কারণ কেউ প্রমাণ করতে সক্ষম হবেনা যে, শরীয়তের কোথাও কোন নির্দিষ্ট হাদীছ শরীফের কিতাবকে অনুসরণ করতে বলা হয়েছে বরং আম বা সাধারণভাবে সকল হাদীছ শরীফকেই অনুসরণ করতে বলা হয়েছে।

বহু সংখ্যক আলিম বলেছেন, ছহীহ বুখারী শরীফ ও ছহীহ মুসলিম শরীফ-এর হাদীছ শরীফগুলি যে নিশ্চয়ই নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার হাদীছ শরীফ এর কোন দলীল নেই। মুসাল্লাম কিতাবের টীকা ৪১১ পৃষ্ঠায় বর্ণিত  রয়েছে, আল্লামা বাহরুল উলূম রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেছেন, হযরত ইবনু ছালাহ ও কতক আলিম যে বলেছেন, ছহীহ বুখারী শরীফ ও ছহীহ মুসলিম শরীফ-এর হাদীছ শরীফগুলি নিশ্চয়ই ছহীহ; কিন্তু ইহা ভ্রান্তিমূলক মত। কারণ ছহীহ বুখারী শরীফ ও ছহীহ মুসলিম শরীফ-এ বহু বিপরীত হাদীছ শরীফ রয়েছে। এ ছাড়া ক্বদরিয়া, খারিজী, রাফিজী, মরজিয়া ইত্যাদি বাতিল ফিরক্বার লোকদের বর্ণিত বহু হাদীছ শরীফ বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফ-এ আছে। তাহলে এ দু’ কিতাবের সমস্ত হাদীছ শরীফ কি করে ছহীহ বলে গণ্য হতে পারে?

মূলকথা হলো, ছিহাহ সিত্তাহর বর্ণিত হাদীছ শরীফগুলি উক্ত ইমামগণের স্ব স্ব ক্বিয়াস মতেই ছহীহ হিসেবে সাব্যস্ত হয়েছে।

উল্লেখ্য, অধিকাংশ আলিম বলেছেন, বুখারী শরীফ সর্বোত্তম ছহীহ কিতাব। কিন্তু মহান আল্লাহ পাক কিংবা নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনারা কেউই বলেননি বা আদেশ করেননি যে, ছহীহ বুখারী সর্বাপেক্ষা ছহীহ কিতাব। বরং খইরুল কুরূনের অনেক পরে অর্থাৎ তিনশ হিজরীর পরে অধিকাংশ আলিমগণের ইজমা হয়েছে, বুখারী শরীফ সর্বোত্তম ছহীহ কিতাব। যদিও তার মধ্যে অনেক দ্বয়ীফ হাদীছ শরীফ রয়েছে।

হযরত ইমাম শাফিয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেছেন, কুরআন শরীফ-এর পরে হযরত ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি উনার মুয়াত্তার তুল্য কোন ছহীহ কিতাব জগতে নেই। (জাফরুল আমানী)

হযরত ইমাম ইয়াহইয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেছেন, হযরত ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বর্ণিত হাদীছ শরীফ-এর তুল্য কোন ছহীহ হাদীছ শরীফ নেই। (ছহীহ তিরমিযী পৃষ্ঠা ২৩৮)

হযরত ইমাম নাসায়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, ছহীহ মুসলিম শরীফ-এর তুল্য কোন হাদীছ শরীফ-এর কিতাব নেই। ইমাম আবু আলী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, আসমানের নীচে ছহীহ মুসলিম শরীফ-এর তুল্য কোন ছহীহ কিতাব নেই।

জনৈক মাগরিবি আলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, ছহীহ মুসলিম শরীফ ছহীহ বুখারী শরীফ অপেক্ষা অধিক ছহীহ।

হযরত ইমাম দারু কুতনী, ইমাম আবু দাউদ, ইমাম নাসায়ী ও ইমাম আবু আলী রহমতুল্লাহি আলাইহিম হাদীছ শরীফ বিশেষজ্ঞগণ ছহীহ বুখারী শরীফ-এর ৮০ জন রাবীকে এবং ছহীহ মুসলিম শরীফ-এর ১৬০ জন রাবীকে দ্বয়ীফ বলেছেন।

হযরত ইমাম দারু কুতনী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনিসহ আরো কেউ কেউ ছহীহ বুখারী শরীফ-এর ৯৫টি এবং ছহীহ মুসলিম শরীফ-এর ১১৫টি হাদীছ শরীফ দ্বয়ীফ সাব্যস্ত করেছেন।

হাদীছ শরীফ বিশেষজ্ঞ আলিমগণ ছহীহ আবু দাউদ, ছহীহ তিরমিযী ও ছহীহ নাসায়ী শরীফ-এর বহু হাদীছ শরীফকে দ্বয়ীফ বলেছেন।

হযরত ইমাম বুখারী ও মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনারা হযরত ইমাম আবু দাউদ, ইমাম তিরমিযী ও ইমাম নাসায়ী রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনাদের বর্ণিত হাদীছ শরীফকে দ্বয়ীফ বলেছেন। পক্ষান্তরে উক্ত তিন ইমাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনারা হযরত ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহিমা উনাদের বর্ণিত হাদীছ শরীফকে দ্বয়ীফ বলেছেন।

উপরের আলোচনা থেকে প্রতিভাত হলো যে, বুখারী শরীফ ও মুসলিমসহ ছিহাহ সিত্তাহ’র সমস্ত হাদীছ শরীফই ছহীহ নয় বরং উক্ত প্রতিটি কিতাবে দ্বয়ীফ হাদীছ শরীফও রয়েছে। এছাড়া আরো প্রতিভাত হয়েছে যে, কেবল ছিহাহ সিত্তাহই হাদীছ শরীফ-এর ছহীহ কিতাব নয়। ছিহাহ সিত্তাহ ব্যতীত আরো ৫০টিরও বেশি ছহীহ কিতাব রয়েছে।

মূলত কথা হলো, আমাদেরকে হাদীছ শরীফ মানতে হবে বা পালন করতে হবে। আমাদের জন্য তা ফরয ওয়াজিব। তা যেখানেই থাকুক না কেন। শুধু ছিহাহ সিত্তাহর মধ্যে থাকলে মানতে হবে; অন্য কোন কিতাবে থাকলে মানা যাবে না এটা সুস্পষ্ট গোমরাহী ব্যতীত কিছু নয়।

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ