সুওয়াল-জাওয়াব

সংখ্যা: ২৮৮তম সংখ্যা | বিভাগ:

মুহম্মদ রিদ্বওয়ানুল্লাহ পাটওয়ারী, শাহজাহানপুর, ঢাকা

সুওয়াল: “একত্রে তিন তালাক দিলেও এক তালাক হিসেবে গণ্য হবে” এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর যাত্রাবাড়ীর মাদরাসা মুহাম্মাদীয়া আরাবীয়ার মুফতী মোঃ ঈসা মিঞা কতৃর্ক প্রদত্ব ফতওয়াটি ‘মুহম্মদিয়া জামিয়া শরীফ গবেষণাকেন্দ্র, রাজারবাগ দরবার শরীফ, ঢাকা’ বরাবর প্রেরণ করলাম। আশাকরি, পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ উনাদের আলোকে উক্ত ফতওয়াটি যাচাই করে সঠিক জাওয়াব দিয়ে বিভ্রান্তি নিরসন করবেন।

জাওয়াব: ঢাকা শাহজাহানপুর নিবাসী মুহম্মদ রিদওয়ানুল্লাহ পাটোয়ারী কর্তৃক প্রেরিত “একত্রে তিন তালাক দিলেও এক তালাক হিসেবে গণ্য হবে” এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর যাত্রাবাড়ীর মাদরাসা মুহাম্মাদীয়া আরাবীয়ার কথিত মুফতী ঈসা মিঞা কতৃর্ক প্রদত্ব ফতওয়াটির তাহক্বীক্বে এবং এ সুওয়ালের সঠিক জাওয়াবে কয়েকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য।

প্রথমত, তালাক্ব সংক্রান্ত ঈসা মিঞার স্বাক্ষরিত ফতওয়াটি মোটেও সঠিক হয়নি। তা সম্পূর্ণ মনগড়া, বিভ্রান্তিকর এবং অনুসরণীয় আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত উনাদের খিলাফ বা বিরোধী হওয়ার কারণে কুফরী হয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে সঠিক ফতওয়া হচ্ছে, একত্রে তিন তালাক দিলে তিন তালাকই পতিত বা সাব্যস্ত হবে। তা যে কোন অবস্থাতেই দেয়া হোক না কেন। এটাই অনুসরণীয় আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত সকল ইমাম-মুজতাহিদ উনাদের ফতওয়া। এর বিপরীত হচ্ছে লা-মাযহাবী ইত্যাদি বদ আক্বীদা ও বাতিল ফিরক্বার লোকদের ফতওয়া।

অতএব, এটি আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত উনার ফতওয়া নয়। বরং এ ফতওয়াটি লা-মাযহাবী বা মাযহাবকে অস্বীকারকারী সম্প্রদায়ের। সঙ্গতকারণেই এ ফতওয়াটি আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত অর্থাৎ হানাফী, শাফেয়ী, মালেকী এবং হাম্বলী মাযহাব অনুসরনকারীগণ উনাদের নিকট কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়, কখনোই অনুসরনীয়ও নয় বরং সম্পূর্ণ পরিত্যাজ্য।

দ্বিতীয়ত, ফতওয়াদাতা ঈসা মিঞা আহলে হাদীছ বা লা-মাযহাবী অথার্ৎ মাযহাবকে অস্বীকারকারী সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। সম্মানিত আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত উনাদের আক্বীদাহ বিরোধী কোন ব্যক্তিকে অনুসরণ করা জায়িয নেই। পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার বিশুদ্ধ কিতাব “মুসলিম শরীফে” বর্ণিত রয়েছে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

فَانْظُرُوْا عَمَّنْ تَأْخُذُوْنَ دِيْـنَكُمْ

অর্থ: “তোমরা কার নিকট থেকে দ্বীন তথা ইলিম গ্রহণ করছো তাকে দেখে নাও।”

অর্থাৎ কারো নিকট থেকে সম্মানিত দ্বীন ইসলাম সম্পর্কে তথা শরীয়তের মাসয়ালা-মাসায়িল জানতে হলে তার আক্বীদা ও আমল আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত মুতাবিক কি না তা সর্বপ্রথম যাচাই-বাছাই করতে হবে। যদি আক্বীদা-আমল আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত মুতাবিক হয় তবে তাকে অনুসরণ করা যাবে এবং তার প্রদত্ব মাসয়ালা বা ফতওয়া গ্রহন করা যাবে। আর যদি আক্বীদা-আমল আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত উনাদের খিলাফ হয় তাহলে তাকে অনুসরণও করা যাবে না এবং তার কোন ফতওয়া বা মাসয়ালাও গ্রহন করা যাবে না।

কাজেই, আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত উনাদের ফতওয়া অনুযায়ী লা-মাযহাবী বা মাযহাবকে অস্বীকারকারীরা বাতিল ৭২ ফিরক্বার অন্তর্ভুক্ত।তারা কখনোই অনুসরণীয়-অনুকরণীয় নয়। কেননা, পবিত্র হাদীছ শরীফে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

عَنْ حَضْرَتْ مُعَاوِيَةَ رَضِيَ اللهُ تَـعَالٰي عَنْهُ قَالَ : أَلَا إِنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَامَ فِيْـنَا فَـقَالَ… وَتَـفْتَرِقُ أُمَّتِيْ عَلٰى ثَلَاثٍ وَّسَبْعِيْنَ مِلَّةً كُلُّهُمْ فِي النَّارِ إِلَّا مِلَّةً وَّاحِدَةً ، قَالُوْا : وَمَنْ هِيَ يَا رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ؟ قَالَ : مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِيْ

অর্থ: হযরত মুআবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, সাবধান! নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আমাদের মাঝে পবিত্র খুতবা মুবারক প্রদানকালে ইরশাদ মুবারক করেন, ……আমার উম্মত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে। একটি দল ব্যতীত বাহাত্তরটি দলই জাহান্নামে যাবে। তখন হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা বললেন, ‘ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম! যে একটি দল নাযাতপ্রাপ্ত সে দলটি কোন দল?’ নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, আমি এবং আমার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের মত ও পথের উপর যারা কায়িম থাকবে (উনারাই নাযাতপ্রাপ্ত দল)। (তিরমিযী শরীফ)

মুহাদ্দিছীনে কিরাম উনাদের ইজমা অনুযায়ী, পবিত্র হাদীছ শরীফে বর্ণিত নাযাতপ্রাপ্ত এ দলটি হচ্ছেন সম্মানিত আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত। আর আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত হলেন হানাফী, মালিকী, শাফিয়ী ও হাম্বলী মাযহাবভুক্ত উনারা। অপর দিকে পবিত্র শরীয়ত উনার উছূল পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, পবিত্র ইজমা শরীফ ও পবিত্র ক্বিয়াস শরীফ অস্বীকারকারী শিয়া, খারেজী, রাফেজী, মুতাযিলা, ওহাবী এবং লা-মাযহাবী বা মাযহাব অস্বীকারকারী এরা সবাই পবিত্র হাদীছ শরীফে ঘোষিত বাতিল ৭২ ফিরক্বার অন্তর্ভুক্ত। তাই, আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত উনাদের নিকট ঈসা মিঞার ফতওয়াটি অবশ্যই পরিত্যাজ্য।

বলা বাহুল্য যে, আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত উনাদের ফতওয়া অনুযায়ী, মিথ্যা নুবুওওয়াতের দাবিদার কাদিয়ানী ও বাহাই সম্প্রদায় যেরূপ গোমরাহ, তদ্রƒপ বাতিল ৭২ ফিরক্বার অন্তর্ভুক্ত লা-মাযহাবীরাও গোমরাহ।

তৃতীয়ত, তথাকথিত আহলে হাদীছ দাবীদার বা লা-মাযহাবীরা সম্মানিত শরীয়ত উনার বিশেষ বিধান ‘নাসেখ-মানসূখ’ মানেনা। যার কারণে তারা সব বিষয়ে বিভ্রান্তিতে পতিত হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় তালাক্ব সংক্রান্ত বিষয়েও তারা বিভ্রান্তিতে পড়েছে। ফতওয়াদাতা যে সমস্ত দলীল উল্লেখ করেছে, সেগুলোর মধ্যে কিছু দলীল সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার প্রাথমিক যুগের। যা মানসূখের অন্তর্ভুক্ত। সেগুলো চূড়ান্ত ফায়ছালা নয় এবং বর্তমানে আমলযোগ্যও নয়।

একত্রে তিন তালাক বিষয়ে শরয়ী বিধান

আহলিয়া বা স্ত্রীর উপর তালাক আরোপিত হওয়া সম্পর্কে সম্মানিত শরীয়ত উনার মধ্যে তিনটি ছূরত বর্ণিত হয়েছে। (১) তালাকে আহ্সান: আহলিয়াকে এক তুহুর বা পবিত্রতাকালে (যাতে জেমা বা ওতি হয়নি) এক তালাক দিয়ে ইদ্দত পর্যন্ত রেখে দেয়াকে তালাকে আহসান বলে। (২) তালাকে হাসান বা সুন্নত: আহলিয়াকে তিন তুহুরে তিন তালাক দেয়া। নাবালেগা, ছন্নে আয়েছা, হামেলা বা গর্ভবতী আহলিয়াকে তিন মাসে তিন তালাক দেয়া। আর যে আহলিয়ার সাথে জেমা বা ওতি করা হয়নি তাকে তুহুরের মধ্যে অথবা গইরে তুহুরের মধ্যে এক তালাক দেয়াকেও হাসান তালাক বলে। (৩) তালাকে বেদয়ী বা তালাকে বিদয়াত : এক কথায় বা একত্রে তিন তালাক দেয়াকে তালাকে বিদয়াত বলে। তাছাড়া এক তুহুরে বা এক গইরে তুহুরে তিন তালাক দেয়াকেও তালাকে বেদ্য়ী বা বিদয়াত তালাক বলে।

সম্মানিত শরীয়ত কখনো কাউকে তালাক দেয়ার জন্য উৎসাহিত করে না। তবে যদি আহাল (স্বামী) এবং আহলিয়া বা স্ত্রীর মধ্যে কোন অবস্থাতেই একত্রে বসবাস করা সম্ভব না হয় তখন পরস্পর পরস্পর থেকে আলাদা বা জুদা হতে হবে আর এ জুদা হওয়ার পদ্ধতিকেই তালাক বলা হয়। এই তালাকের মধ্যে উত্তম হচ্ছে আহ্সান তালাক দেয়া অথবা হাসান তালাক দেয়া। তবে এক সঙ্গে তিন তালাক দিলে তিন তালাকই পতিত হবে। চাই তা গোস্বা হয়ে দিক বা খুশি হয়ে দিক অথবা ইচ্ছায় দিক কিংবা অনিচ্ছায় দিক। এ সম্পর্কে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

ثَـلٰثٌ جِدُّهُنَّ جِدٌّ وَهَزْلُـهُنَّ جِدٌّ اَلنِّكَاحُ وَالطَّلَاقُ وَالرَّجْعَةُ

অর্থ: “তিনটি বিষয় এমন রয়েছে যা গোস্বায় হোক বা হাসি ঠাট্টায় হোক সর্বাবস্থায় কার্যকরী হয়ে থাকে- বিবাহ, তালাক ও রাজয়াত।” (তিরমিযী শরীফ, আবূ দাউদ শরীফ, মিশকাত শরীফ/২৮৪)

এ বিষয়ে মাযহাবের চার ইমামই একমত পোষণ করেছেন। অথার্ৎ আহ্লে সুন্নত ওয়াল জামায়াত উনাদের ফতওয়া হচ্ছে- একত্রে তিন তালাক দিলে তিন তালাকই পতিত হবে। তা যে কোন অবস্থাতেই দেয়া হোক না কেন।

চতুর্থত, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি তালাক সংক্রান্ত বিষয়ে শেষ যে ফায়ছালা মুবারক দিয়েছেন বা তালাক্ব বিষয়ে চূড়ান্ত ফায়ছালা মুবারক দিয়ে যে পবিত্র আয়াত শরীফ নাযিল হয়েছে ও পবিত্র হাদীছ শরীফ বর্ণিত হয়েছে, সেগুলোই আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত উনাদের দলীল। যথা-

তিন তালাক প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

فَاِنْ طَلَّقَهَا فَلَا تَحِلُّ لَهٗ مِنْ بَعْدُ حَتّٰى تَنْكِحَ زَوْجًا غَيْرَهٗ

অর্থ: যদি আহাল তার আহলিয়াকে (তিন) ত্বালাক্ব দেয়, তবে সে আহলিয়া যে পর্যন্ত না অপর কোন আহাল বা স্বামীর সাথে বিবাহ বসবে, সে পর্যন্ত তার জন্য হালাল হবে না। (সম্মানিত ও পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ: সম্মানিত ও পবিত্র আয়াত শরীফ ২৩০)

এ আয়াত শরীফ উনার ব্যাখ্যায় ‘তাফসীরে সাবীতে’ বর্ণিত হয়েছে-

وَالْمَعْنٰى فَاِنْ ثَـبَتَ طَلَاقُـهَا ثَلَاثًا فِىْ مَرَّةٍ اَوْمَرَّاتٍ فَلَا تَحِلُّ لَهٗ (الاية) كَمَا اِذَا قَالَ لَـهَا اَنْتِ طَالِقٌ ثَلَاثًا اَوِالْبَـتَّةَ وَهٰذَا هُوَ الْمُجْمِعُ عَلَيْهِ

অথার্ৎ, উলামায়ে উম্মত এ ব্যাপারে একমত যে, তিন তালাক পৃথক পৃথক দেয়া হোক অথবা একসঙ্গে দেয়া হোক আহলিয়া (স্ত্রী) হালাল থাকবে না অথার্ৎ হারাম হয়ে যাবে।

আর পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যেও ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

عَنْ حَضْرَتْ عَلِىٍّ عَلَيْهِ السَّلَامُ مَرْفُـوْعًا اَيُّـمَا رَجُلٍ طَلَّقَ  اِمْرَأَتَهٗ ثَلَاثًا مُبْهَمَةً اَوْ ثَلَاثًا عِنْدَ الْاَقْـرَاءِ لَـمْ تَحِلُّ لَهٗ حَتّٰى تَـنْكِحَ زَوْجًا غَيْـرَهٗ

অর্থ: সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামুল আউওয়াল কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহূ আলাইহিস সালাম তিনি মারফ’ু সনদে বর্ণনা করেন, কোনো ব্যক্তি যদি তার আহলিয়াকে একত্রে তিন ত্বালাক্ব  দেয় অথবা তিন তুহুরে তিন তালাক দেয় তবে সেই আহলিয়া তার জন্য হালাল হবে না, যতক্ষণ না সে অন্য আহালকে বিবাহ করে।” (দারু কুতনী, ফিকহুস সুনান ওয়াল আছার-২/৭৫)

পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

عَنْ حَضْرَتْ مُعَاذٍ رَضِىَ اللهُ تَـعَالٰى عَنْهُ مَرْفُـوْعًا مَنْ طَلَّقَ لِلْبِدْعَةِ وَاحِدَةً اَوْ اِثْـنَـتَـيْنِ اَوْ ثَلَاثًا اَلْزَمْنَاهُ بِدْعَتَهٗ

অর্থ: হযরত মুয়ায রদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহু তিনি মারফ’ু সনদে বর্ণনা করেন, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, যদি কেউ বিদয়াত পদ্ধতিতে এক, দুই বা তিন তালাক প্রদান করে, তবে আমরা তাকে তার বিদয়াত মানতে বাধ্য করবো। (দারু কুতনী)

ইবনে মাজাহ শরীফে مَنْ طَلَّقَ ثَلَاثًا فِىْ مَجْلِسٍ وَاحِدٍ অথার্ৎ ‘একই মজলিসে তিন তালাক দেয়া’ শীর্ষক অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে-

اِنَّ فَاطِمَةَ بِنْتَ قَـيْسٍ قَالَتْ طَلَّقَنِىْ زَوْجِىْ ثَـلٰثًا وَهُوَ خَارِجٌ اِلَى الْيَمَنِ فَاَجَازَ ذَالِكَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ

অর্থ: হযরত ফাতিমা বিনতে কায়েস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বলেন, আমাকে আমার আহাল ইয়ামেন যাওয়ার প্রাক্কালে একসঙ্গে তিন তালাক দিয়ে দেন। নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উক্ত তিন তালাককে কার্যকর বলেছেন।

পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

عَنْ حَضْرَتْ عَلِىٍّ عَلَيْهِ السَّلَامُ قَالَ سَمِعَ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَجُلًا طَلَّقَ الْبَـتَّةَ فَـغَضِبَ وَقَالَ يَـتَّخِذُوْنَ اٰيَاتِ اللهِ هُزُوًا. مَنْ طَلَّقَ الْبَـتَّةَ اَلْزَمْنَاهُ ثَلَاثًا لَا تَحِلُّ لَهٗ حَتّٰى تَـنْكِحَ زَوْجًا غَيْـرَهٗ

অর্থ: “সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামুল আউওয়াল কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহূ আলাইহিস সালাম তিনি বলেন, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি শুনতে পেলেন যে, এক ব্যক্তি তার আহলিয়াকে “আলবাত্তা” বা চুড়ান্ত ত্বালাক্ব দিয়েছে। তখন তিনি জালালী শান মুবারক প্রকাশ করলেন এবং ইরশাদ মুবারক করলেন, তারা মহান আল্লাহ পাক উনার আয়াতসমূহকে তামাশার বিষয় বানিয়ে নিচ্ছে। যে ব্যক্তি “আল বাত্তা” বা চুড়ান্ত ত্বালাক্ব  দিবে আমরা তার সেই ত্বালাক্বকে তিন ত্বালাক্ব  হিসেবে গণ্য করবো। সেই আহলিয়া তার জন্য হালাল হবে না, যতক্ষণ না সে অন্য কোনো আহালকে বিবাহ করে। (নাসায়ী শরীফ, দারু কুতনী, ফিকহুস সুনান ওয়াল আছার-২/৭৫)

পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

عَنْ حَضْرَتْ اِبْنِ عُمَرَ رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُ اَنَّهٗ طَلَّقَ اِمْرَأَتَهٗ تَطْلِيْقَةً وَهِىَ حَائِضٌ ثُمَّ اَرَادَ اَنْ يَّتْبَعَهَا بِتَطْلِيْقَتَيْنِ اُخْرَاوَيْنِ عِنْدَ الْقُرْئَيْنِ الْبَاقِيَيْنِ فَبَلَغَ ذٰلِكَ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَـقَالَ يَا اِبْنَ عُمَرَ رَضِىَ اللهُ تَـعَالٰى عَنْهُ مَا هٰكَذَا اَمَرَ اللهُ اَخْطَأْتَ السُّنَّةَ وَالسُّنَّةُ اَنْ تَسْتَـقْبِلَ الطُّهْرَ فَـتُطَلِّقَ لِكُلِّ قُـرْءٍ فَاَمَرَنِىْ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَـرَاجَعْتُـهَا ثُمَّ قَالَ اِذَا هِىَ حَاضَتْ ثُمَّ طَهُرَتْ فَطَلِّقْ عِنْدَ ذَالِكَ وَ اَمْسِكْ فَـقُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَوْ طَلَّقْتُـهَا ثَلَاثًا كَانَ لِىْ اَنْ اُرَاجِعَهَا قَالَ لَا كَانَتْ تَبِيْنُ مِنْكَ وَتَكُوْنُ مَعْصِيَةٌ

অর্থ: “হযরত ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত, তিনি উনার আহলিয়াকে স্বাভাবিক মাজুর অবস্থায় ত্বালাক্ব  দেন। এরপর তিনি ইচ্ছা করেন যে, পরবর্তী দুই তুহুর বা পবিত্রতায় উনাকে বাকি দুই ত্বালাক্ব  দিবেন। তার পূর্বে বিষয়টি নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খিদমত মুবারকে পেঁৗছে যায়। তখন তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, হে হযরত ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু! মহান আল্লাহ পাক তিনি এভাবে ত্বালাক্ব  দেয়ার নির্দেশ মুবারক দেননি। আপনার দ্বারা সম্মানিত সুন্নত উনার খিলাফ কাজ সংঘটিত হয়েছে। সম্মানিত সুন্নত হলো- আপনি তুহুর বা পবিত্রতার জন্য অপেক্ষা করবেন এবং প্রত্যেক তুহুর বা পবিত্রতায় একবার ত্বালাক্ব  দিবেন। তখন নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নির্দেশ মুতাবিক আমি আমার আহলিয়াকে রাজায়াত করলাম বা ফিরিয়ে নিলাম। অতঃপর তিনি আমাকে বলেন, যখন আপনার আহলিয়া স্বাভাবিক মাজুর হবেন এবং এরপর পবিত্র হবেন তখন আপনি উনাকে ত্বালাক্ব  প্রদান করবেন এবং নিজেকে বিরত রাখবেন। আমি বললাম, ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! যদি আমি উনাকে তিন ত্বালাক্ব  দিতাম তাহলে কি আর ফিরিয়ে নিতে পারতাম? তিনি বললেন, না। সেক্ষেত্রে তিনি স্থায়ীভাবে আপনার থেকে পৃথক হয়ে যেতেন এবং এভাবে ত্বালাক্ব  দেয়া গুনাহের কারণ হতো। (দারু কুতনী ও তবারানী শরীফ, ফিক্বহুস সুনান ওয়াল আছার-২/৭৪)

ফিক্বাহ-ফতওয়ার বিখ্যাত ও প্রসিদ্ধ কিতাব হিদায়া কিতাবে বর্ণিত হয়েছে-

وَطَلَاقُ الْبِدْعَةِ اَنْ يُّطَلِّقَهَا ثَلَاثًا بِكَلِمَةٍ وَاحِدَةٍ اَوْ ثَلَاثًا فِىْ طُهْرٍ وَاحِدٍ فَاِذَا فَـعَلَ ذَالِكَ وَقَعَ الطَّلَاقُ وَكَانَ عَاصِيًا هٰكَذَا فِى الْعِنَايَةِ

অর্থাৎ- একসাথে তিন তালাক দেয়া অথবা একই তুহুরে তিন তালাক দেয়াকে তালাকে বিদয়াত বলে। কেউ এরুপ করলে তালাক পতিত হবে। কিন্তু তালাকদাতা গুনাহগার হবে। এরূপ ইনায়া কিতাবেও বর্ণিত রয়েছে।

ফিক্বাহ্র প্রসিদ্ধ কিতাব ‘শরহে বিক্বায়া’র মধ্যে বর্ণিত হয়েছে-

وَعِنْدَنَا الثَّلَاثُ دَفَـعَةُ سُنِّىٍّ اَلْوُقُـوْعُ اَىْ وُقُـوْعُهَا مَذْهَبُ اَهْلِ السُّنَّةِ وَعِنْدَ الرَّوَافِضِ لَايَـقَعُ هٰكَذَا فِى الْفَتْحِ

অথার্ৎ- আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের মাযহাব অনুযায়ী তিন তালাক এক সঙ্গে দিলে তা পতিত হবে। তবে রাফেজী বা শিয়াদের মতে হবে না। এটা ফতহুল ক্বাদীর কিতাবের মধ্যেও বর্ণিত হয়েছে।

শরহে বিক্বায়া’র হাশিয়া উমদাতুর রেওয়াইয়াহ কিতাবে লিখিত আছে-

قَدْ ثَـبَتَ فِى الصِّحَاحِ السِّتَّةِ وَغَيْرِهَا اَنَّ اِبْنَ عُمَرَ رَضِىَ اللهُ تَـعَالٰى عَنْهُ طَلَّقَ اِمْرَأَتَهٗ حَالَةَ الْـحَيْضِ وَهُوَ مَـمْنُـوْعٌ شَرْعًا فَاَمَرَهُ الرَّسُوْلُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِالرَّجْعَةِ وَلَوْلَا وُقُـوْعُهٗ لَـمْ يَأْمُرْهُ باِلرَّجْعَةِ اِذْ لَا رَجْعَةَ اِلَّا بَـعْدَ تَـرَتُّبِ الطَّلَاقِ-

অথার্ৎ- ছিহাহ সিত্তাহ সহ অন্যান্য কিতাবে বর্ণিত হয়েছে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি স্বীয় আহলিয়াকে মাজুরতা (হায়েজ) অবস্থায় তালাক দেন, অথচ তা শরীয়তে নিষিদ্ধ। এতদ্সত্বেও নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উনাকে উক্ত আহলিয়াকে রাজয়াত করতে র্নিদেশ মুবারক দেন। যদি তালাক পতিত না হতো তাহলে তিনি উনাকে রাজয়াতের হুকুম দিতেন না। কেননা তালাকের বিধান সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত রাজয়াত হয় না।

উপরে উল্লেখিত পবিত্র আয়াত শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, বিখ্যাত ও প্রসিদ্ধ ফিক্বাহ ও ফতওয়ার কিতাব সমূহের দ্বারা সুস্পষ্ট এবং অকাট্টভাবে প্রমাণিত যে, একত্রে তিন তালাক দিলে তিন তালাকই পতিত হবে। তা যে কোন অবস্থাতেই দেয়া হোক না কেন। এটাই অনুসরণীয় আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত উনাদের দলীলভিত্তিক ফতওয়া। এর বিপরীত হচ্ছে লা-মাযহাবী, সালাফী, রাফেজী ইত্যাদি বদ আক্বীদা ও বাতিল ফিরক্বার লোকদের মনগড়া ফতওয়া।

স্মরণীয় যে, ঈসা মিঞা “একত্রে তিন তালাক দিলে এক তালাক পতিত হবে” এটা প্রমাণ করতে গিয়ে যে ৫টি দলীল পেশ করেছে তন্মধ্যে ১নং, ৪নং ও ৫নং দলীল হচ্ছে ১ বা ২ তালাক সম্পর্কিত। আর ২নং দলীল হিসেবে যে হাদীছ শরীফ উল্লেখ করেছে তা প্রথম দিকের আমল যা পরবর্তীতে মানসূখ (রহিত) হয়েছে। আর ৩নং দলীল হিসেবে যে হাদীছ শরীফ উল্লেখ করেছে তা জয়ীফ। অর্থাৎ তার উল্লেখিত ১টি দলীল দ্বারাও একত্রে ৩ তালাক দিলে এক তালাক পতিত হবে একথা প্রমাণিত হয় না। নিম্নের খণ্ডনমূলক আলোচনা দ্বারা তা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হবে ইংশাআল্লাহ!

ঈসা মিঞা কর্তৃক প্রদত্ত ফতওয়ার ১ নং দলীলের খণ্ডন ও সঠিক ব্যাখ্যা:

اَلطَّلَاقُ مَرَّتَانِ فَاِمْسَاكٌ بِمَعْرُوْفٍ اَوْ تَسْرِيْحٌ بِاِحْسَانٍ

 উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মূল বক্তব্য বা ব্যাখ্যা হচ্ছে, রেজয়ী তালাক দু’টি অথার্ৎ দুই তালাক পর্যন্ত আহলিয়াকে বিনা তাহলীলে ফিরিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু দুইয়ের বেশি অথার্ৎ তিন তালাক দিলে দ্বিতীয় আহাল (স্বামী) গ্রহন করতঃ তালাকপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত তার জন্য সেই আহলিয়া হালাল হবে না। যা তাফসীরে সাবী, তাফসীরে জালালাইন সহ প্রায় সমস্ত তাফসীরের কিতাবে উল্লেখ রয়েছে। যেমন- فَاِنْ طَلَّقَهَا فَلَا تَحِلُّ لَهٗ  এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার ব্যাখ্যায় তাফসীরে সাবীতে বর্ণিত হয়েছে-

وَالْمَعْنٰى فَاِنْ ثَـبَتَ طَلَاقُـهَا ثَلَاثًا فِىْ مَرَّةٍ اَوْمَرَّاتٍ فَلَا تَحِلُّ لَهٗ (الاية) كَمَا اِذَا قَالَ لَـهَا اَنْتِ طَالِقٌ ثَلَاثًا اَوِالْبَـتَّةَ وَهٰذَا هُوَ الْمُجْمِعُ عَلَيْهِ

অথার্ৎ, উলামায়ে উম্মত এ ব্যাপারে একমত যে, তিন তালাক পৃথক পৃথক দেয়া হোক অথবা একসঙ্গে দেয়া হোক আহলিয়া (স্ত্রী) হালাল থাকবে না অথার্ৎ হারাম হয়ে যাবে।

স্মরণীয় যে, হারাম কাজের দ্বারা কখনো বিধান পরিবর্তন হয় না। রমাদ্বান শরীফ মাসে দিনের বেলা পানাহার করা হারাম। কিন্তু কেউ পানাহার করলে রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে। তদ্রƒপ একসঙ্গে তিন তালাক দেয়া হারাম। কোন আহাল যদি তার আহলিয়াকে এক সঙ্গে তিন তালাক দেয়, সে গুনাহগার হবে সত্যি তবে উক্ত আহলিয়ার প্রতি তিন তালাকই পতিত হবে। যেমন মুসলিম শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ শরহে নববীতে اَلطَّلَاقُ الثَّـلٰثُ শীর্ষক অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে-

مَنْ قَالَ لِاِمْرَأَتِهٖ اَنْتِ طَالِقٌ ثَلَاثٌ فَـقَالَ الشَّافِعِىُّ وَمَالِكٌ وَاَبُـوْ حَنِيْـفَةَ وَاَحْمَدُ وَجَمَاهِيْـرُ الْعُلَمَاءِ مِنَ السَّلَفِ وَالْـخَلَفِ يَـقَعُ الثَّلَاثَ

অথার্ৎ, কোন ব্যক্তি স্বীয় আহলিয়াকে যদি বলে, তোমাকে তিন তালাক দিলাম তাহলে তিন তালাকই সাব্যস্ত হবে বলে মাযহাবের চার ইমাম এবং পূর্বের ও পরের অনুসরণীয় সকল উলামায়ে কিরাম অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

কাজেই, ঈসা মিঞার প্রদত্ত উপরোক্ত আয়াত শরীফের দলীল দ্বারা “একত্রে তিন তলাক দিলে এক তালাক হবে” একথা কোনভাবেই প্রমাণিত হয় না। বরং উক্ত আয়াত শরীফে দুই তালাকের কথা বর্ণিত হয়েছে।

ঈসা মিঞা কর্তৃক প্রদত্ত ফতওয়ার ২ নং দলীলের খণ্ডন ও সঠিক ব্যাখ্যা:

সে মুসলিম শরীফে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে নিম্নে বর্ণিত হাদীছ শরীফখানা উল্লেখ করেছে যে, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার যুগে, হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম উনার যুগে এবং হযরত ফারূক্বে আ’যম আলাইহিস সালাম উনার খিলাফতের প্রথম দুই বছর তালাক ছিল তিন তালাকে এক তালাক। পবিত্র হাদীছ শরীফখানা উনার ইবারত হচ্ছে-

عَنْ اِبْنِ عَبَّاسٍ رَضِىَ اللهُ تَـعَالٰى عَنْهُ قَالَ كَانَ الطَّلاَقُ عَلٰى عَهْدِ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَبِيْ بَكْرٍ وَسَنَـتَـيْنِ مِنْ خِلَافَةِ عُمَرَ طَلَاقُ الثَّلاَثِ وَاحِدَةً

এর জাওয়াবে বলতে হয় যে, তিন তালাকে এক তালাকের বিধানটি মানসূখ বা রহিত হয় যা ব্যাখ্যা সাপেক্ষ।

উল্লেখ্য, প্রথম যামানায় প্রথমে তিন তালাকে এক তালাকের হুকুম ছিল। পরবতীর্ সময় তিন তালাককে তিন তালাক হিসেবে হুকুম জারী করা হয়। যা পবিত্র হাদীছ শরীফেই বর্ণিত রয়েছে। পরবতীর্ হুকুম সর্বত্র না পৌছার কারণে ইখতিলাফ সৃষ্টি হয় যে, তিন তালাকে তিন তালাক হবে না এক তালাক হবে। এ বিষয়টি হযরত ফারুক্বে আ’যম আলাইহিস সালাম উনার নিকট পেশ করা হয়। তখন তিনি পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের আলোকে তাহক্বীক্ব করে ফতওয়া দেন যে, এখন থেকে তিন তালাকে তিন তালাকই পতিত হবে।

আরো উল্লেখ্য, আমীরুল মু’মিনীন হযরত ফারূক্বে আ’যম আলাইহিস সালাম তিনি হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের উপস্থিতিতেই তিন তালাককে তিন তালাক হিসেবে গণ্য করার ফতওয়া দেন এবং বিধান জারি করেন। তখন কোন ছাহাবী এমনকি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনিও এ বিষয়ে কোনরূপ আপত্তি করেননি। বরং হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকেই মুসলিম শরীফে কিতাবুত তালাকের اَلطَّلَاقُ الثَّـلٰثُ শীর্ষক অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে যে, আমীরুল মু’মিনীন হযরত ফারূক্বে আ’যম আলাইহিস সালাম উনার খিলাফতকালে তিনি পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের মাধ্যমে ইজতিহাদ করে ফতওয়া দেন যে, এক সঙ্গে তিন তালাক দিলে তিন তালাকই কার্যকরী হবে।

অতএব, এই ফতওয়া হযরত ফারুক্বে আ‘যম আলাইহিস সালাম উনার ব্যক্তিগত কোন মত নয় বরং তিনি পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের আলোকে ফতওয়া দিয়েছেন। পবিত্র হাদীছ শরীফখানা উনার মূল ইবারত হচ্ছে-

فَـقَالَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ إِنَّ النَّاسَ قَدِ اسْتَعْجَلُوْا فِيْ أَمْرٍ قَدْ كَانَتْ لَهُمْ فِيْهِ أَنَاةٌ فَـلَوْ أَمْضَيْـنَاهُ عَلَيْهِمْ فَأَمْضَاهُ عَلَيْهِمْ ‏.‏

অর্থ: অতঃপর হযরত ফারূক্বে আ’যম আলাইহিস সালাম তিনি বললেন, যে বিষয়ে মানুষের জন্যে ধীর ও বিলম্বের বিধান ছিল সে বিষয়ে তারা তাড়াহুড়া করছে। আমরা যদি তাদের জন্য তা বাস্তবায়ন করে দেই (তাহলে ভাল হয়)। তখন তিনি তাদের উপর তা বাস্তবায়ন বা জারি করে দিলেন।

শুধু তাই নয়, হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনারই প্রদত্ব ফতওয়া হচ্ছে, এক সঙ্গে তিন তালাক দিলে তিন তালাকই সাব্যস্ত হবে। যেমন ‘বায়হাক্বী শরীফে’ হযরত সাঈদ ইবনে হাবীব রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার রেওয়ায়েতক্রমে বর্ণিত হয়েছে-

عَنْ اِبْنِ عَبَّاسٍ رَضِىَ اللهُ تَـعَالٰى عَنْهُ اَنَّهٗ قَالَ لِرَجُلٍ طَلَّقَ اِمْرَأَتَهٗ ثَـلٰثًا حُرِمَتْ عَلَيْكَ

অথার্ৎ- হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি ঐ ব্যক্তিকে বললেন যিনি তার আহলিয়াকে এক সঙ্গে তিন তালাক দিয়েছিলেন যে, আপনার উপর আপনার আহলিয়া হারাম হয়ে গেছে।

‘বায়হাক্বী শরীফে’ আরো বর্ণিত হয়েছে-

اِنَّ رَجُلًا قَالَ لِاِبْنِ عَبَّاسٍ رَضِىَ اللهُ تَـعَالٰى عَنْهُ طَلَّقَتْ اِمْرَأَتِىْ مِائَةً قَالَ تَأْخُذُ ثَلَاثًا وَتَدَعُ سَبْـعًا وَّتِسْعِيْنَ

অথার্ৎ, জনৈক ব্যক্তি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার সমীপে বললেন, আমি আমার আহলিয়াকে একশত তালাক দিয়েছি। তিনি বললেন, তিনটা গ্রহণ করো। আর অবশিষ্ট সাতানব্বইটি বাদ দাও।

উক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার ব্যাখ্যায় ‘শরহে নববীতে’ উল্লেখ আছে, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তালালা আনহুম উনাদের ইজমা’ বা ঐক্যমত হচ্ছে, তিন তালাক দ্বারা তিন তালাকই সাব্যস্ত হবে। আর হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তালালা আনহুম উনারা কোন ভ্রান্ত বিষয়ের উপর একমত হতে পারেন না। তাছাড়া আহালের (স্বামীর) যেখানে তিন তালাক দেয়ার অধিকার রয়েছে সেখানে তিন তালাক দিলে এক তালাক সাব্যস্ত হবে কিসের ভিত্তিতে।

জানা আবশ্যক, “একত্রে তিন তালাক দিলে তিন তালাকই সাব্যস্ত হবে” এ বিষয়ে আমীরুল মু’মিনীন হযরত ফারূক্বে আ’যম আলাইহিস সালাম উনার ইজতিহাদ কখনোই সাময়িক ছিল না। বরং তা ছিল সার্বজনিন। ফলে উনার উক্ত ইজতিহাদ মুবারকের পর পূর্ব যুগের ইখতিলাফ রহিত হয়ে গেছে। যেমন উনার ইজতিহাদ ও আদেশ মুবারক উনার কারণে রহিত হয়ে গেছে মসজিদ ও ঈদগাহে মহিলাদের জামায়াতে হাজির হওয়ার বিধান। প্রকৃতপক্ষে উনার ইজতিহাদ মুবারক হচ্ছে সুন্নত মুবারক উনার অন্তর্ভুক্ত এবং তা পালন করা ফরয। এ সম্পর্কে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

عَلَيْكُمْ بِسُنَّتِىْ وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِيْنَ الْمَهْدِيِّيْنَ تَمَسَّكُوْا بِهَا وَعَضُّوْا عَلَيْهَا بِالنَّـوَاجِذِ

অর্থ: নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, আমার সুন্নত মুবারক এবং সুপথপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীন আলাইহিমুস সালাম উনাদের সুন্নত মুবারক পালন করা তোমাদের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য। তা মাড়ির দাঁত দিয়ে শক্ত করে আকড়ে ধরে থাক। (আবূ দাউদ শরীফ, মিশকাত শরীফ, শরহুস সুন্নাহ শরীফ ইত্যাদি)

উল্লেখ্য, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার এবং হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম উনাদের যামানার লোকেরা তিন তালাক এভাবে দিতেন- তোমাকে তালাক, তালাক, তালাক। সম্ভবতঃ শেষের দুই তালাক প্রথম তালাকের প্রতি জোর দেয়ার জন্য বলা হতো। কিন্তু হযরত ফারূক্বে আ’যম আলাইহিস সালাম উনার যামানায় মানুষ এক সঙ্গে তিন তালাকই দিতে শুরু করেন। তখনই প্রয়োজন হয়ে পড়ে সঠিক ফতওয়া কি হবে। সে অবস্থায় হযরত ফারুক্বে আ’যম আলাইহিস সালাম তিনি পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের আলোকে ইজতিহাদ করে ফতওয়া দেন যে, তিন তালাক্ব একসাথে দিলে তিন তালাক্বই পতিত হবে।

মূলকথা হলো “একত্রে তিন তালাক দিলে তিন তালাকই পতিত হবে” এ বিষয়টি যেরূপ পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ দ্বারা প্রমাণিত আছে। অনুরূপভাবে হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের ইজমা দ্বারাও প্রমাণিত আছে। আর ইজমা পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফের মতই শরীয়তের অন্যতম একটি অকাট্য দলীল। ঈসা মিঞা যেহেতু লা-মাযহাবী তাই সে উক্ত ইজমাকে অস্বীকার করেছে বা ইজমার বিরোধিতা করেছে। কেননা লা-মাযহাবীরা ইজমা-ক্বিয়াস মনে না।

ঈসা মিঞা কর্তৃক প্রদত্ত ফতওয়ার ৩ নং দলীলের খণ্ডন ও সঠিক ব্যাখ্যা:

 হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হযরত রুকানাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার আহলিয়াকে প্রদত্ব তিন তালাককে এক তালাক সাব্যস্ত করতঃ ইরশাদ মুবারক করেন, আপনি ইচ্ছে করলে আপনার আহলিয়াকে ফিরিয়ে নিতে পারবেন। অতঃপর তিনি উনাকে ফিরিয়ে নেন। এ হাদীছ শরীফখানা আবূ দাউদ, মুসনাদে আহমদ, বায়হাক্বী সহ আরো অনেক কিতাবেই বর্ণিত হয়েছে।

কিন্তু ‘আবূ দাউদ শরীফ, বায়হাকী¡ শরীফ’ কিতাবের মধ্যেই আবার হযরত নাফে ইবনে আজীর এবং হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আলী ইবনে ইয়াযীদ ইবনে রুকানাহ স্বীয় দাদা হযরত রুকানাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি উনার আহলিয়াকে তালাকে বাত্তা অথার্ৎ এক তালাক দিয়েছিলেন। ফলে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উনার আহলিয়াকে ফিরিয়ে দেন। এ বর্ণনা অন্য বর্ণনা থেকে ছহীহ। কেননা হযরত রুকানাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার ছেলে এবং উনার ঘরের অন্যান্য সদস্যগণ উনার অবস্থা সম্পর্কে বাইরের লোক অপেক্ষা বেশি অবগত। হযরত রুকানাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার নাতি বলতেছেন, আমার দাদা আমার দাদীকে তালাকে বাত্তা দিয়েছেন। আর অন্যান্য বর্ণনাকারী বলতেছেন, তিন তালাক দিয়েছেন। এখানে নাতির বর্ণনাই বেশি ছহীহ বলে গণ্য হবে।

হযরত ইমাম নববী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, হযরত রুকানাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার তিন তালাক সম্বলিত বর্ণনাটি জয়ীফ এবং অপ্রসিদ্ধ লোক থেকে বর্ণিত হয়েছে। উনার তালাক প্রদানের ক্ষেত্রে কেবল ঐ বর্ণনাটিই ছহীহ সেটা হচ্ছে, তিনি তালাকে বাত্তা দিয়েছেন। বাত্তা শব্দের মধ্যে এক ও তিন উভয়ের সম্ভাবনা থাকে। সম্ভবতঃ তিন তালাক সম্বলিত হাদীছ শরীফের বর্ণনাকারী বাত্তা বলতে তিন তালাকই মনে করেছেন। এজন্য বাত্তার পরির্বতে তিন তালাক বলে দিয়েছেন। যেকারণে বর্ণনার মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে।

তাছাড়া ইবনে মাজাহ শরীফ ও আবূ দাউদ শরীফে বর্ণিত হয়েছে-

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَلِىِّ بْنِ يَزِيْدَ بْنِ رُكَانَةَ عَنْ اَبِيْهِ عَنْ جَدِّهٖ اَنَّهٗ طَلَّقَ اِمْرَأَتَهُ الْبَـتَّةَ فَاَتَى رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَسَأَلَهٗ فَـقَالَ مَا أَرَدْتَ بِهَا‏‏ قَالَ وَاحِدَةً ‏قَالَ ‏اَاَللهِ مَا أَرَدْتَ بِهَا إِلَّا وَاحِدَةً قَالَ اَاَللهِ مَا أَرَدْتُ بِهَا إِلَّا وَاحِدَةً‏ قَالَ فَـرَدَّهَا عَلَيْهِ

অর্থ: হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আলী ইবনে ইয়াযীদ ইবনে রুকানাহ স্বীয় দাদা হযরত রুকানাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি উনার আহলিয়াকে তালাকে বাত্তা দেন। অতঃপর দরবারে নববী শরীফে উপস্থিত হয়ে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নিকট আরজ করলেন, আমি এক তালাকের নিয়ত করেছিলাম। তিনি ইরশাদ মুবারক করলেন, কসম করে বলতে পারবেন যে, আপনি এক তালাকের নিয়ত করেছিলেন। আরজ করলেন, মহান আল্লাহ পাক উনার কসম করে বলছি যে, এক তালাকের নিয়ত করেছিলাম। তখন নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আহলিয়াকে উনার নিকট ফিরিয়ে দেন।

এ হাদীছ শরীফ থেকে প্রতিভাত যে, এক সঙ্গে তিন তালাক দিলে যদি এক তালাক সাব্যস্ত হতো তাহলে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হযরত রুকানাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে উনার নিয়তের কসম করিয়েছিলেন কেন?

মূলতঃ হযরত রুকানাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু প্রদত্ব তিন তালাক সংক্রান্ত বর্ণনাটি জয়ীফ। উক্ত জয়ীফ বর্ণনার বিপরীতে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে আটটি ছহীহ বর্ণনা এবং হযরত রুকানাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার নাতি থেকে একটি বর্ণনা বর্ণিত হয়েছে।

সুতরাং, হযরত রুকানাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার ‘তিন তালাক’ সম্বলিত একটি জয়ীফ বর্ণনার বিপরীতে ‘তালাকে বাত্তা’ সম্বলিত নয়টি ছহীহ বর্ণনা নিঃসন্দেহে গ্রহণযোগ্য ও অনুসরণযোগ্য।

ঈসা মিঞা কর্তৃক প্রদত্ত ফতওয়ার ৪নং ও ৫ নং দলীলের খণ্ডন ও সঠিক ব্যাখ্যা:

ঈসা মিঞা ৪নং দলীল হিসেবে সূরা বাক্বারার যে আয়াত শরীফ উল্লেখ করেছে আর ৫নং দলীল হিসেবে তিরমিযী শরীফের যে হাদীছ শরীফ উল্লেখ করেছে তাতে মূলত এক তালাক ও দুই তালাকের বিষয়টিই উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে তিন তালাকের কোন আলোচনাই নাই। অর্থাৎ যদি আহাল তার আহলিয়াকে এক তালাক অথবা দুই তালাক বায়েন দেয়। অতঃপর আহাল ইচ্ছে করলে তার উক্ত আহলিয়াকে ইদ্দতের মধ্যে হোক অথবা ইদ্দতের পরে হোক যখন ইচ্ছে তখন পুনরায় বিবাহ করে ফিরিয়ে নিতে পারবে। যেমন এ প্রসঙ্গে ফিক্বাহ শাস্ত্রের বিখ্যাত ও প্রসিদ্ধ ‘হিদায়া’ কিতাবে রাজয়াতের অধ্যায়ে উল্লেখ আছে-

اِذَا كَانَ الطَّلَاقُ بَائِنًا دُوْنَ الثَّلَاثِ فَـلَهٗ اَنْ يَّـتَـزَوَّجَهَا فِى الْعِدَّةِ وَبَعْدَ اِنْقِضَائِهَا

অথার্ৎ- কেউ নিজ আহলিয়াকে তিন তালাকের কম এক তালাক অথবা দুই তালাক বায়েন দিলে আহাল উক্ত আহলিয়াকে তালাকের ইদ্দতের মধ্যে অথবা ইদ্দতের পরে যখন ইচ্ছা বিবাহ করতে পারবে।

আরো উল্লেখ্য যে, এক সাথে তিন ত্বালাক্ব দেয়াকে তালাকে মুগাল্লাজাও বলে। মুগাল্লাজা ত্বালাক্ব  দিলে ত্বালাক্ব  কার্যকরী বা পতিত হবে। এক্ষেত্রে আহাল যদি তার তিন ত্বালাক্বপ্রাপ্তা আহলিয়াকে নিয়ে সংসার করতে চায় তাহলে উক্ত আহলিয়া ইদ্দত পালনের পর অন্যত্র বিবাহ বসে ঘর-সংসার করার পর অর্থাৎ একান্তবাসের পর যদি দ্বিতীয় আহাল তাকে ত্বালাক্ব দেয় অতঃপর ইদ্দত পালন করে তারপর প্রথম আহাল উক্ত আহলিয়াকে পুনরায় বিবাহ করে সংসার করতে পারবে। এটা মহান আল্লাহ পাক উনারই নির্দেশ মুবারক।

মূলকথা হচ্ছে, আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত অর্থাৎ হানাফী, শাফেয়ী, হাম্বলী ও মালেকী মাযহাব উনাদের সর্বসিদ্ধ ফতওয়া হচ্ছে, একত্রে তিন তালাক দিলে তিন তালাকই পতিত বা সাব্যস্ত হবে। তা যে কোন অবস্থাতেই দেয়া হোক না কেন। এ বিষয়ে ইখতিলাফ, শিথীলতা বা হের-ফের করার কোনই সুযোগ নেই।

আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত উনাদের সমস্ত কিতাবেই রয়েছে, এক সাথে তিন তালাক্ব দিলে তিন তালাক্বই পতিত হবে। তা যে কোন অবস্থাতেই দেয়া হোক না কেন। তার মধ্য থেকে নিম্নে দলীল হিসেবে কিছু সংখ্যক কিতাবের নাম উল্লেখ করা হলো। প্রয়োজনে আরো অধিক দলীল-আদীল্লাহসহ ফতওয়া দেয়া যাবে ইংশাআল্লাহ। আর বিষয়ে কেউ বাহাছ করতে চাইলে আমরা তার সাথে বাহাছ করতে রাজী আছি।

{দলীলসমূহঃ- (১) তাফসীরে তাবারী, (২) তাফসীরে রূহুল মায়ানী, (৩) তাফসীরে ইবনে কাছীর, (৪) তাফসীরে কবীর, (৫) তাফসীরে খাযিন, (৬) তাফসীরে বাগউয়ী, (৭) তাফসীরে কুরতুবী, (৮) তাফসীরে মাযহারী, (৯) তাফসীরে আহকামুল কুরআন, (১০) তাফসীরে আহমদী, (১১) তাফসীরে বায়দ্বাউয়ী, (১২) তাফসীরে শায়েখ যাদাহ্, (১৩) তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন, (১৪) বুখারী শরীফ, (১৫) মুসলিম শরীফ, (১৬) নাসায়ী শরীফ, (১৭)  মিশকাত শরীফ, (১৮) দারু কুতনী, (১৯) তবারানী, (২০) ফিক্বহুস সুনান ওয়াল আছার (২১)ফতহুল বারী, (২২) উমদাতুল ক্বারী, (২৩) মিরকাত, (২৪) আশয়াতুল লুমুয়াত, (২৫) লুমুয়াত, (২৬) তালিকুছ্ ছবীহ্, (২৭) ত্বীবী, (২৮) মুযাহিরে হক্ব, (২৯) মাবসূত, (৩০) ফতহুল ক্বাদীর, (৩১) বেনায়া, (৩২) আলমগীরী, (৩৩) শামী, (৩৪) আইনী, (৩৫) বাহ্রুর রায়িক, (৩৬) কুদুরী, (৩৭) হিদায়া, (৩৮) আইনুল হিদায়া, (৩৯) নিহায়া, (৪০) ইনায়া, (৪১) গায়াতুল আওতার, (৪২) শরহে বেক্বায়া, (৪৩) কানযুদ্ দাক্বায়িক্ব, (৪৪) ফতওয়ায়ে আমিনী (৪৫) আল বাইয়্যিনাত শরীফ ইত্যাদি।}

 

মুহম্মদ আহসান হাবীব, মীরগঞ্জ, রংপুর।

সুওয়াল:  বাতিল ফিরক্বার লোকদের আক্বীদা হলো, মহান আল্লাহ পাক তিনি ব্যতীত আর কেউই ইলমে গইব উনার ইলিম রাখেন না। এমনকি যিনি কুল-মাখলূক্বাতের মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খ্বাতামুন নাবিয়্যীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনিও নাকি ইলমে গইব উনার ইলিম রাখেন না। নাউযুবিল্লাহ!

এ বিষয়ে আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত উনাদের কি আক্বীদা? দয়া করে জানিয়ে বাধিত করবেন।

জাওয়াব:

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ উনাদের মধ্যে উল্লেখ রয়েছে, হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তয়ালা আনহু তিনি বলেন, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

فَـوَاللهِ لَاتَسْئَـلُوْنِىْ عَنْ شَىْءٍ اِلَّا اَخْبَـرْتُكُمْ بِهٖ مَادُمْتُ فِىْ مَقَامِىْ هٰذَا

অর্থ : “মহান আল্লাহ পাক উনার কসম! তোমরা যে কোন বস্তু বা বিষয় সম্পর্কে আমাকে প্রশ্ন কর, আমি এখানে অবস্থান মুবারক করেই তার সংবাদ দিব।” সুবহানাল্লাহ!

উক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত-

لَا تَسْئَـلُوْنِىْ عَنْ شَىْءٍ

 ‘লা তাসআলূনী আন শাইয়িন’ বাক্য দ্বারা এটাই প্রতিভাত যে, কোন বিষয় বা বস্তুই আখিরী রসূল, ছাহিবে ইলমে গইব, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ইলম মুবারকের বাইরে ছিলনা। কারণ شَىْءٌ (শাইউন) শব্দটি হলো نَكِرَةٌ নাকিরাহ বা অনির্দিষ্ট বিশেষ্য। আর নাকিরাহ নফী বা না সূচক বাক্যের অধীনে হলে ব্যাপকতার অর্থ প্রদান করে।

যেমন, তবারানী, ইবনে আবি শাইবা, আবু ইয়ালা, কানযুল উম্মাল ৩১৯২৬ উনাদের মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

عَنْ حَضْرَتْ اَبِىْ مُوْسٰى رَضِىَ اللهُ تَـعَالٰى عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اُعْطِيْتُ فَـوَاتِحَ الْكَلِمِ وَجَوَامِعَهٗ وَخَوَاتِـمَهٗ

অর্থ : “হযরত আবূ মুসা আশয়ারী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বর্ণনা করেন, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, আমাকে সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সকল বিষয়ের সমস্ত ইলিম হাদিয়া করা হয়েছে। সুবহানাল্লাহ!

দাইলামী শরীফ/১৬২০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আরো ইরশাদ মুবারক করেন-

اُعْطِيْتُ جَوَامِعَ الْعِلْمِ

অর্থ : “আমাকে সমস্ত ইলিম হাদিয়া করা হয়েছে।” সুবহানাল্লাহ!

মুসলিম শরীফ, মিশকাত শরীফ/৫১২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-

اُعْطِيْتُ جَوَامِعَ الْكَلِمِ

অর্থ: “আমাকে সমস্ত ইলিম হাদিয়া করা হয়েছে।” সুবহানাল্লাহ!

বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, মিশকাত শরীফ/৫১২ পৃষ্ঠায় আরো বর্ণিত রয়েছে-

بُعِثْتُ بِجَوَامِعِ الْكَلِمِ

অর্থ : “আমি সমস্ত ইলিমসহ প্রেরিত হয়েছি।” সুবহানাল্লাহ!

লুগাতুল হাদীছ-১/১৪ পৃষ্ঠায় আরো বর্ণিত রয়েছে-

اُوْتِيْتُ جَوَامِعَ الْكَلِمِ وَخَوَاتِـمَهٗ

অর্থ : “আমি সমস্ত ইলিম এবং তার শেষ সীমাসহ প্রেরিত হয়েছি।” সুবহানাল্লাহ!

“আফদ্বালুল কুরা” কিতাবে উল্লেখ আছে-

لِاَنَّ اللهَ تَـعَالٰى اَطَّلَعَهٗ عَلَى الْعَالِـمِ فَـعَلِمَ الْاَوَّلِيْنَ وَالْاٰخِرِيْنَ وَمَا كَانَ وَمَا يَكُوْنُ

অর্থ : “মহান আল্লাহ পাক তিনি নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহিস্ সালাম উনাকে সমস্ত দুনিয়া সম্পর্কে অবহিত করেছেন। সুতরাং নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি পূর্ববতীর্ ও পরবতীর্ সকল ইলিম এবং যা কিছু হয়েছে এবং যা কিছু হবে, সবকিছুই জানেন।” সুবহানাল্লাহ!

“ক্বাছীদায়ে বুর্দা” শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ রয়েছে-

وَكُلُّهُمْ مِنْ رَّسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مُلْتَمِسٌ غُرَفًا مِّنَ الْبَحْرِ اَوْ رَشَفًا مِّنَ الدِّيَمِ

অর্থ : “সকলেই সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নিকট থেকে জ্ঞান আহরণ করে থাকেন। যেমন, কেউ সমুদ্র থেকে কলসি ভরে অথবা কেউ প্রবল বৃষ্টির ফেঁাটা থেকে পানি সংগ্রহ করে।”

উক্ত কিতাবে আরো উল্লেখ রয়েছে-

اِنَّ جَمِيْعَ الْاَنْبِيَاءِ كُلُّ وَاحِدٍ مِّنْـهُمْ طَلَبُـوْا وَاَخَذُوا الْعِلْمَ مِنْ عِلْمِهٖ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الَّذِىْ كَالْبَحْرِ فِى السَّعَةِ وَالْكَرَمِ مِنْ كَرَمِهٖ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الَّذِىْ هُوَ كَالدِّيَمِ لِاَنَّهٗ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مُفِيْضٌ وَهُمْ مُسْتَـفَاضُوْنَ لِاَنّهٗ تَـعَالٰى خَلَقَ اِبْـتَدَاءَ رُوْحِهٖ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَوَضَعَ فِيْهِ عُلُوْمَ الْاَنْبِيَاءِ وَعَلَّمَ مَاكَانَ وَمَا يَكُوْنُ ثُمَّ خَلَقَهُمْ فَاَخَذُوْا عُلُوْمَهُمْ مِنْهُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ

অর্থ : “সকল হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালাম উনারা নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ব্যাপক ইলমি ভান্ডার থেকে ইলিম সংগ্রহ করেছেন এবং সকলেই উনার সেই অঝোর বারি ধারার মতো করুণা থেকে করুণাপ্রাপ্ত হয়েছেন। কেননা, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হলেন ফায়িযদাতা আর অন্যান্য হযরত আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম উনারা হলেন ফায়িয গ্রহীতা। মহান আল্লাহ পাক তিনি সর্বপ্রথম নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার রূহ্ মুবারক সৃষ্টি করে উনার মধ্যে সকল হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালাম উনাদের ও পূর্বাপর প্রত্যেক বিষয়ের ইলিমসমূহ সঞ্চিত রাখেন। অতঃপর অন্যান্য হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের সৃষ্টি করেন। সুতরাং উনারা সকলেই স্বীয় ইলিম নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার থেকে সংগ্রহ করেছেন বা লাভ করেছেন।” (ক্বাছীদায়ে বুর্দা শরীফ)

সারকথা হলো, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হচ্ছেন সকল সৃষ্টির জন্য ইলিমসহ সমস্ত নিয়ামতের বণ্টনকারী।

এ প্রসঙ্গে ছহীহ বুখারী শরীফ ও ছহীহ মুসলিম শরীফ উনাদের মধ্যে বর্ণিত রয়েছে, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

اِنَّـمَا اَنَا قَاسِمٌ وَاللهُ يُعْطِىْ

অর্থ: “মহান আল্লাহ পাক তিনি হাদিয়া করেন আর নিশ্চয়ই আমি হলাম (উক্ত হাদিয়া) বণ্টনকারী।”

অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক তিনি উনার সর্বপ্রকার নিয়ামত উনার  মহাসম্মানিত হাবীব নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে হাদিয়া করেছেন। আর নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি কুল মাখলুক্বাতের যাকে যতটুকু বা যে পরিমাণ ইচ্ছা তাকে সে পরিমাণ বণ্টন করে দিয়ে থাকেন। দেখা যাচ্ছে, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নিকট মহান আল্লাহ পাক উনার ভাণ্ডার মুবারক রয়েছে এবং তিনি সে ভাণ্ডার মুবারক থেকে যাকে যতটুকু প্রয়োজন তাকে ততটুকু দিয়ে থাকেন।

এখন যিনি কুল-মাখলুক্বাতের জন্য বণ্টনকারী তিনি মূলত সৃষ্টির শুরু হতে সৃষ্টির শেষ পর্যন্ত বণ্টনকারী। আর বণ্টনকারী যাদের মাঝে বণ্টন করবেন তাদেরকে অবশ্যই চিনেন ও জানেন। অন্যথায় না চিনলে ও না জানলে কাকে কতটুকু বা কি পরিমাণ দিবেন? কাজেই বলার অপেক্ষা রাখেনা, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইলমে গইবসহ সমস্ত ইলিমের অধিকারী। সুবহানাল্লাহ!

উল্লেখ্য, লওহে মাহফূয সম্পর্কে বলা হয়, সৃষ্টির শুরু হতে যা কিছু হয়েছে, হচ্ছে ও হবে সবকিছুই সেখানে লিপিবদ্ধ রয়েছে। এখানে বলতে হয়, লওহে মাহফূয সৃষ্টি হয়েছে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ওজুদ পাক নূর মুবারক উনার অংশ হতে। আর লওহে মাহফূয যেহেতু সৃষ্টিরাজির মধ্যে একটি সৃষ্টি সেহেতু তারমধ্যে সংরক্ষিত নিয়ামত তথা ইলিমেরও বণ্টনকারী হলেন নূরে  মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি। সুবহানাল্লাহ!

অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক সুবহানাহূ ওয়া তায়ালা উনার ইলিমের একটা অংশ রাখা হয়েছে লওহে মাহফূযে যেই ইলিম মাখলুক্বাতের জন্য বণ্টিত। আর নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যেহেতু সমস্ত ইলমের মালিক এবং মাখলুক্বাতের সর্বপ্রকার নিয়ামতের বণ্টনকারী সেহেতু তিনি মাখলুক্বাতের অবস্থা সম্পর্কিত ও তাদের জন্য বণ্টিত লওহে মাহফূযে সংরক্ষিত ইলমসহ সমস্ত ইলিম উনাদেরও অধিকারী এবং তার বণ্টনকারীও।

মূলকথা হলো, লওহে মাহফূযে সংরক্ষিত ইলিম মুবারক যেরূপ মহান আল্লাহ পাক সুবহানাহূ ওয়া তায়ালা উনার ইলিম মুবারক উনার একটা অংশ একইভাবে উক্ত ইলিম নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনারও ইলিম মুবারক উনার অংশ বিশেষ। সুবহানাল্লাহ!

মনে রাখতে হবে, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি শুধু ইলমে গইব মুবারকের অধিকারীই নন বরং তিনি হচ্ছেন পরিপূর্ণরূপে ইলমে গইব বা গইবের ইলিম বণ্টনকারী। উনার মাধ্যমেই বান্দা ও উম্মত গইবের ইলিম জেনেছে, বুঝেছে ও লাভ করেছে। সুবহানাল্লাহ!

অতএব, পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ উনাদের আলোকে উপরের সংক্ষিপ্ত জাওয়াবের দ্বারা নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উম্মতগণ ইলমে গইব সম্পর্কে অবহিত হওয়াটাই যেখানে প্রমাণিত সেখানে উনাদের যিনি মহাসম্মানিত রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিয়্যীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ক্ষেত্রে ইলমে গইব সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করা যে কত চরম জিহালতি, গুমরাহী ও কুফরী; তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মূলত নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার যারা (৬৫ পৃষ্ঠায় দেখুন) চিরশত্রু, চির লা’নতগ্রস্ত ও চিরজাহান্নামী কেবল তারাই উক্ত বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারে।

জানা অপরিহার্য যে, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র শান বা মর্যাদা সম্পর্কিত কোন বিষয়ে ফায়ছালা দিতে হলে শুধু দু’ বা একখানা আয়াত শরীফ উনার আংশিক ও শাব্দিক অর্থের উপর ভিত্তি করে ফায়ছালা দেয়াটা আদৌ শুদ্ধ নয় বরং উনার সীমাহীন পবিত্র মর্যাদা মুবারক বা শান মুবারক সম্পর্কে ফায়ছালা দিতে হলে সম্পূর্ণ কুরআন শরীফ ও সম্পূর্ণ হাদীছ শরীফ উনার ইলিম থাকতে হবে; অন্যথায় প্রদত্ব ফায়ছালা অশুদ্ধ ও কুফরীমূলক হবে এবং পরিণামে চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নাম ওয়াজিব হবে। নাউযুবিল্লাহ!

বিশেষ দ্রষ্টব্য: এ সম্পর্কে আরো জানতে হলে মাসিক আল বাইয়্যিনাত শরীফ ১২৯ ও ২২১তম সংখ্যা পাঠ করুন।

মুহম্মদ হুমায়ুন কবীর, বানারীপাড়া, বরিশাল।

সুওয়াল: গান-বাজনা করা কি? কেউ কেউ বলে থাকে, “ইসলামী গান” যেমন- নবীতত্ত্ব, মুর্শীদি, জারী ইত্যাদি জায়িয। কারণ হিসেবে তারা  বলে, হযরত সুলত্বানুল হিন্দ খাজা মুঈনুদ্দীন চিশ্তী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি নাকি গান-বাজনা করেছেন। তারা আরো বলে থাকে যে, বুখারী শরীফ- এর ২য় খণ্ডের ২২৫ পৃষ্ঠায় এবং ৫ম খণ্ডের ৫৫৫ পৃষ্ঠায়  নাকি “গান-বাজনা” জায়িয বলে লেখা আছে।

এখন আমার সুওয়াল হচ্ছে- “গান-বাজনা” সম্পর্কে সম্মানিত শরীয়ত উনার ফায়সালা কি? সত্যিই কি হযরত সুলত্বানুল হিন্দ খাজা ছাহিব রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি “গান-বাজনা” করেছেন? আর বুখারী শরীফ কিতাবের মধ্যে “গান-বাজনা” জায়িয লেখা আছে কি? পবিত্র কুরআন শরীফ এবং সুন্নাহ শরীফ উনাদের আলোকে জাওয়াব দানে বাধিত করবেন।

জাওয়াব: সম্মানিত ইসলামী শরীয়ত উনার দৃষ্টিতে গান-বাজনা করা হারাম ও কবীরা গুণাহের অন্তর্ভুক্ত। তা যে কোন গানই হোক না কেন। যেমন নবী তত্ত্ব, মুর্শীদি, জারী, কাওয়ালী, পল্লীগীতি, ভাওয়ালী, ভক্তিমূলক ইত্যাদি সর্বপ্রকার গানই হারাম ও নাজায়িয। তবে বাজনা বা বাদ্য-যন্ত্র ব্যতীত হাম্দ্, না’ত, কাছীদা, গজল ইত্যাদি পাঠ করা ও শোনা জায়িয রয়েছে। কিতাবে উল্লেখ আছে, ইলিম দু’ প্রকার। (১) ইলমে আরূজী অর্থাৎ ছন্দ প্রকরণ যেমন- “বালাগাল উলা বিকামালিহী ……… পবিত্র মীলাদ শরীফ উনার মধ্যে পাঠকৃত কাছীদাসমূহ, যা গানের সূরে পাঠ করা হয় না। (২) “ইলমে মুসীক্বী অর্থাৎ রাগ-রাগিণী বা গানের সূর।

স্মরণীয় যে, বাদ্য বা বাজনা সম্মানিত শরীয়ত উনার দৃষ্টিতে সম্পূর্ণরূপে নাজায়িয। সাথে সাথে বাদ্যবিহীন ইলমে মুসীক্বীও নাজায়িয।

মূলতঃ গান-বাজনা পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, পবিত্র ইজমা শরীফ ও পবিত্র ক্বিয়াস শরীফ উনাদের অকাট্য বা ক্বেত্য়ী দলীলের মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে হারাম সাব্যস্ত হয়েছে। মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র কালাম পাক উনার মধ্যে অসংখ্য স্থানে গান-বাজনা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। যেমন পবিত্র সূরা লুক্বমান শরীফ উনার ৬নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَّشْتَرِيْ لَـهْوَ الْحَدِيْثِ لِيُضِلَّ عَنْ سَبِيْلِ اللهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَيَـتَّخِذَهَا هُزُوًا ۚ أُولٰٓئِكَ لَـهُمْ عَذَابٌ مُّهِيْنٌ

অর্থ:“মানুষের মধ্যে কিছু লোক রয়েছে যারা ‘লাহ্ওয়াল হাদীছ’ খরীদ করে থাকে যেনো বিনা ইলিমে মানুষদেরকে মহান আল্লাহ পাক উনার পথ থেকে বিভ্রান্ত করে এবং হাসি-ঠাট্টারূপে ব্যবহার করে। তাদের জন্যে অপমানজনক শাস্তি রয়েছে।”

অনুসরণীয় হযরত মুফাস্সিরীনে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনারা উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত لَـهْوَ الْـحَدِيْثِ  ‘লাহ্ওয়াল হাদীছ’ দ্বারা গান-বাজনাকে সাব্যস্ত করেছেন।

যেমন বিখ্যাত মুফাস্সির আল্লামা ইবনে কাছীর রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি উনার “তাফসীরে ইবনে কাছীরের” ৮ম খণ্ড, ৩, ৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-

 قَالَ اِبْنُ مَسْعُوْدٍ فِىْ قَـوَلِهٖ تَـعَالٰى وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَّشْتَرِىْ لَـهْوَ الْـحَدِيْثِ ……. قَالَ هُوَ وَاللهِ اَلْغِنَاءُ ……. وَكَذَا قَالَ اِبْنُ عَبَّاسٍ وَجَابِرٌ وَعِكْرَمَةُ وَسَعِيْدُ بْنُ جُبَـيْرٍ وَمُـجَاهِدٌ وَ مَكْحُوْلٌ وَعُمَرُ بْنُ شُعَيْبٍ وَعَلِىُّ بْنُ بُذَيْمَةَ وَقَالَ حَسَنُ الْبَصْرِىُّ نَـزَلَتْ هٰذِهِ الْاٰيةُ فِى الْغِنَاءِ وَالْمَزَامِيْرِ

অর্থ: “বিশিষ্ট ছাহাবী হযরত ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি لَـهْوَ الْـحَدِيْثِ  ‘লাহ্ওয়াল হাদীছ’ উনার ব্যাখ্যায় বলেন, মহান আল্লাহ পাক উনার কসম! لَـهْوَ الْـحَدِيْثِ  হচ্ছে গান-বাজনা বা সঙ্গিত। …… হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত জাবির রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত ইকরামাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত সাঈদ বিন জুবাইর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত মুজাহিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত মাকহুল রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত আমর ইবনে শুয়াইব রহমতুল্লাহি আলাইহি ও হযরত আলী ইবনে বুযাইমা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনারা সকলেই উক্ত ব্যাখ্যাই করেছেন। আর বিশিষ্ট তাবিয়ী হযরত হাসান বছরী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ গান ও বাদ্যযন্ত্র সম্পর্কেই নাযিল হয়েছে।”

এছাড়াও তাফসীরে কুরতুবী, তাফসীরে তাবারী, তাফসীরে দুররে মানছূর, তাফসীরে রূহুল মায়ানী, তাফসীরে মাদারিক, তাফসীরে কাশ্শাফ, তাফসীরে মায়ালিম, তাফসীরে ছায়লাবী এবং হযরত ইমাম বুখারী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি উনার “আদাবুল মুফরাদ” কিতাবে لَـهْوَ الْـحَدِيْثِ  ‘লাহ্ওয়াল হাদীছ’ অর্থ গান-বাজনা, বাদ্য-যন্ত্র বলে উল্লেখ করেছেন। অনুরূপ পবিত্র সূরা নজম শরীফ ও পবিত্র সূরা বানী ইসরায়ীল শরীফ উনাদের মধ্যেও গান-বাজনা হারাম  হওয়ার ব্যাপারে পবিত্র আয়াত শরীফ ইরশাদ মুবারক হয়েছে।

অতএব, পবিত্র কুরআন শরীফ উনার পবিত্র আয়াত শরীফ যা ক্বেত্য়ী দলীল উনার দ্বারা সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হয়েছে যে, গান-বাজনা, বাদ্য-যন্ত্র ইত্যাদি সম্পূর্ণরূপেই হারাম ও আযাবের কারণ।

গান-বাজনা ও বাদ্য-যন্ত্র হারাম হওয়া সম্পর্কে অসংখ্য পবিত্র হাদীছ শরীফ বর্ণিত রয়েছে। যেমন মহাসম্মানিত হাবীব, মাহবূব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

اِسْتِمَاعُ الْـمَلَاهِىِّ مَعْصِيَةٌ وَجُلُوْسٌ عَلَيْهَا فِسْقٌ وَتَـلَذُّذٌ بِـهَا مِنَ الْكُفْرِ

অর্থ: “গান শোনা গুণাহের কাজ, গানের মজলিসে বসা ফাসিকী এবং গানের সাধ আস্বাদন করা কুফরী।”

পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

اَلْغِنَاءُ يُـنْبِتُ النِّفَاقَ فِى الْقَلْبِ كَمَا يُـنْبِتُ الْمَاءُ الزَّرْعَ

অর্থ: “পানি যেরূপ জমীনে ঘাস উৎপন্ন করে গান-বাজনা তদ্রƒপ অন্তরে মুনাফিকী পয়দা করে।” (বায়হাক্বী ফী শুয়াবিল ঈমান)

মহাসম্মানিত হাবীব, মাহবূব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আরো ইরশাদ মুবারক করেন-

بُعِثْتُ لِكَسْرِ الْمَزَامِيْرِ وَالْاَصْنَامِ

অর্থ: “আমি বাদ্য-যন্ত্র ও মূর্তি ধ্বংস করার জন্যে প্রেরিত হয়েছি।”

পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের আলোকে হযরত ইমাম-মুজতাহিদ তথা ফুক্বাহায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনারা ফতওয়া দেন যে, গান-বাজনা বা বাদ্য-যন্ত্র সম্পূর্ণই হারাম। এটাকে হালাল বলা কুফরী।

যেমন হযরত আল্লামা শাহ্ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিছ দেহলবী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি “তাফসীরে আযীযী”-এর ১ম খণ্ডের ৬৫ পৃষ্ঠায় লিখেন-

در مغنی گفتہ کہ لہو الحدیث غناءاست واں حرام است بایں نص و مستحل اں کافر است

অর্থ: “মুগনী” কিতাবে উল্লেখ আছে لَـهْوَ الْـحَدِيْثِ ‘লাহ্ওয়াল হাদীছ হচ্ছে গান-বাজনা, সঙ্গীত। উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার দ্বারা তা হারাম সাব্যস্ত হয়েছে। যে ব্যক্তি এটাকে হালাল জানবে সে কাফির হবে।”

فِىْ جَامِعِ الْفَتَاوٰى اِسْتِمَاعُ الْمَلَاهِىِّ وَالْـجُلُوْسُ عَلَيْـهَا وَضَرْبُ الْمَزَامِيْرِ وَالرَّقْصُ كُلُّهَا حَرَامٌ وَمُسْتَحِلُّهَا كَافِرٌ

অর্থ: “জামিউল ফতওয়াতে” উল্লেখ আছে, গান-বাজনা শ্রবন করা, গান-বাজনার মজলিসে বসা, বাদ্য-যন্ত্র বাজানো, নত্তর্ন-কুদ্দর্ন করা সবই হারাম। যে ব্যক্তি এগুলোকে হালাল মনে করবে সে ব্যক্তি কাফির হবে।” অনুরূপ প্রায় সকল ফিক্বাহ্র কিতাবেই গান-বাজনা, বাদ্য-যন্ত্র ইত্যাদিকে হারাম ফতওয়া দেয়া হয়েছে।

সুতরাং পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, পবিত্র ইজমা শরীফ ও পবিত্র ক্বিয়াস শরীফ উনাদের দলীল-আদিল্লাহ দ্বারা অকাট্যভাবেই প্রমাণিত যে, গান-বাজনা, বাদ্য-যন্ত্র ইত্যাদি সব হারাম ও নাজায়িয। এগুলোকে হালাল মনে করা কুফরী। কাজেই কোন অবস্থাতেই গান-বাজনা করার অনুমতি সম্মানিত ইসলামী শরীয়ত উনার মধ্যে নেই। তা যে কোন প্রকার গানই হোক না কেন।

অতঃপর যারা বলে যে, হযরত সুলত্বানুল হিন্দ, গরীবে নেওয়াজ, হাবীবুল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি গান-বাজনা করেছেন, এটা উনার প্রতি  চরম মিথ্যা তোহমতের শামিল। কারণ তিনি ছিলেন মহান আল্লাহ পাক উনার খাছ ওলী অর্থাৎ, হাবীবুল্লাহ। যিনি সারা জীবন সুন্নত মুবারকের পরিপূর্ণ অনুসরণ-অনুকরণ করেছেন। উনার পক্ষে কি করে হারাম গান-বাজনা করা সম্ভব? বাতিলপন্থী বা বিদ্য়াতীরা এ ব্যাপারে একটি দলীলও দেখাতে পারবে না। মূলতঃ হযরত সুলত্বানুল হিন্দ, গরীবে নেওয়াজ, হাবীবুল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি সামা পাঠ করেছেন। আর এটাকেই বিদ্য়াতী, ভন্ড ফক্বীরেরা গান-বাজনা বলে প্রচার করছে। নাঊযুবিল্লাহ! অথচ গান-বাজনা’র সাথে সামা’র বিন্দুমাত্রও সম্পর্ক নেই।

এ প্রসঙ্গে “ফাওয়ায়েদুল ফুওয়াদ” নামক কিতাবে উল্লেখ আছে যে, একদা দিল্লীর ৫০০ আলিমের সাথে হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বাহাছ হয়। কারণ দিল্লীর কিছু বিদ্য়াতী আলিম অপবাদ দিয়েছিল যে, হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি গান-বাজনা করেন। নাঊযুবিল্লাহ! বাহাছে যখন এ প্রশ্ন উত্থাপন করা হলো তখন হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, আমি কস্মিনকালেও গান-বাজনা করি না। বরং আমি সামা করি। আর আমার সামা পাঠের শর্ত হচ্ছে- (১) সেখানে কোন বাদ্য-যন্ত্র থাকবে না, (২) কোন মহিলা থাকবে না, (৩) কোন নাবালেগ দাড়ীবিহীন বালক থাকবে না, (৪) যে ছন্দগুলো পাঠ করা হবে তা শরীয়ত সম্মত হতে হবে, (৫) পঠিত ছন্দগুলি মহান আল্লাহ পাক উনার দিকে এবং উনার মহাসম্মানিত হাবীব, মাহবূব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দিকে আকৃষ্টকারী হতে হবে, (৬) আর যারা শুনবেন উনাদের সকলকে বুযুর্গ, পরহেজগার ও আল্লাহওয়ালা হতে হবে। যখন হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি এ কথা বললেন, তখন দিল্লীর উক্ত আলেমরা উনাকে হক্ব বলে মেনে নিলেন এবং নিজ ভুলের জন্য লজ্জিত হলেন। কাজেই পূর্ববর্তী হযরত আউলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনারা যে সামা পাঠ করেছেন তা এরূপই ছিল। সেই সামা’র সাথে বর্তমানে প্রচলিত জারী বা কাওয়ালীকে তুলনা করা কুফরী ছাড়া কিছু নয়।

প্রতিভাত যে, হযরত সুলত্বানুল হিন্দ, গরীবে নেওয়াজ, খাজা, হাবীবুল্লাহ রহমতুল্লাহি তিনি জীবনে কখনোই গান-বাজনা করেননি। এ ব্যাপারে উনার নামে যারা মিথ্যা তোহমত দেয় তারা চরম ফাসিক এবং কবীরা ও কুফরী গুণাহে গুণাহ্গার। নাঊযুবিল্লাহ!

এরপর যারা বলে যে, বুখারী শরীফ কিতাবের মধ্যে গান-বাজনা জায়িয লেখা আছে, তারা চরম জাহিল, মিথ্যাবাদী ও বেদ্য়াতী। আর জাহিল বলেই বুখারী শরীফ কিতাবের ৫ম খণ্ড দলীল হিসেবে উল্লেখ করেছে। অথচ মূল বুখারী শরীফ কিতাবের ৫ম খণ্ডই নেই। তাদেরকে শুধু এতটুকু বলবেন যে, বুখারী শরীফ কিতাবে যেখানে গান-বাজনা জায়িয বলা হয়েছে সেই অংশটুকু বাংলায় অনুবাদ করে দাও। তবেই তাদের মিথ্যা দলীলের হাক্বীক্বত প্রকাশ পেয়ে যাবে। মূলতঃ বুখারী শরীফ কিতাবের মধ্যে কোথাও যদি গান-বাজনা জায়িয লেখা থাকতো তাহলে হযরত ইমাম বুখারী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি উনার “আদাবুল মুফরাদ” কিতাবে গান-বাজনা হারাম বললেন কেন? কাজেই যারা এ ব্যাপারে বুখারী শরীফ কিতাবের দলীল দেয়, তারা চরম জাহিল, মিথ্যাবাদী, বেদ্য়াতী ও প্রতারক।

মূল কথা হচ্ছে, সম্মানিত ইসলামী শরীয়ত উনার দৃষ্টিতে সর্বপ্রকার গান-বাজনা হারাম। এটাকে হালাল বলা কুফরী। হযরত সুলত্বানুল হিন্দ গরীবে নেওয়াজ হাবীবুল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি জীবনে কখনো গান-বাজনা করেননি। আর বুখারী শরীফ কিতাবের কোথাও গান-বাজনা জায়িয বলা হয়নি।

দলীলসমূহ: তাফসীরে কুরতুবী, তাফসীরে আহ্কামুল কুরআন, তাফসীরে তাবারী, তাফসীরে মাযহারী, তাফসীরে দুররে মানছূর, তাফসীরে মাদারিক, তাফসীরে মায়ালিম, তাফসীরে রূহুল মায়ানী, তাফসীরে রূহুল বয়ান, তাফসীরে কবীর, তাফসীরে আবী সাউদ, তাফসীরে যাদুল মাছীর, তাফসীরে জালালাইন, বায়হাক্বী শরীফ, দায়লামী শরীফ,  মিশকাত শরীফ, মিরকাত শরীফ, ফাতহুল বারী শরহে বুখারী, উমদাতুল ক্বারী শরহে বুখারী, ইরশাদুস্ সারী শরহে বুখারী, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত ত্বীবী, তা’লীকুছ ছবীহ, মুযাহিরে হক্ব, ফতওয়ায়ে আলমগীরী, খুলাছাতুল ফতওয়া, জামিউল ফতওয়া, মুহীত, মুগনী, হিদায়া, তাতারখানিয়া, ফতহুল ক্বাদীর, ফতওয়ায়ে আযীযী ইত্যাদি।

মুহম্মদ যুবদুল হক, ভোলাহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ

সুওয়াল: ছেলে সন্তানের জন্য ২টি ও মেয়ে হলে একটি আক্বীক্বা করা সুন্নত। কিন্তু যদি অসহায় গরীব হয়, তাহলে ছেলের জন্য ১টি আক্বীক্বা দিলে আদায় হবে কি না? দয়া করে জানিয়ে বাধিত করবেন।

জাওয়াব: ছেলে সন্তানের আক্বীক্বার জন্য দুটি কুরবানী আর মেয়ে সন্তানের আক্বীক্বার জন্য একটি কুরবানী দেয়াই সম্মানিত শরীয়ত উনার হুকুম বা বিধান।

সামর্থ্য না থাকলে ছেলে সন্তানের জন্য একটি  কুরবানী দিলেও আক্বীক্বা আদায় হয়ে যাবে তবে সুন্নত হবে না। কেউ ইচ্ছা করলে দু’বারেও দুটি কুরবানী আক্বীক্বা হিসেবে দিতে পারে। একটি আগে দিল এবং আরেকটি পরে যখন সামর্থ্য হবে তখন দিল। এভাবে আক্বীক্বা দিয়েও খাছ সুন্নত মুবারক আদায় করতে পারে।

সন্তান জন্মগ্রহনের সপ্তম দিনে আক্বীক্বা দেয়া সুন্নত। সপ্তম দিনে সম্ভব না হলে পরে আক্বীক্বা দিলেও সুন্নত মুবারক আদায় হবে। এক্ষেত্রে ১৪ অথবা ২১ অথবা ২৮ দিবসে দিতে পারে। তাও সম্ভব না হলে বছরের যে কোন দিবসে দিলেও আক্বীক্বা আদায় হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে জন্মবারের আগের দিনে অর্থাৎ ইয়াওমুল ইছনাইন শরীফ (সোমবার) জন্মগ্রহণ করে থাকলে ইয়াওমুল আহাদ  (রোববার) আক্বীক্বা দেয়া হলে সপ্তম দিনের হিসেবে পড়বে।

কুরবানীর গরু, মহিষ অথবা উটে এক বা দুই ভাগা দিয়ে আক্বীক্বা করলেও তা আদায় হয়ে যাবে। দলীল: (সমূহ হাদীছ শরীফ ও ফিক্বাহ’র কিতাব)

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ