মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১৫৮)

সংখ্যা: ১৯৯তম সংখ্যা | বিভাগ:

প্রসঙ্গ : স্বীয় শায়খ বা মুর্শিদ ক্বিবলা-উনার মুহব্বত ও সন্তুষ্টির লক্ষ্যে নিম্নলিখিত দশটি মাক্বাম হাছিল করার কোশেশ করবে।

-হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম

রিয়াযত-মাশাক্কাত করার

শক্তি হাছিলের উপায়

 

রিয়াযত-মাশাক্কাত করার জন্য রূহানী কুওওয়াত বা শক্তি থাকা আবশ্যক। কারণ সে রূহানী কুওওয়াত বা শক্তি না থাকলে সালিক বা মুরীদ মাকসূদে মঞ্জিলে তথা জীবনের অভিষ্ট লক্ষ্যে পেঁৗছতে পারবে না। সেই কুওওয়াত বা শক্তি হাছিল করার জন্য-

প্রথমত: যা প্রয়োজন তা হচ্ছে নিয়মিত স্বীয় শায়খ বা মুর্শিদ ক্বিবলা উনার ছোহবত ইখতিয়ার।

দ্বিতীয়ত: শায়খ বা মুর্শিদ ক্বিবলা উনার নির্দেশ মত ইবাদত-বন্দেগী, যিকির-ফিকির করা।

তৃতীয়ত: শায়খ বা মুর্শিদ ক্বিবলা উনার খিদমতে মাল-জান বিসর্জন দেয়া। কারণ, মাল ও জানের মুহব্বত অন্তরে বদ্ধমূল থাকলে ইবাদত বন্দেগী, যিকির-ফিকিরে স্বাদ পাওয়া যায় না বা ইবাদত-বন্দেগী, যিকির-ফিকির করা সহজ বোধ্য হয় না।

চতুর্থত: নিজের পাঁচটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে হিফাযত বা সংরক্ষণ করা। মুজাদ্দিদে মিল্লাত ওয়াদ দ্বীন, হুজ্জাতুল ইসলাম, সাইয়্যিদুনা হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি মিনহাজুল আবেদীন কিতাবে উল্লেখ করেছেন- যে সালিক বা সাধক খোদার নির্ধারিত তাক্বওয়া অনুসরণ করতে চায় তথা মঞ্জিলে মাকসূদে পেঁৗছতে চায় সে যেন পাঁচটি অঙ্গ সম্পর্কে সতর্ক থাকে। সে অঙ্গ পাঁচটি হলো- চোখ, কান, জিহ্বা, অন্তর ও পেট। এগুলোকে সে সেসব জিনিস থেকে দূরে রাখবে যা ইবাদত-বন্দেগী, যিকির-ফিকিরে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। তা হারাম হোক আর অনাবশ্যক হালাল হোক। যদি সে সব অঙ্গকে বাঁচিয়ে চলতে পারে, তা হলে ইবাদতের ব্যাপারে তা যথেষ্ট হবে। তখন গোটা দেহই আল্লাহ পাক উনার ইবাদতের পূর্ণ উপযোগী হয়ে যাবে। রিয়াযত-মাশাক্কাতের শক্তি অর্জিত হবে। রূহানী শক্তি বৃদ্ধি পাবে। তিনি অন্যত্র বলেছেন, যদি কোন সালিক বা মুরীদের রাত্রিকালীন ওযীফা ছুটে যায় বা আনাদায়ীই থেকে যায়, আদায় করতে না পারে তাহলে বুঝতে হবে দিনের বেলা এসব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দ্বারা কোন না কোন গোনাহের কাজ সংঘটিত হয়েছে। সুতরাং সেই পাঁচটি অঙ্গের তাক্বওয়া সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন আলোচনা করা দরকার। আর  সেগুলোর জন্যে কোন কোন বস্তু হারাম তাও জানা প্রয়োজন।

চোখ

চোখের সংযম অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ব্যাপার। সব ফিতনা-ফ্যাসাদের মূলে হল চোখ। স্বয়ং আল্লাহ পাক কুরআন শরীফ-এ ইরশাদ করেন-

قل للمؤمنين يغضوا من ابصارهم ويحفظوا فروجهم ذالك ازكى لهم ان الله خبير بما يصنعون.

অর্থ: “হে আমার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি ঈমানদারদেরকে বলে দিন, তারা যেনো তাদের চোখকে নিচু করে চলে এবং নিজ নিজ স্বাভাবিক স্থানকে বাঁচিয়ে চলে। এ নীতি তাদের তাযকিয়া বা পরিশুদ্ধিতাকে বাড়িয়ে দিবে। আর আল্লাহ পাক তাদের সবকাজের খবরই সবচেয়ে বেশি রাখেন।”

মোটকথা, এই আয়াত শরীফ দ্বারা জানিয়ে দেয়া হল যে, চোখ নিচু করে রাখার ভিতরে তাযকিয়া (অন্তরের পবিত্রতা) ও আনুগত্য এবং কল্যাণের বস্তু বৃদ্ধি নিহিত রয়েছে। যদি কেউ তার দৃষ্টিকে নিচু না রেখে চারদিকে ছুটাছুটি করতে দেয়, তাহলে অনেক অন্যায় দৃশ্য তার চোখে পড়বে। এমনও হতে পারে, কোন হারাম কিছুর উপর তার চোখ পড়বে। যদি সে দিকে তার মন চলে যায় এবং তার ইচ্ছা জেগে উঠে, তাহলে বিরাট পাপের কাজ হবে। রিয়াযত-মাশাক্কাতে ব্যাঘাত সৃষ্টি হবে। ইবাদত-বন্দেগী, যিকির-ফিকিরে মন বসবে না। সর্বোপরি তা তার কাছে কঠিন বোধ্য হবে। তার মন সেদিকে ঝুঁকে যাবে। যদি আল্লাহ পাক উনার দয়া-অনুগ্রহ তাকে রক্ষা না করে, তাহলে পরিণামে সে ধ্বংসের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবে।

কথিত আছে, বান্দার যদি কোন কিছুতে একবার চোখ পড়ে যায়, তখন তার মনে এরূপ দাগ কাটে যা ঠিক চামড়ার রঙের মতই অবিচ্ছেদ্য হয়ে উঠে। কাজেই দৃষ্টি ছড়িয়ে চলার ভিতরে কোন কল্যাণ নেই। যদি কোন বৈধ কিছুর ওপরেও তার চোখ পড়ে, তথাপিও তা তার মনে রেখাপাত করে খুসখুসির সৃষ্টি করবে। অথচ দৃষ্টি নিবদ্ধিত সে বস্তু তার পক্ষে লাভ করা সম্ভবপর নয়। পরন্তর সেটা অর্জনের ভাবনায় মশগুল থেকে সে অনেক ভাল কাজ থেকে বঞ্চিত থাকবে। পক্ষান্তরে যদি সে তেমন কিছু না দেখতো, তা হলে তার মনে কোন কিছু পাওয়া বা না পাওয়ার অস্থিরতাই দেখা দিতো না, ফলে সে নিশ্চিন্তে, আরামেই স্বীয়  পথে চলতে পারতো।

জলীলুল ক্বদর রসূল হযরত মূসা কালীমুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার থেকে বর্ণিত রয়েছে। তিনি বলেছেন: নিজ দৃষ্টি সংযত রাখ। কারণ, তা তোমার অন্তরে কামনা-বাসনা সৃষ্টি করে। তাই রিয়াযত-মাশাক্কাতকারীর জন্য তা বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

সুলতানুল আউলিয়া, হাবীবুল্লাহ হযরত জুন্নুন মিছরী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেছেন: কামনা-বাসনা থেকে যারা মুক্ত থাকতে চায় তারা যেন দৃষ্টি নিচু করে চলে। আরেক ছূফী-সাধক এর চেয়েও সুন্দর কথা বলেছেন: যদি তুমি কোনদিন নিজের খেয়াল বসে দৃষ্টিকে এদিক ওদিক কোন কিছুর সন্ধানে চালাও তা হলে সে দৃষ্টি তোমাকে ধেঁাকায় ফেলবে। অথচ তুমি যতকিছু দেখবে তা অর্জন করা সম্ভবপর হবে না এবং তোমার মনও তার কিছু অংশ অর্জন করে তৃপ্ত হতে পারবে না।

মোটকথা, যখন তুমি দৃষ্টি নিচু রাখবে, আজে বাজে জিনিস দেখা থেকে বিরত থাকবে, এমনকি তার খেয়ালও করবে না, তখনই তুমি পরিষ্কার নির্লিপ্ত মন ও উসখুস মুক্ত স্থির ও শান্ত অন্তর লাভ করতে পারবে। বিপদ-আপদ ও দুঃখ-কষ্ট থেকে নিজকে সংরক্ষিত রাখতে পারবে এবং রিয়াযত-মাশাক্কাতে নিজকে সর্বোতভাবে নিয়োজিত রাখতে পারবে। আল্লাহ পাক কুরআন শরীফ-এ এটাও ইরশাদ করেন-

يعلم خائنة الاعين وما تخفى الصدور

অর্থ: “তিনি দৃষ্টির লুকোচুরিও জানতে পান এবং তোমাদের মনের কারসাজিও উনার অজানা নয়।”

আল্লাহ পাক ও উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দীদার ও মুহব্বত লাভের প্রত্যাশী সালিক বা সাধকের জন্যে এ ধমকই যথেষ্ট।

চোখ সম্পর্কে হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদীছ শরীফ-এ উল্লেখ করছেন-

ان النظر الى المحاسن المراة سهم سموم من سهام ابليس فمن تركها اذاقه لله طعم عبادة تسره

অর্থ: “নারীর সৌন্দর্যের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ শয়তানের তীরগুলোর মধ্যে বিষাক্ত এক তীর। কাজেই, যে ব্যক্তি তা নিক্ষেপ করে না, আল্লাহ পাক তাকে এরূপ ইবাদতের স্বাদ উপভোগ করান যা তাকে উৎফুল্ল বা আনন্দিত করে।”

হযরত আবু দারদা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন,

من غض بصره عن النظر الحرام زوجه الله من الحور العين حيث احب ومن اطلع فوق بيوت الناس حشره الله يوم القيامة اعمى.

অর্থ: যে ব্যক্তি তার চোখকে হারাম দৃষ্টি থেকে বিরত রাখবে আল্লাহ পাক তাকে তার পছন্দনীয় জান্নাতী হুরের সাথে বিয়ে দিয়ে দিবেন। আর যে ব্যক্তি কারো বাড়ি ঘরের দিকে দৃষ্টি দিবে কিয়ামতের দিন আল্লাহ পাক তাকে অন্ধ করে হাশরের ময়দানে উঠাবেন। (রিসালাতুল মুসতারশিদীন-১৭৯)

রিয়াযত-মাশাক্কাতকারী বা সাধকের কাছে ইবাদত-বন্দেগী ও দোয়া-মুনাজাতে আনন্দ লাভের মূল রহস্য এটাই। এ ব্যাপারটি অভিজ্ঞতা থেকেও জানা যায়। যে ব্যক্তি আজে বাজে দিক থেকে দৃষ্টি ও খেয়াল ফিরিয়ে রেখেছে সে অবশ্যই তার অন্তরের পরিশুদ্ধিতা ও ইবাদতের আনন্দ এমনভাবে বুঝতে পারে যা আর কখনো সে পায়নি।

মুজাদ্দিদে মিল্লাত ওয়াদ্ব দীন, হুজ্জাতুল ইসলাম, সাইয়্যিদুনা হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি আরো বলেন, হে সাধক! তোমার প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গের দিকে গভীরভাবে লক্ষ্য করে দেখ, সেগুলি কি কাজের যোগ্যতা রাখে? যদি সেগুলোর সব রহস্য তোমার কাছে খুলে যায়, তাহলে সেগুলোকে সুস্থ ও সুরক্ষিত করে তুলতে পারবে। পা হল বেহেশতের বাগ-বাগিচা ও দালান কোঠায় বিচরণের জন্য। চোখ হলো, আল্লাহ পাক ও উনার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দিকে তাকাবার জন্যে। দুনিয়া ও আখিরাতে এর চেয়ে অধিক মর্যাদা ও কারামাতের বস্তু আর কিছু্ই নেই। সুতরাং যা দিয়ে এই শ্রেষ্ঠতম মর্যাদাকর কারামত দেখবে, সে চোখকে সুস্থ ও সুরক্ষিত রাখতে হবে এবং তার যথাযোগ্য সম্মান দিতে হবে।

কাজেই, এ মূলনীতিগুলো যতক্ষণ তুমি মেনে চলবে ততক্ষণ সব দুঃখ-কষ্ট থেকে নিরাপদ থাকবে। আল্লাহ পাক তাওফীক দেয়ার মালিক। তিনি তোমার জন্যে যথেষ্ট। কতইনা উত্তম সেই অভিভাবক। (মিনহাজুল আবেদীন)

এক কথায় চোখকে সর্বপ্রকার নাফরমানী থেকে হিফাযত করতে হবে। (অসমাপ্ত)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার: মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১৫১)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছারল: মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১৫২)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার: মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১৫৩)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১৫৪)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে- (১৫৫)