সুওয়াল-জাওয়াব

সংখ্যা: ২১১তম সংখ্যা | বিভাগ:

খন্দকার সেলিম আহমদ

পাহাড় কাঞ্চনপুর, টাঙ্গাইল

সুওয়াল: হাটহাজারী মাদরাসা থেকে প্রকাশিত অখ্যাত মাসিক পত্রিকা ফেব্রুয়ারী-২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় জিজ্ঞাসা-সমাধান বিভাগে, মাসিক আল বাইয়্যিনাত-অক্টোবর ২০০৩ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রদত্ত “মীলাদ-ক্বিয়াম” সম্পর্কিত বক্তব্যের সমালোচনা করতে গিয়ে এবং একই বিষয়ে এপ্রিল-২০০৫ ঈসায়ী ও মে-২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় এছাড়াও মাসিক মদীনা পত্রিকা ফেব্রুয়ারী-২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রশ্নোত্তর বিভাগে একই ধরনের জাওয়াব দেয়া হয়েছে।

তাদের বক্তব্যগুলোর মধ্যে যে বিষয়গুলো আমার নিকট সন্দেহজনক তা নিম্নে উল্লেখ করা হলো-

যেমন, মে-২০০৫ ঈসায়ী সংখ্যায় জিজ্ঞাসা-সমাধান বিভাগে বলা হয়েছে, “বর্তমানে প্রচলিত মীলাদের মধ্যে এমন কিছু দিক বা ধারা রয়েছে যেগুলো শরীয়ত মনোনীত নয়।” …

এখন আমাদের সুওয়াল হলো, বর্তমানে প্রচলিত যে মীলাদ শরীফ দেখা যায়, সে সম্পর্কে তাদের উল্লিখিত বক্তব্য কতটুকু দলীলসম্মত? কুরআন শরীফ, সুন্নাহ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াসের দৃষ্টিতে দলীলভিত্তিক জাওয়াব দিয়ে আমাদের আক্বীদা, আমল হিফাযতে সহায়তা করবেন বলে আমরা আশাবাদী।

জাওয়াব: বর্তমানে প্রচলিত মীলাদ শরীফ ও ক্বিয়াম শরীফ সম্পর্কে হাটহাজারী মাদরাসার অখ্যাত মাসিক পত্রিকার জিজ্ঞাসার সমাধানে এবং অপর একটি পত্রিকার প্রশ্নোত্তর বিভাগে যা বলা হয়েছে তা শুদ্ধ তো হয়ইনি, বরং সম্পূর্ণই মিথ্যা, ভুল, মনগড়া ও দলীলবিহীন এবং অনুসরণীয় ইমাম-মুজতাহিদ ও ফক্বীহগণের সর্বজনমান্য ও স্বীকৃত বিশ্ব বিখ্যাত ফিক্বাহ ও ফতওয়ার কিতাবসমূহের বক্তব্যের বিপরীত ও বিরুদ্ধ মত। যা ইতঃপূর্বে আমাদের “মাসিক আল বাইয়্যিনাত শরীফ”-এর অনেক সংখ্যায় খ-ন করে সঠিক ও দলীলভিত্তিক জাওয়াব দেয়া হয়েছে। আর “মাসিক আল বাইয়্যিনাত শরীফ”-এর জাওয়াবকে খ-ন করা হাটহাজারী মৌলভী ছাহেবদের পক্ষে আদৌ সম্ভব হয়নি, হবেও না ইনশাআল্লাহ।

এরপরেও হাটহাজারীর মৌলভী ছাহেব এবং তাদের সকল সমজাতীয়রা বারবার ‘মীলাদ শরীফ ও ক্বিয়াম শরীফ’ সম্পর্কে বিনা তাহক্বীকে ও বিনা দলীলে উক্ত ভুলেরই পুনরাবৃত্তি করে যাচ্ছে।

(ধারাবাহিক)

যেমন, উল্লিখিত বক্তব্যের প্রথমেই তারা বলেছে, “বর্তমানে প্রচলিত মীলাদের মধ্যে এমন কিছু দিক বা ধারা রয়েছে যেগুলো শরীয়ত মনোনীত নয়।” …

এর জাওয়াবে বলতে হয় যে, কুরআন শরীফ-এর কোন আয়াত শরীফ-এ ‘বর্তমানে প্রচলিত মীলাদ শরীফ-এর মধ্যে কোন দিক বা কোন ধারাগুলোকে শরীয়ত মনোনীত নয়’ বলা হয়েছে এবং হাদীছ শরীফ-এর কোন হাদীছ শরীফ-এ ‘বর্তমানে প্রচলিত মীলাদ শরীফ-এর মধ্যে কোন দিক বা কোন ধারাগুলোকে শরীয়ত মনোনীত নয়’ বলা হয়েছে, তা হাটহাজারী মৌলভী ছাহেবরা কুরআন শরীফ-এর আয়াত শরীফ, হাদীছ শরীফ-এর ইবারতসহ দলীল উল্লেখ করেনি। সুতরাং তাদের দলীলবিহীন, ইবারতবিহীন, মনগড়া ও মিথ্যা বক্তব্য মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।

নি¤েœ কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস এবং বুযুর্গদের আমল দ্বারা প্রমাণিত বিস্তারিত দলীল-আদিল্লাহ পেশ করা হলো-

স্মরণীয় যে, মীলাদ শরীফ ও ক্বিয়াম শরীফ-এর মূল উদ্দেশ্য হলো আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ছানা-ছিফত করা ও উনার বিলাদত শরীফ সম্পর্কে আলোচনা করা এবং উনার প্রতি ছলাত-সালাম পাঠ করা।

যেমন- মীলাদ শরীফ-এর প্রথমেই কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করা হয়। কেননা, কোনো নেক কাজ কুরআন শরীফ তিলাওয়াতের মাধ্যমে শুরু করা রহমত, বরকত, সাকীনা তথা আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টি লাভের কারণ। সেহেতু প্রথমেই পবিত্র কালামে পাক হতে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ফযীলত সম্বলিত আয়াত শরীফ তিলাওয়াত করা হয়। যাতে স্বয়ং আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনারই মীলাদ বা ছানা-ছিফত বর্ণনা করা হয়েছে।

অতঃপর সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উপর ছলাত পাঠ করা হয়। কারণ ছলাত পাঠ করা আল্লাহ পাক ও উনার রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদেরই নির্দেশ।

তাছাড়া আমরা যেভাবে মজলিস করে মীলাদ শরীফ-এর মাহফিল করে থাকি তা খোদ আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের যামানাতেই ছিল।

আর হযরত খুলাফায়ে রাশিদীন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের থেকেও “মীলাদ শরীফ”-এর প্রমাণ রয়েছে। শুধু তাই নয়, হযরত খুলাফায়ে রাশিদীন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা স্বয়ং নিজেরাই “মীলাদ শরীফ”-এর তাগিদ করেছেন ও ফযীলত বর্ণনা করেছেন।

এছাড়াও হযরত ইমাম-মুজতাহিদীন, সলফে ছালিহীন, বুযুর্গানে দ্বীন রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনাদের থেকেও ‘মীলাদ শরীফ’ এর প্রমাণ রয়েছে-

যেমন, বাংলার মূলুকে প্রায় ৫৫ বৎসর দ্বীনের তথা ইলমে ফিক্বাহ ও ইলমে তাছাউফের প্রচার-প্রসারকারী হযরত মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার তদ্বীয় “রিসালাতুল ফায়সালা” কিতাবে উল্লেখ করেন যে-

ہمنے رسالہ ملخص میں مولود شریف کو پچیس عالموں اور  اماموں کے قول سے اور اپنے طریقہ کے پیشوا  ووں کے قول سے اور توارث سے ثابت کیا ہے اور مولد کا منع کرنیوالا فقط شخص فاکہانی  مالکی ہے سو جماعت کی مقابلہ میں انکے دھکے کااعتبار  ہے . اور قیام کو ایک مجتہد اور مکئہ معظمہ کے دو معتمد اور نامی عالم قد یم کے فتاوی سے اور بری  بری معتبر کتابو ں سے اور توارث سے ثابت کیا ہے اور یہ قیام چونکہ قیام تعظمی ہے اسواسطےاسکی اصلی حضرت عائشہ کی حدیث سےثابت  کیا ہے.

অর্থ: আমি ‘মুলাখ্খাছ’ কিতাবে পঁচিশজন আলিম ও ইমামের  বাণী ও   কর্ম দ্বারা এবং নিজ তরীক্বার বুযুর্গদের বাণী ও উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত দলীলের ভিত্তিতে মীলাদ শরীফকে যথার্থভাবেই (জায়িয) সাব্যস্ত করেছি। মীলাদ নিষেধকারী ব্যক্তি হলো মাত্র ফাকেহানী মালেকী। সুতরাং (মীলাদ জায়িয বলে ফতওয়া দানকারী) বৃহৎ জামায়াতের মতের বিরুদ্ধে তার এ ধোঁকাবাজী মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। আর একজন মুজতাহিদ ও মক্কা শরীফ-এর দু’জন বিশ্বস্ত ও প্রসিদ্ধ প্রাচীন আলিমের ফতওয়া ও বিখ্যাত কিতাবসমুহ এবং উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত দলীলের ভিত্তিতে মীলাদ শরীফ-এ “ক্বিয়াম” করা জায়িয প্রমাণ করেছি। আর উক্ত ক্বিয়াম, ক্বিয়ামে তা’যীমী বিধায় এটাকে উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা আলাইহাস্ সালাম উনার থেকে বর্ণিত হাদীছ শরীফ দ্বারা (জায়িয) প্রমাণ করেছি।”

“মুলাখ্খাছ”  কিতাবে উল্লেখ আছে-

قال علامة السيوطى اى نفع احسن من عمل المولد والقيام وانهما يهيجان محبة النبى صلى الله عليه وسلم عظمته وجلالته فى قلب فاعله.

অর্থ: “আল্লামা হযরত ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, মীলাদ ও ক্বিয়াম অপেক্ষা অধিকতর উত্তম বা ফলদায়ক আমল আর কি হতে পারে? কারণ এর দ্বারা মীলাদ ক্বিয়ামকারীর হৃদয়ে হযরত নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মুহব্বত, মর্যাদা ও মহিমার উদ্দীপনা জেগে উঠে।”

আশিকে রসূল হযরতুল আল্লামা শাহ আব্দুল হক এলাহাবাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি তদীয় “দুররুল মুনাজ্জাম” কিতাবে লিখেন-

ان القيام عند وضعه صلى الله عليه وسلم لتعظيم النبى صلى الله عليه وسلم

অর্থ: “সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বরকতময় বিলাদত শরীফ-এর আলোচনার সময় উনার সম্মানার্থে বা তা’যীম-তাকরীমের জন্যেই ক্বিয়াম করা হয়।” (আল উসীলাহ-৬৮)

উপরোক্ত কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াসের আলোচনা দ্বারা এটাই প্রমাণিত হলো যে, আল্লাহ পাক তিনি স্বয়ং নিজেই কুরআন শরীফ-এ উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ছানা ছিফত করেছেন। আর আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হাদীছ শরীফ-এ স্বয়ং নিজেই নিজের ছানা-ছিফত করেছেন। শুধুমাত্র এতটুকুই নয় বরং স্বয়ং আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি নিজেই হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের দ্বারা করিয়েছেন এবং ইজমা, ক্বিয়াসে তথা ফিক্বাহ ও ফতওয়ার কিতাবসমূহতেও এর বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে।

আর মীলাদ শরীফ-এর আলোচ্য বিষয়ই হচ্ছে আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ছানা-ছিফত করা। তাহলে কি করে একথা বলা যেতে পারে যে, “বর্তমানে প্রচলিত মীলাদের মধ্যে এমন কিছু দিক বা ধারা রয়েছে যেগুলো শরীয়তে মনোনীত নয়।”

প্রকৃতপক্ষে তাদের এ বক্তব্য দ্বারা তারা কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াসকেই অস্বীকার করেছে। যার ফলে তারা ঈমান ও ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে গেছে। কারণ, আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি ঈমান না আনা পর্যন্ত শুধুমাত্র তাওহীদের উপর ঈমান আনলে ক্বিয়ামত পর্যন্ত কোন ব্যক্তির পক্ষে ঈমানদার হওয়া সম্ভব নয় বা কোন ব্যক্তি ঈমানদার হতে পারবে না। (চলবে)

মুহম্মদ আতিকুল্লাহ

পুরান বাজার, চাঁদপুর

 

সুওয়াল: মাসিক মদীনার সম্পাদক মাহিউদ্দীন সেপ্টেম্বর, জুন, জুলাই-২০১১ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রশ্নোত্তর বিভাগে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে মাটির তৈরী প্রমাণ করতে গিয়ে যেসব বক্তব্য ও যুক্তি দিয়েছে নি¤েœ তা উল্লেখ করা হলো।

১। নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি নূরের তৈরী একথা কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ-এর কোথাও নেই।

২। কুরআন শরীফ-এর অনেক আয়াত শরীফ দ্বারাই প্রমাণিত যে, নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি মাটির তৈরী।

৩। সমস্ত নবীগণই হযরত আদম আলাইহিস সালাম উনার সন্তান। তিনি যেহেতু মাটির তৈরী, তার সন্তানেরা কি করে নূরের তৈরী হতে পারে?

৪। কুরআন শরীফ-এর অনেক আয়াতে নূর শব্দ দ্বারা কুরআন শরীফ ও হেদায়েতের আলোকে বুঝানো হয়েছে। রসূল পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে নয়।

৫। রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রক্তে গোশতের গঠনে (মাটির) মানুষ ছিলেন বলে উনার শরীর মুবাক থেকে তায়েফ ও উহুদে রক্ত মুবারক ঝড়েছে। নূরের হলে রক্ত মুবারক ঝড়ার প্রশ্নই আসতো না।

মাসিক মদীনার সম্পাদক মাহিউদ্দীনের উল্লিখিত বক্তব্যসমূহের সঠিক জাওয়াব দিয়ে আমাদের ঈমান-আমল হিফাযতে সহায়তা করবেন বলে আমরা আশাবাদী।

জাওয়াব: মাটির তৈরী সম্পর্কে মাহিউদ্দীনের প্রথম বক্তব্য হচ্ছে-

১। নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি নূরের তৈরী একথা কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ-এর কোথাও নেই।

এর জাওয়াবে বলতে হয় যে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি মাটির তৈরী সম্পর্কিত মাসিক মদীনা পত্রিকার সম্পাদক মাহিউদ্দীনের উক্ত বক্তব্য ভুল, দলীলবিহীন, ডাহা মিথ্যা। কারণ সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর  পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যে নূরের তৈরী বা ‘নূর’ তা সরাসরি কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ-এ উল্লেখ আছে।

যেমন, কুরআন শরীফ-এ্র মহান আল্লাহ্ পাক তিনি ইরশাদ করেন-

قد جاءكم من الله نور وكتاب مبين

অর্থ: “নিশ্চয়ই তোমাদের নিকট মহান আল্লাহ্ পাক উনার পক্ষ হতে এক মহান নূর এবং একখানা সুস্পষ্ট কিতাব এসেছে।” (সূরা মায়িদা: আয়াত শরীফ- ১৫)

উল্লেখ্য, এ আয়াত শরীফ-এ মহান আল্লাহ পাক তিনি ‘নূর’ শব্দ দ্বারা সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ্্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে বুঝিয়েছেন, যেহেতু তিনি আপাদমস্তক নূর বা নূরের তৈরী। বিশ্বখ্যাত ও অনুসরণীয় সকল মুফাসসিরীনে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ উনাদের অভিমতও এটাই। নি¤েœ বিশ্ববিখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য তাফসীরসমূহ হতে আয়াত শরীফে বর্ণিত ‘নূর’ শব্দের ছহীহ ও গ্রহণযোগ্য তাফসীর বা ব্যাখ্যা তুলে ধরা হলো-

যেমন এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত ছাহাবী রঈসুল মুফাস্সিরীন হযরত ইবনে আববাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন-

قد جاءكم من الله نور يعنى محمد صلى الله عليه وسلم

অর্থ: “নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক উনার তরফ থেকে তোমাদের নিকট ‘নূর’ অর্থাৎ ‘মুহম্মদ’ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি এসেছেন।’’

প্রখ্যাত মুফাস্সির আল্লামা আবু মুহম্মদ হুসাইন ইবনে মাসউদ ফাররাউল বাগবী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বিখ্যাত তাফসীর, “তাফসীরে মায়ালিমুত তানযীল” কিতাবের ২য় খ-ের ২৮ পৃষ্ঠায় লিখেন-

(قد جاءكم من الله نور) يعنى محمد صلى الله عليه وسلم

অর্থ: “মহান আল্লাহ পাক উনার পক্ষ হতে তোমাদের নিকট ‘নুর’ অর্থাৎ সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি এসেছেন।”

আল্লামাতুল হিব্র, বাহরুল ফাহ্হামাহ, হামিলুশ্ শরীয়ত ওয়াত তরীক্বত, বায়হাক্বিউল ওয়াক্বত, আলামুল হুদা আল্লামা কাজী মুহম্মদ ছানাউল্লাহ্ ওছমানী হানাফী পানি পথি রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ ‘‘তাফসীরে মাযহারী’’ কিতাবের ৩য় খ-ের ৬৮ পৃষ্ঠায় লিখেন-

قد جاءكم من الله نور يعنى محمد صلى الله عليه وسلم.

অর্থ: “তোমাদের নিকট মহান আল্লাহ পাক উনার পক্ষ হতে ‘নুর’ অর্থাৎ সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি এসেছেন।”

আর হাদীছ শরীফেও সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে ‘নূর’ বলা হয়েছে এবং অনুসরণীয় অনেকেই উনাদের নিজ নিজ কিতাবসমূহে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে ‘নূর’ বলে উল্লেখ করেছেন। যেমন হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে-

عن حضرت جابر رضى الله تعالى عنه قال ……. ان الله تعالى قد خلق قبل الاشياء نور نبيك ……

অর্থ: “হযরত জাবির রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ….. নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক সবকিছুর পূর্বে আপনার নবী উনার নূর মুবারককে সৃষ্টি করেছেন। …..।” (মুসনাদে আব্দুর রাজ্জাক, দালায়িলুন নুবুওওয়াত, আফযালুল ক্বোরা, মুতালিউল মাসাররাত, তারীখুল খামীছ, মাওয়াহিব, শরহে যুরক্বানী, মাদারিজুন নুবুওওয়াত, নূরে মুহম্মদী, ফতওয়ায়ে হাদীসিয়্যাহ, নশরুততীব)

ইমামুল মুহাদ্দিছীন আল্লামা শায়খ আব্দুল হক্ব মুহাদ্দিছ দেহলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মশহূর কিতাব “মাদারিজুন নুবুওওয়াত” কিতাবের ২য় খ-ের ২ পৃষ্ঠায় লিখেন-

در حديث صحيح وارد شد كه اول ما خلق الله نورى.

অর্থ: ছহীহ হাদীছ শরীফ-এ বর্ণিত হয়েছে যে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, মহান আল্লাহ পাক সর্বপ্রথম আমার নূর মুবারক সৃষ্টি করেন।

বিখ্যাত তাফসীরগ্রন্থ “তাফসীরে রুহুল মায়ানীর” লেখক সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ‘নূর মুবারক’ প্রথম সৃষ্টি হওয়া সম্পর্কে লিখেন-

ولذا كان نوره صلى الله عليه وسلم اول المخلوقات ففى الخبر اول ما خلق الله تعالى نور نبيك يا جابر رضى الله تعالى عنه.

অর্থ: কেননা সকল মাখলূক্বাতের মধ্যে সর্বপ্রথম সৃষ্টি হলেন ‘নূরে হাবীবী’ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। যেমন- আল্লাহ পাক সর্বপ্রথম আপনার নবী উনার ‘নূর মুবারককে সৃষ্টি করেন।

আল্লামা আবুল হাসান বিন আব্দিল্লাহ আল বিকরী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ‘আল আনওয়ার ফী মাওলিদিন নাবিইয়িল মুহম্মদ’ কিতাবের ৫ম পৃষ্ঠায় লিখেন-

قال حضرت على رضى الله تعالى عنه كان الله ولا شىء معه فاول ما خلق الله نور حبيبه قبل ان يخلق الماء  والعرش والكرسى واللوح والقلم والجنة والنار والحجاب

অর্থ: হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহূ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, শুধুমাত্র আল্লাহ পাক তিনিই ছিলেন, তখন অন্য কোন অস্তিত্বই উনার সাথে ছিল না। অতঃপর তিনি পানি, আরশ, কুরসী, লওহো, ক্বলম, জান্নাত, জাহান্নাম ও পর্দাসমূহ ইত্যাদি সৃষ্টি করার পূর্বে উনার হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নূর মুবারক সৃষ্টি করেন।

উপরোক্ত দলীলভিত্তিক আলোচনা থেকে এটাই প্রমাণিত হলো যে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি নূরের তৈরী বা নূর একথা সরাসরি কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ-এ উল্লেখ আছে।

কাজেই, মাসিক মদীনা পত্রিকার সম্পাদক মাহিউদ্দীন যে বলেছে, “নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি নূরের তৈরী একথা কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ-এর কোথাও নেই” তার এ বক্তব্য ডাহা মিথ্যা ও দলীলবিহীন বলেই প্রমাণিত হলো।

 

ইবনে খাইরুল ইসলাম

মানিকনগর, ঢাকা

সুওয়াল: কোন মাস ও দিনকে অশুভ ও কুলক্ষণে মনে করা এবং কোন রোগ-ব্যাধিকে ছোঁয়াচে বা সংক্রামক মনে করার ব্যাপারে শরীয়তে কোন বিধি-নিষেধ আছে কি না? জানিয়ে বাধিত করবেন।

জাওয়াব: কোন মাস ও দিনকে অশুভ ও কুলক্ষণে মনে করা কুফরী এবং একইভাবে কোন রোগ-ব্যাধিকে সংক্রামক বা ছোঁয়াচে মনে করাটাও কুফরীর অন্তর্ভুক্ত।

বর্ণিত রয়েছে, আইইয়ামে জাহিলিয়াতে ছফর মাসকে অশুভ ও কুলক্ষণে মনে করা হতো। আল্লাহ পাক উনার হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি তাদের সে ভ্রান্ত আক্বীদা-বিশ্বাসের মূলোৎপাটন করেন।

যেমন হাদীছ শরীফ-এ বর্ণিত রয়েছে-

عن حضرت ابى هريرة رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم لاعدوى ولا هامة ولا نوء ولا صفر

অর্থ: হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বর্ণনা করেন, আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, “সংক্রামক রোগ বলতে কিছু নেই। পেঁচার মধ্যে কুলক্ষণের কিছুই নেই। তারকার (উদয় বা অস্ত যাওয়ার) কারণে বৃষ্টি হওয়াও ভিত্তিহীন এবং ছফর মাসে অশুভ বলতে কিছু নেই।” (মুসলিম শরীফ, মিশকাত শরীফ-৩৯১, শরহুস্ সুন্নাহ্-৬/২৭১)

হাদীছ শরীফে আরো বর্ণিত রয়েছে-

عن حضرت عبد الله بن مسعود رضى الله تعالى عنه عن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال الطيرة شرك قاله ثلاثا

অর্থ: হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহু তিনি বর্ণনা করেন, আল্লাহ পাক উনার হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, “যে কোন বিষয়কেই অশুভ ও  কুলক্ষণে মনে করা শিরকের অন্তর্ভুক্ত। তিনি এ বাক্যটি তিনবার উল্লেখ করেছেন।” (আবূ দাউদ, তিরমিযী শরীফ, মাওয়ারিদ, মুসনাদে আহমদ ইবনে হাম্বল-১/৪৩৮, শরহুস্ সুন্নাহ্-৬/২৭৪, মিশকাত শরীফ-৩৯২, শরহুত্  ত্বীবী-৮/৩২)

হাদীছ শরীফ-এ আরো বর্ণিত রয়েছে-

عن حضرت ابى هريرة رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم لاعدوى ولا هامة ولا صفر فقال اعرابى يا رسول الله صلى الله عليه وسلم فما بال الابل تكون فى الرمل لكانها الظباء فيخالطها البعير الاجرب فيجربها فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم فمن اعدى الاول.

অর্থ: হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বর্ণনা করেন, আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, “কোন রোগই সংক্রামক নয়। পেঁচার মধ্যে কুলক্ষণের কিছুই নেই এবং ছফর মাসের মধ্যেও অশুভ কিছু নেই। তখন এক ব্যক্তি বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! তাহলে উটের এ অবস্থা হলো কেন? যে উটগুলো ছিল জংলী হরিণের মত তরু-তাজা, যেগুলো ময়দানে স্বাধীনভাবে বিচরণ করতো। এমতাবস্থায় কোথা হতে এক চর্মরোগাক্রান্ত উট এসে সে উটের পালে মিলিত হলো এবং উটগুলোকে চর্মরোগী বানিয়ে দিলো। ফলে এ উটগুলোও খুজলীযুক্ত হয়ে গেল। তখন হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, আচ্ছা, তাহলে প্রথম উটটির চর্মরোগ কোথা থেকে আসলো? অর্থাৎ প্রথম উটটি যেভাবে খুজলীযুক্ত হয়েছিল ঠিক পরবর্তী উটগুলোও সেভাবে খুজলীযুক্ত হয়েছে।” (বুখারী শরীফ, মিশকাত শরীফ/৩৯১, শরহুস্ সুন্নাহ্-৬/২৬৫)

স্মরণীয় যে, চিকিৎসা শাস্ত্রের পাঠ্যসূচিতে ইসলামী আক্বায়িদ সংক্রান্ত ইলম না থাকার কারণে কোন কোন চিকিৎসক কিছু কিছু রোগ সম্পর্কে যেমন- চর্মরোগ, খুজলী-পাঁচড়া, কুষ্ঠ, কলেরা-বসন্ত ইত্যাদিকে সংক্রামক বা ছোঁয়াচে বলে অভিমত ব্যক্ত করে থাকে। যা শরীয়তে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কাজেই, এরূপ ভ্রান্ত ও কুফরী আক্বীদা হতে বিরত থাকা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরয-ওয়াজিবের অন্তর্ভুক্ত।

তবে ভাল লক্ষণ সম্পর্কে ধারণা করার অবকাশ আছে। অর্থাৎ তা মুস্তাহাব- সুন্নত।

যেমন এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে বর্ণিত রয়েছে-

عن حضرت ابى هريرة رضى الله تعالى عنه قال سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول لا طيرة وخيرها الفال قالوا وما الفال قال الكلمة الصالحة يسمعها احدكم.

অর্থ: হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, আমি শুনেছি যে, আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, “কোন বিষয়কে অশুভ কুলক্ষণে মনে করোনা, তবে শুভ লক্ষণ আছে। ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ আরয করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! শুভ লক্ষণ কি? তখন তিনি বললেন, উত্তম কথা, যা তোমাদের মধ্য হতে কেউ শুনতে পায়।” (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, মিশকাত শরীফ, শরহুত্ ত্বীবী-৮/৩১৩, শরহুস সুন্নাহ-৬/২৭২)

উল্লেখ্য, বর্তমানে সমাজে আরো যেসব কুফরীমূলক ভ্রান্ত আক্বীদা ও কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে তাহলো: (১) রাস্তা চলার সময় কোন প্রাণী যদি ডান থেকে রাস্তা অতিক্রম করে বাম দিকে যায় তাহলে যাত্রা শুভ, কল্যাণকর হবে। আর যদি বিপরীত দিকে যায় তাহলে কুলক্ষণে বা অমঙ্গল হবে, এরূপ বিশ্বাস করা। (২) শান্তির প্রতীক বা শান্তি লাভের আশায় পাখি উড়িয়ে দেয়া।

(৩) ঘুম থেকে উঠে পেঁচা দেখা কিংবা রাতে পেঁচার ডাক শুনলে কুলক্ষণের পূর্বাভাস মনে করা।

(৪) অনেকে সকালে ঘুম থেকে উঠে যদি কোন বন্ধ্যা ব্যক্তিকে দেখতে পায় কিংবা খালী কলস দেখতে পায় তাহলে সারাদিন অমঙ্গলে অতিবাহিত হবে বা কোন কল্যাণ অর্জিত হবেনা বলে ধারণা করা। (৫) শনিবার এবং মঙ্গলবার ইন্তিকাল করাকে কুলক্ষণ এবং জাহান্নামী হওয়ার আলামত বলে মনে করে। যা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা তথা কুসংস্কারের অন্তর্ভুক্ত। কেননা নবী আলাইহিমুস সালামগণ উনাদের পরে শ্রেষ্ঠ মানুষ ছিদ্দীক্বে আকবর হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি মঙ্গলবার বিছাল শরীফ লাভ করেন। আর দ্বিতীয় ও চতুর্থ খলীফা, খলীফাতুল মুসলিমীন, যথাক্রমে সাইয়্যিদুনা হযরত উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং সাইয়্যিদুনা হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহূ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনারা শনিবার বিছাল শরীফ লাভ করেছেন। (৬) পরীক্ষার পূর্বক্ষণে ডিম বা কলা খাওয়াকে পরীক্ষা পাশের প্রতিবন্ধক মনে করা। (৭) সময়কে গালি দেয়া, জোরে বাতাস প্রবাহিত হতে দেখলে বাতাসকে গালি দেয়া, আকাশে দীর্ঘ সময় মেঘ থাকতে দেখলে মেঘকে গালি দেয়া ইত্যাদি।

অতএব, প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীকে নিজেদের ঈমানকে হিফাযত করতে হলে যাবতীয় কুফরী আক্বীদা থেকে বেঁচে থাকাটা ফরয-ওয়াজিবের অন্তর্ভুক্ত।

 

মুহম্মদ শামীম হুসাইন

শনি আখড়া, ঢাকা

 

সুওয়াল : আখিরী চাহার শোম্বাহ অর্থ কি? আখিরী চাহার শোম্বাহ পালন করা শরীয়ত সম্মত কিনা? অনেকে এটাকে বিদ্য়াত বলে থাকে। তা কতটুকু দলীলভিত্তিক দয়া করে জানাবেন।

জাওয়াব : ‘আখির’ শব্দটি আরবী। এর অর্থ- শেষ। আর ‘চাহার শোম্বাহ’ হচ্ছে ফারসী শব্দ। এর অর্থ- বুধবার। আরবী ও ফারসী শব্দের সংমিশ্রণে ‘আখিরী চাহার শোম্বাহ’ বলতে ছফর মাসের শেষ বুধবারকে বুঝানো হয়ে থাকে। মূলত এ দিনটি মুসলিম উম্মাহর জন্য মহা খুশির দিন।

এ মুবারক দিনটির ফযীলত সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, রহমতুল্লিল আলামীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বিছাল শরীফ-এর পূর্ববর্তী মাসের অর্থাৎ ছফর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে তিনি ভীষণভাবে অসুস্থতা অনুভব করেন। দিন দিন উনার অসুস্থতা বাড়তেই থাকে। কিন্তু ছফর মাসের শেষ বুধবার দিন ভোর বেলা ঘুম থেকে জেগে তিনি বললেন, ‘আমার নিকট কে আছেন?’ এ কথা শুনামাত্রই উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম তিনি তাড়াতাড়ি করে আসলেন এবং বললেন, ‘ইয়া রসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমার মাতা-পিতা আপনার জন্য কুরবান হোক। আমি হাযির আছি।’ তখন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, ‘হে উম্মুল মু’মিনীন আয়িশা ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম! আমার মাথা মুবারক-এর ব্যথা দূর হয়ে গেছে এবং শরীর মুবারকও বেশ হালকা মনে হচ্ছে। আমি আজ বেশ সুস্থতা বোধ করছি।’ সুবহানাল্লাহ! এ কথা শুনে উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হলেন এবং তাড়াতাড়ি পানি আনয়ন করে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মাথা মুবারক ধুয়ে দিলেন এবং সমস্ত শরীর মুবারক-এ পানি ঢেলে ভালোভাবে গোসল করিয়ে দিলেন।

এই গোসলের ফলে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম উনার শরীর মুবারক হতে বহু দিনের অসুস্থতাজনিত অবসাদ অনেকাংশে দূর হয়ে গেলো। তারপর উনি বললেন, ‘হে উম্মুল মু’মিনীন আয়িশা ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম! ঘরে কোনো খাবার আছে কি?’ তিনি জবাব দিলেন, ‘জী-হ্যাঁ, কিছু রুটি পাকানো আছে।’ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, ‘আমার জন্য তা নিয়ে আসুন আর হযরত মা ফাতিমাতুয যাহরা আলাইহাস সালাম উনাকে খবর দিন, তিনি যেনো উনার আওলাদগণ উনাদেরকে সঙ্গে নিয়ে তাড়াতাড়ি আমার নিকট চলে আসেন।’ উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম তিনি হযরত যাহরা আলাইহাস সালাম উনাকে সংবাদ দিলেন এবং ঘরে যে খাবার তৈরি ছিলো তা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নিকট পরিবেশন করলেন।

হযরত যাহরা আলাইহাস সালাম উনার আওলাদগণ উনাদেরকে নিয়ে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নিকটে হাযির হলেন। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হযরত মা যাহরা আলাইহাস সালাম উনাকে নিজের গলা মুবারক-এর সাথে জড়িয়ে স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিলেন, নাতিগণ উনাদের কপাল মুবারক-এ চুমো খেলেন এবং উনাদেরকে সাথে নিয়ে আহারে বসলেন। কয়েক লোকমা খাবার গ্রহণ করার পর অন্যান্য উম্মুল মু’মিনীন আলাইহিন্নাস সালাম উনারা খিদমতে এসে হাযির হলেন। অতঃপর পর্যায়ক্রমে বিশিষ্ট ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ উনারাও বাইরে এসে হাযির হন। কিছুক্ষণ পর হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বাইরে এসে উনাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘হে ছাহাবীগণ! আমার বিদায়ের পর আপনাদের অবস্থা কিরূপ হবে?’ এ কথা শুনে ছাহাবীগণ উনারা ব্যাকুলচিত্তে কান্না শুরু করলেন। উনাদের এ অবস্থা দেখে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উনাদেরকে সান্ত¡না দান করলেন। অতঃপর হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি মসজিদে নববী শরীফ-এ ওয়াক্তিয়া নামাযের ইমামতি করলেন।

আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দীর্ঘদিন অসুস্থতা অনুভবের পর সুস্থ দেহ মুবারক-এ মসজিদে নববী শরীফ-এ আগমন করেন এবং নামাযের ইমামতি করেন এই অপার আনন্দে ছাহাবীগণ উনারা নিজ নিজ সামর্থ্য অনুসারে অনেক কিছু দান-খয়রাত করেন। কোনো কোনো বর্ণনায় জানা যায় যে, খুশিতে বাগবাগ হয়ে হযরত আবু বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি সাত হাজার দীনার, হযরত উমর ফারুক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি পাঁচ হাজার দীনার, হযরত উসমান যুন নূরাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি দশ হাজার দীনার, হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি তিন হাজার দীনার, হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি একশত উট ও একশত ঘোড়া আল্লাহ পাক উনার রাস্তায় দান করতঃ আল্লাহ পাক ও উনার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের মুহব্বত ও সন্তুষ্টি লাভ করেন। মহান আল্লাহ পাক উনার মা’রিফত-মুহব্বতে দগ্ধিভূত ব্যক্তিগণ উনারা সে দিনটিকে মা’রিফত-মুহব্বত লাভের উসীলা সাব্যস্ত করেছেন।

উক্ত দিনের শেষ প্রান্তে আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি পুনরায় অসুস্থতা বোধ করেন অতঃপর ১২ই রবীউল আউয়াল শরীফ-এ রফীকে আ’লা উনার পরম দীদারে মিলিত হন।

হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ উনাদের নীতি অনুসরণে মুসলমানগণ যুগ যুগ ধরে ‘আখিরী চাহার শোম্বাহ’ পালন করে আসছেন। কালামুল্লাহ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে, “যারা ছাহাবীগণ উনাদেরকে উত্তমভাবে অনুসরণ করে আল্লাহ পাক তিনি উনাদের প্রতি সন্তুষ্ট।” (সূরা তওবা : আয়াত শরীফ ১০০)

অনেকে ‘আখিরী চাহার শোম্বাহ’ উদযাপন করাকে নাজায়িয ও বিদয়াত বলে আখ্যায়িত করে থাকে। নাঊযুবিল্লাহ! যা সম্পূর্ণ অশুদ্ধ ও ভুল। বরং হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ উনাদের অনুসরণে ‘আখিরী চাহার শোম্বাহ’ উপলক্ষে সাধ্যমত গরিব-মিসকীনদেরকে দান-ছদকা করা, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি অধিক পরিমাণে ছলাত-সালাম, মীলাদ শরীফ, ক্বিয়াম শরীফ ও দুরূদ শরীফ পাঠ করা অত্যন্ত ফযীলত ও মর্যাদা লাভের কারণ। {দলীল: সমূহ সীরাতগ্রন্থ।}

 

মুহম্মদ রফীকুল ইসলাম

মোমেনশাহী

 

সুওয়াল: হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ফাযায়িল-ফযীলত ও সংক্ষিপ্ত সাওয়ানেহ উমরী মুবারক জানতে বাসনা রখি।

জাওয়াব: আল্লাহ পাক উনার ওলীগণকে মুহব্বত ও অনুসরণ-অনুকরণ করার কথা খোদ কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ-এই রয়েছে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ করেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ পাক, উনার রসূল ও উলিল আমরগণ উনাদেরকে অনুসরণ কর।’ আর নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ করেন, ‘তোমরা মহান আল্লাহ পাক-এর ওলীগণ উনাদেরকে মুহব্বত কর। কারণ, উনারা আল্লাহ পাক উনার নিকট মকবূল। আর উনাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করো না। কেননা, উনারা আল্লাহ পাক উনার পক্ষ থেকে সাহায্যপ্রাপ্ত।’

মহান আল্লাহ পাক ও উনার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদেরই নির্দেশ হচ্ছে, উলীল-আমর তথা আল্লাহ পাক উনার ওলীগণ উনাদেরকে মুহব্বত ও অনুসরণ-অনুকরণ করা। আর আফযালুল আউলিয়া, কাইয়্যুমে আউয়াল হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি হলেন একজন খাছ উলীল আমর বা আল্লাহ পাক উনার ওলী তথা সত্যিকার নায়িবে রসূল।

কাইয়্যুমে আউয়াল হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি এমনই একজন উলিল আমর বা নায়িবে রসূল উনার সম্পর্কে স্বয়ং আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদীছ শরীফ বর্ণনা করেছেন। যেমন তিনি ইরশাদ করেন, “হিজরী একাদশ শতাব্দীর আরম্ভকালে আল্লাহ পাক এমন এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করবেন, যিনি একটি বৃহৎ নূর। উনার নাম মুবারক হবে আমার নাম মুবারক-এর অনুরূপ। দুই অত্যাচারী বাদশাহর রাজত্বকালের মাঝে তিনি আবির্ভূত হবেন এবং উনার সুপারিশে অগণিত মানুষ বেহেশতে প্রবেশ করবেন।” সুবহানাল্লাহ!

হাদীছ শরীফ-এ আরো ইরশাদ হয়েছে, “আমার উম্মতের মধ্যে এমন এক ব্যক্তি আগমন করবেন যাঁকে ‘ছিলাহ’ উপাধি দেয়া হবে। উনার সুপারিশের কারণে অগণিত লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে।” সুবহানাল্লাহ! সুলতানুল আরিফীন হযরত জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ‘জামউল জাওয়াম’ ও ‘জামিউদ্ দুরার’ কিতাবে উল্লিখিত হাদীছ শরীফ দু’খানা উল্লেখ করেছেন।

‘সম্রাট আকবর’ সৃষ্ট ফিৎনার চরম সময়ে ৯৭১ হিজরীর ১৪ই শাওয়াল (ইংরেজি ১৫৬৩ সাল) ইমামে রব্বানী হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বিলাদত শরীফ লাভ করেন পাঞ্জাব প্রদেশের পাতিয়ালার সিরহিন্দ শরীফ-এ। মাত্র ছয় বছর বয়স মুবারকে তিনি কুরআন শরীফ হিফয করেছিলেন। অতঃপর কানপুরস্থ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে জগৎ বরেণ্য আলিমগণের নিকট তিনি হাদীছ শরীফ, তাফসীর, ফিক্বাহ, সাহিত্য, কাব্য, ইতিহাস, ভূগোল, দর্শন, বিজ্ঞানসহ ইসলামী ইলমের সকল শাখায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। কামালতের পরিপূর্ণ ধাপে উত্তরণের জন্য তিনি ওলীকুল শিরোমনি হযরত খাজা বাকী বিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার কাছে বাইয়াত হন।

হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি হযরত খাজা বাকী বিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার কাছে মুরীদ হওয়ার পূর্বেই উনার বুযূর্গ পিতা হযরত শায়খ আব্দুল আহাদ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার কাছে চৌদ্দটি তরীকার কামালত হাছিল করেন। এ সমুদয় তরীকা বিশ্লেষণ ও অনুশীলনের মাধ্যমে উনার ভিতর ‘মুজাদ্দিদসুলভ’ কামালতের এক মানসভূমি তৈরি হয়ে যায়। এর সাথে যুক্ত হয় হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কাছ থেকে পাওয়া খাছ কামালতসমূহ। আর এতে করেই আল্লাহ পাক উনার মনোনীত দ্বিতীয় সহস্র হিজরীর ‘মুজাদ্দিদ’ হিসেবে উনার মধ্যে সমাবেশ ঘটে ইমামত ও কাইয়্যুমিয়াতের। আল্লাহ পাক প্রদত্ত নিয়ামত ও যোগ্যতাবলে তিনি নক্্শবন্দিয়া তরীক্বার সংস্কার সাধন করেন এবং নুবুওওয়াতে কামালতের সাথে এ তরীক্বার সেতুবন্ধন রচনা করেন। এভাবে পৃথিবীতে সকল কামালতের সংযোগ বিশিষ্ট ‘মুজাদ্দিদিয়া তরীক্বা’ জন্মলাভ করে। হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার পরে এই তরীক্বা অথবা অন্য কোন সিলসিলায় এমন প্রাতিষ্ঠানিক অগ্রগতির কথা বাহ্যিকভাবে জানা যায়নি।

আকবর নিদারুণ মর্মপীড়া ও শারীরিক অসুস্থতায় আক্রান্ত হয়। অবশেষে ১৫৫৬ থেকে ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের রাজত্বের অবসানে ১৬০৬ সালে আকবরের মৃত্যু হয়। কিন্তু সে তার আদর্শ সঞ্চারিত করে যায় শাহজাদা জাহাঙ্গীরের মন ও মননে। সম্রাট আকবরের মৃত্যুর পর তার আটত্রিশ বছরের পুত্র জাহাঙ্গীর মোঘল সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। একপর্যায়ে সম্রাজ্ঞী নূরজাহান, আসিফ খান এবং অন্যান্য রাজন্যবর্গ ও আমলাদের সুপারিশে হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে জাহাঙ্গীর কারাবন্দি করেন। এ কারাবাসকে হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি- নির্জনতায় উনার মর্যাদা ও মর্তবা উত্তরণের অনুকূল ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করেছেন। সুদীর্ঘ দু’বছর কারাবাসকালে উনি নিয়ামতপূর্ণ ছোহবত দান করে অনেক কারাবন্দিকে তিনি হিদায়েতের পথে এনেছেন। এরই মাঝে উনার অসংখ্য মুরীদ ও খলীফার মধ্যে খিলাফত প্রতিষ্ঠার তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। স¤্রাট জাহাঙ্গীর ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উনাকে গোয়ালিয়ার দুর্গ থেকে মুক্তি দিয়ে রাজ দরবারের অন্তঃপুরে নজরবন্দি করে রাখেন। অবশেষে বিজয় সূচিত হয় তখন, যখন স¤্রাট জাহাঙ্গীর হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে নিঃশর্ত মুক্তি দিয়ে উনার কাছে মুরীদ হন।

সম্রাট আকবরের সময়ে যে সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়েছিল তা জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে বাস্তবায়িত হয়। আন্দোলনের তীব্রতার মুখে মানসিক দিক দিয়ে পর্যুদস্ত জাহাঙ্গীর হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে কারাবাস থেকে মুক্তি দিয়ে উনার সাক্ষাৎলাভের অনুমতি প্রার্থনা করেন। সাক্ষাৎ দানের পূর্বে তিনি যে সব শর্ত আরোপ করেছিলেন তা হলো- (১) রাজ দরবারে তা’যিমী সিজদা প্রথা রহিতকরণ (২) সকল মসজিদের পুনঃনির্মাণ (৩) জিজিয়া কর পুনঃপ্রবর্তন (৪) ইসলামী শাসন ব্যবস্থা চালু করার জন্য কাজী ও মুফতী নিয়োগ (৫) সকল বিদয়াত কার্যকলাপ নিষিদ্ধকরণ; (৬) গরু যবেহ করার উপর নিষেধাজ্ঞা রহিতকরণ; (৭) সংস্কার আন্দোলনে সকল কারারুদ্ধ ব্যক্তিকে মুক্তিদান।

সম্রাট জাহাঙ্গীর সকল শর্তই মেনে নিয়ে হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি উনার মুরীদ হন এবং উনার উপদেশ মতো সাম্রাজ্য পরিচালনা করতে থাকেন। উনার উপদেশেই জাহাঙ্গীর শাসননীতিতে ইসলামী আইন সংযোজন করেন। জাহাঙ্গীর শেষ জীবনে প্রায়ই বলতেন, “আখিরাতে নাজাত পেতে পারি, এমন কোন কাজ (আমল) আমি করিনি। তবে আমার কাছে একটি সনদ আছে, আখিরাতে আমি তা আল্লাহ পাক উনার সমীপে পেশ করবো। সে সনদ এই যে, একদিন হযরত শায়খ আহমদ ফারুক্বী সিরহিন্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি আমাকে বলেছেন- যদি আল্লাহ পাক আমাকে জান্নাতে যাওয়ার অনুমতি দান করেন তবে আপনাকে ছেড়ে যাবো না।” সুবহানাল্লাহ!

হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি নিজ জীবনে সুন্নতের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ঘটিয়ে আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টি হাছিল করেন। মানুষের মাঝে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সুন্নত অনুসরণের স্পৃহা জাগিয়ে তুলে তিনি অবলুপ্ত সকল সুন্নত যিন্দা করেন। এ জন্য উনাকে বলা হয় ‘মুহইস সুন্নাহ’।

সুন্নতের পরিপূর্ণ অনুসারী এবং আল্লাহ পাক উনার যমীনে সুন্নত যিন্দাকারী হাজার বছরের মুজাদ্দিদ- হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি উনার বড় সাধ, উনার কর্মময় জীবনাবসানের সর্বশেষ কাজটিও যেনো সুন্নতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়। তিনি আপনজন, খলীফা ও মুরীদগণকে ডেকে বললেন, “হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তেষট্টি বছর বয়স মুবারকে নশ্বর পৃথিবী থেকে আল্লাহ পাক উনার দীদারে প্রত্যাবর্তন করেন।” অবশেষে সময় ঘনিয়ে এলো। তেষট্টি বছর বয়স মুবারকে বিছাল শরীফ দান করে আমল ও ক্ষমতা বহির্ভূত সুন্নত অনুসরণের উনার এই অন্তিম বাসনাকে আল্লাহ পাক পূর্ণতা দিয়েছেন। সুবহানাল্লাহ! হিজরী ১০৩৪ (ইংরেজি ১৬২৪ সাল) ২৮শে ছফর তিনি বিছাল শরীফ লাভ করেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিউন)

প্রত্যেকের দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে- আফযালুল আউলিয়া, কাইয়্যুমে আউয়াল হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি সম্পর্কে জানা, উনাকে মুহব্বত ও অনুসরণ-অনুকরণ করে মহান আল্লাহ পাক ও উনার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের খাছ রেযামন্দি হাছিল করা।

 

মুহম্মদ আব্দুল্লাহ

সদর, নরসিংদী

 

সুওয়াল: সাইয়্যিদুনা হযরত ইমাম হাসান আলাইহিস সালাম উনার ফাযায়িল-ফযীলত ও সংক্ষিপ্ত সাওয়ানেহ উমরী মুবারক জানতে বাসনা রখি।

জাওয়াব: সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিয়্যীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বংশধারা সাইয়্যিদাতুন্্ নিসা, আহলিল জান্নাহ হযরত ফাতিমাতুয যাহরা আলাইহাস সালাম ও উনার আওলাদদ্বয় সাইয়্যিদা শাবাবি আহলিল জান্নাহ হযরত ইমাম হাসান আলাইহিস সালাম ও হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনাদের মাধ্যমে বিশ্বময় জারি রয়েছে।

একবার সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হুজরা শরীফ-এর বাইরে আসলেন, অতঃপর পর্যায়ক্রমে হযরত ইমাম হাসান আলাইহিস সালাম, হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম, হযরত ফাতিমাতু যাহরা আলাইহাস সালাম ও হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহূ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এসে উপস্থিত হলেন। হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সকলকে এক চাদরতলে নিয়ে বলেন, “আয় আল্লাহ পাক! উনারা আমার আহলে বাইত। আয় আল্লাহ পাক! উনাদের থেকে আপনি অপবিত্রতা দূর করুন এবং উনাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র রাখুন।’ এর পর এ আয়াত শরীফ নাযিল হয়: “হে আহলে বাইত! আল্লাহ পাক অবশ্যই চান আপনাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং আপনাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।”

নজরানের ঈসায়ীদের (খ্রিস্টানদের) একটি প্রতিনিধি দল মদীনা শরীফ-এ আগমন করে। তাদের সঙ্গে আলোচনার ব্যাপারে কুরআন শরীফ-এ উল্লেখ রয়েছে। তাদের অস্বীকৃতিতে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দোয়ার মাধ্যমে এর ফয়ছালা চান। এটাকে “দাওয়াতে মুবাহালা” বলা হয়। হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আহলে বাইত আলাইহিমুস সালাম উনাদের কয়েজন সদস্য উনাদেরকে নিয়ে বাইরে তাশরীফ আনেন। এসব নূরানী চেহারা মুবারক দেখে ঈসায়ীদের প্রধান পাদ্রী উনার দলের লোকদেরকে বলেন: “আমি এমন সব পবিত্র চেহারা মুবারক দেখছি, উনাদের দোয়া পাহাড়সমূহকেও আপন স্থান হতে হটিয়ে দিতে পারে। সুতরাং উনাদের সাথে মুবাহালা করে ধ্বংস হয়ো না।” আহলে বাইত আলাইহিমুস সালাম উনাদের সদস্য হিসেবে সাইয়্যিদু শাবাবি আহলিল জান্নাহ হযরত ইমাম হাসান আলাইহিস সালাম তথায় উপস্থিত ছিলেন।

হযরত আবু বাকরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন: হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের সাথে নামায পড়ছিলেন। এমন সময় হযরত হাসান আলাইহিস সালাম আসলেন; তখন তিনি ছোট্ট শিশু। হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন সিজদায় ছিলেন। সাইয়্যিদু শাবাবি আহলিল জান্নাহ হযরত ইমাম হাসান আলাইহিস সালাম তিনি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পৃষ্ঠ মুবারকে অথবা কাঁধ মুবারকে উঠে বসলেন। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে নিয়েই অতি স্নেহপরায়ণভাবে দ-ায়মান হলেন। তিনি যখন নামায শেষ করলেন, লোকেরা উনাকে জিজ্ঞাসা করলেন: হে আল্লাহ পাক উনার রসূল! আপনি এই শিশু উনার সঙ্গে যেরূপ ব্যবহার করলেন তা আপনি আর কারো সঙ্গে করেননি। আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করলেন, “ইনি হচ্ছেন আমার রায়হানা অর্থাৎ আমার এক ফুল, আমার এ সন্তান তিনি হচ্ছেন সাইয়্যিদ, অচিরেই আল্লাহ পাক উনার দ্বারা মুসলমানদের দু’টি  দলের মধ্যে সন্ধি স্থাপন করবেন।

হযরত ইমাম না’ঈম রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, আমাকে হযরত আবু হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেছেন, যখনই আমি সাইয়্যিদু শাবাবি আহলিল জান্নাহ হযরত ইমাম হাসান আলাইহিস সালাম উনাকে দেখতাম আমার চোখে পানি আসত। এটা এ কারণে যে, একদিন আমি দেখতে পেলাম সাইয়্যিদু শাবাবি আহলিল জান্নাহ হযরত ইমাম হাসান আলাইহিস সালাম তিনি দ্রুতবেগে এসে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কোল মুবারকে বসে গেলেন। অতঃপর তিনি দুই হাতে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দাড়ি মুবারক ধারণ করলেন, আর হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র মুখ মুবারক সাইয়্যিদু শাবাবি আহলিল জান্নাহ হযরত ইমাম হাসান আলাইহিস সালাম উনার পবিত্র মুখ মুবারক-এর নিকটবর্তী করলেন। এমতাবস্থায় তিনি ইরশাদ করলেন: ‘আয় আল্লাহ পাক! আমি উনাকে অবশ্যই মুহব্বত করি, সুতরাং আপনি উনাকে মুহব্বত করুন।’ এ পবিত্র বাক্যটি তিনি তিন বার উচ্চারণ করলেন।

সাইয়্যিদু শাবাবি আহলিল জান্নাহ হযরত ইমাম হাসান আলাইহিস সালাম উনার শত্রুরা উনাকে শহীদ করার উদ্দেশ্যে একে একে পাঁচবার বিষ পান করায়। প্রতিবারই তিনি অসুস্থ অবস্থায় নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র রওযা শরীফ-এ গিয়ে দুয়া করেন, আর সাথে সাথেই সুস্থ হয়ে যান। কিন্তু শেষ বার অর্থাৎ ৬ষ্ঠ বার যে বিষ পান করানো হয় তা ছিল অত্যন্ত মারাত্মক বিষ, অর্থাৎ হিরক চূর্ণ। সাইয়্যিদু শাবাবি আহলিল জান্নাহ হযরত ইমাম হাসান আলাইহিস সালাম উনার আদত ছিল এই যে, তিনি প্রতিদিন তাহাজ্জুদ নামাযের সময় পানি পান করতেন। উনি যে কলসী থেকে পানি পান করতেন সে কলসীর মুখ একটি কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতেন যেন কেউ কিছু ফেলতে বা বিষ মিশ্রিত করতে না পারে। কিন্তু শত্রুরা হিরকচূর্ণ বিষ কলসীর মুখে বেঁধে রাখা কাপড়ে মিশিয়ে দিয়ে গেল। সাইয়্যিদু শাবাবি আহলিল জান্নাহ হযরত ইমাম হাসান আলাইহিস সালাম প্রতিদিনের ন্যায় পানি পান করার জন্য কলসী থেকে পাত্রে পানি ঢাললেন- তখন হিরকচূর্ণ বিষসহ পানি পাত্রে পড়লো। তিনি তা পান করার সাথে সাথে মারাত্মক বিষক্রিয়া শুরু হলো এবং তিনি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এবার আর উনার পক্ষে নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার রওযা শরীফ-এ যাওয়া সম্ভব হলো না। সাইয়্যিদু শাবাবি আহলিল জান্নাহ হযরত ইমাম হাসান আলাইহিস সালাম বুঝতে পারলেন যে, উনার বিছাল শরীফ-এর সময় নিকটবর্তী। তাই তিনি ছোট ভাই সাইয়্যিদু শাবাবি আহলিল জান্নাহ হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনাকে সংবাদ দিলেন। তিনি আসলে সাইয়্যিদু শাবাবি আহলিল জান্নাহ হযরত ইমাম হাসান আলাইহিস সালাম তিনি বললেন, হে ভাই! এই খিলাফতের জন্য আমাদের পিতা শহীদ হয়েছেন। আমিও শহীদ হচ্ছি। কাজেই, এই খিলাফতের আমাদের কোন প্রয়োজন নেই। আপনি এই খিলাফত থেকে দূরে থাকবেন। খিলাফত ফিরিয়ে দেয়ার শর্ত বাতিল করে দেয়া হলো। এ কারণেই হযরত মুআবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম খিলাফত ফিরিয়ে নেননি।

উক্ত মারাত্মক বিষক্রিয়ার কারণেই ৪৯ হিজরী সনের ২৮শে ছফর প্রায় ৪৬ বৎসর বয়স মুবারকে তিনি শাহাদত বরণ করেন বা বিছাল শরীফ লাভ করেন। সাইয়্যিদু শাবাবি আহলিল জান্নাহ হযরত ইমাম হাসান আলাইহিস সালাম উনাকে পবিত্র জান্নাতুল বাক্বীতে সমাহিত করা হয়। মূলকথা হচ্ছে- নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খাছ আওলাদ ও আহলে বাইত উনাদের অন্যতম হচ্ছেন সাইয়্যিদু শাবাবি আহলিল জান্নাহ হযরত ইমাম হাসান আলাইহিস সালাম। উনার বরকতময় সাওয়ানেহ্্ উমরী বা জীবনী মুবারক জানা ও উনাকে যথাযথ মুহব্বত ও অনুসরণ-অনুকরণ করা সকলের জন্যই দায়িত্ব ও কর্তব্য অর্থাৎ ফরয।

 

মুহম্মদ শাফায়াত হুসাইন

বালুবাড়ী, দিনাজপুর

 

সুওয়াল: অনেকে মনে করে থাকে, পিতা-মাতা জীবিত থাকা কালে মুর্শিদ বা শায়খ-উনার নিকট বাইয়াত হওয়া যায় না। এ ধারণা কতুটুকু শুদ্ধ ও শরীয়তসম্মত? দয়া করে জানাবেন।

জাওয়াব: পিতা-মাতা জীবিত থাকা কালে শায়খ বা মুর্শিদ উনার নিকট বাইয়াত হওয়া যায় না। এটা একটি অবান্তর ধারণা। যা সম্পূর্ণরূপে শরীয়তের খিলাফ।

কালামুল্লাহ শরীফ-এর বহু আয়াত শরীফ-এ ইলম শিক্ষার বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছে।

ইরশাদ হয়েছে-

هل يستوى الذين يعلمون والذين لا يعلمون

অর্থ: যারা জানে এবং যারা জানে না তারা কি সমান? অর্থাৎ যাদের ইলম রয়েছে এবং যাদের ইলম নেই তারা কখনই সমান নয়। (সূরা যুমার: আয়াত শরীফ ৯)

যার কারণে আল্লাহ পাক তিনি বান্দাকে ইলম অর্জন ও বৃদ্ধির জন্য দোয়া করতে বলেছেন। ইরশাদ হয়েছে-

قل رب زدنى علما

অর্থ: হে হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি (উম্মতকে) বলে দিন, তারা যেনো তাদের খালিক্ব, মালিক, রব সুবহানাহূ তায়ালা-উনার নিকট দোয়া করে, ‘হে বারে ইলাহী! আপনি আমার বা আমাদের ইলম বৃদ্ধি করে দিন।’ (সূরা ত্বাহা: আয়াত শরীফ ১১৪)

এ আয়াত শরীফ-এর ব্যাখ্যায় হাদীছ শরীফ-এ বর্ণিত রয়েছে-

عن حضرت انس رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم طلب العلم فريضة على كل مسلم وفى رواية على كل مسلم ومسلمة.

অর্থ: “হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বর্ণনা করেন, আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য ইলম অর্জন করা ফরয।” (মুসলিম, ইবনে মাজাহ, বায়হাক্বী, মিশকাত, মাছাবীহুস্ সুন্নাহ, মুসনাদে আবূ হানীফা)

হাদীছ শরীফ-এ আরো ইরশাদ হয়েছে-

عن حضرت الحسن رحمة الله عليه قال العلم علمان فعلم فى القلب فذاك العلم النافع وعلم على اللسان فذالك حجة الله عز وجل على ابن ادم

অর্থ: “হযরত হাসান বছরী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বর্ণনা করেন, ইলম দু’প্রকার। একটি হচ্ছে ক্বলবী ইল্ম্ (ইলমে তাছাউফ) যা উপকারী ইলম। অপরটি হচ্ছে যবানী ইলম (ইলমে ফিক্বাহ) যা আল্লাহ পাক উনার তরফ থেকে বান্দার প্রতি দলীল স্বরূপ।” (দারিমী, মিশকাত, মিরকাত, মাছাবীহুস্ সুন্নাহ)

হযরত ইমাম আ’যম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, “ইলম শিক্ষা করা ফরয বলতে বুঝায় ইলমে ফিক্বাহ ও ইলমে তাছাউফ। উভয়টিই জরূরত আন্দাজ শিক্ষা করা ফরয।”

হযরত ইমাম আ’যম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি বিশ্ববিখ্যাত আলিম হওয়া সত্ত্বেও তিনি বলেন-

لولا سنتان لهلك ابو نعمان

অর্থ: “আমি ইমাম আ’যম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি ধ্বংস হয়ে যেতাম যদি দু’বছর না পেতাম।” (সাইফুল মুক্বাল্লিদীন, ফতওয়ায়ে ছিদ্দীক্বিয়া)

অর্থাৎ তিনি উক্ত দু’বছর হযরত ইমাম জা’ফর ছাদিক্ব আলাইহিস সালাম উনার দরবার শরীফ-এ থেকে ইলমে তাছাউফ হাছিল করেন।

উল্লেখ্য, হযরত ইমাম আ’যম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি প্রথমে হযরত ইমাম বাকির আলাইহিস সালাম উনার কাছে মুরীদ হন এবং উনার বিছাল শরীফ-এর পর উনারই ছেলে হযরত ইমাম জা’ফর ছাদিক্ব আলাইহিস সালাম উনার নিকট বাইয়াত হয়ে কামালিয়াত হাছিল করেন। যা বিশ্বখ্যাত গায়াতুল আওতার ফী শরহে দুররিল মুখতার, সাইফুল মুক্বাল্লিদীন, ইছনা আশারিয়া ইত্যাদি কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

হযরত মুল্লা আলী ক্বারী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বিশ্বখ্যাত কিতাব মিশকাত শরীফ-এর শরাহ মিরকাত শরীফ-এ হযরত ইমাম মালিক রহমতুল্লাহি আলাইহি (যিনি মালিকী মাযহাবের ইমাম)-উনার ক্বওল শরীফ উল্লেখ করেছেন যে-

من تفقه ولم يتصوف فقد تفسك ومن تصوف ولم يتفقه فقد تزندك ومن جمع بينهما فقد تحقق.

অর্থ: “যে ব্যক্তি ইলমে ফিক্বাহ শিক্ষা করলো অথচ ইলমে তাছাউফ শিক্ষা করলো না, সে ব্যক্তি ফাসিক। আর যে ব্যক্তি ইলমে তাছাউফ শিক্ষা করলো কিন্তু ইলমে ফিক্বাহ শিক্ষা করলো না অর্থাৎ গুরুত্ব দিল না, সে যিন্দিক (কাফির)। আর যে ব্যক্তি উভয়টিই অর্জন করলো, সে ব্যক্তি মুহাক্কিক।” (মিরকাত শরীফ)

আর ইলমে ফিক্বাহ অর্থাৎ ওযু, গোসল, ইস্তিঞ্জা, মুয়ামিলাত, মুয়াশিরাত ইত্যাদি শিক্ষার জন্য ওস্তাদ গ্রহণ করা যেমন ফরয (আবশ্যক), সেটা মাদরাসায় গিয়েই হোক অথবা ব্যক্তিগতভাবে কোন ওস্তাদের নিকট থেকেই হোক তা জরূরত আন্দাজ শিক্ষা করা ফরয। তদ্রƒপ ইলমে তাছাউফের জন্যও ওস্তাদ গ্রহণ করা ফরয। আর এ ওস্তাদকেই আরবীতে ‘শায়খ’ বা ‘মুর্শিদ’ বলা হয়। আর ফারসীতে ‘পীর’ বলা হয়।

‘দুররুল মুখতার’ যা বিশ্বখ্যাত ফতওয়ার কিতাব তার মধ্যে একটি উছূল উল্লেখ করা হয়েছে-

ما لا يتم به الفرض فهو فرض ما لايتم به الواجب فهو واجب.

অর্থ: “যে আমল ব্যতীত ফরয পূর্ণ হয় না, সে আমল করাও ফরয। যে আমল ব্যতীত ওয়াজিব পূর্ণ হয়না, সে আমল করাও ওয়াজিব।”

ইলমে ফিক্বাহ শিক্ষা করার জন্য প্রত্যেকের পিতা-মাতা অথবা মুরুব্বীগণই মাদরাসায় ভর্তি করিয়ে থাকেন। কারো যদি পিতা-মাতা অথবা মুরুব্বী জীবিত না থাকেন, তাহলে তার পক্ষে ইলমে ফিক্বাহ শিক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে এবং সময় বিশেষে অসম্ভবও হয়ে যায়। কেননা ইলমে ফিক্বাহ শিক্ষা করার সময় যেমন থাকা-খাওয়া, লেখা-পড়া ইত্যাদির জন্য টাকা-পয়সার জরূরত হয়, সে টাকা-পয়সার আঞ্জাম দেন পিতা-মাতা অথবা মুরুব্বীগণ। অনুরূপ ইলমে তাছাউফ শিক্ষা করার সময়ও থাকা-খাওয়া, লেখা-পড়া ইত্যাদির জন্য টাকা-পয়সার জরূরত হয় এবং সে টাকা-পয়সার আঞ্জাম দেন পিতা-মাতা ও মুরুব্বীগণ এটাই যদি সত্য হয় যে, পিতা-মাতা অথাব মুরুব্বীগণ জীবিত থাকাকালীন ইলমে তাছাউফ শিক্ষা করা যাবে না, তাহলে যে সকল সন্তানেরা পিতা-মাতা জীবিত থাকা অবস্থায় ইন্তেকাল করলো, তারা তো ইলমে তাছাউফ শিক্ষা করতে পারলো না, যা তাদের জন্য ফরয ছিল। যার ফলে তারা একটি ফরয আদায় করা হতে মাহরূম থেকে গুনাহগার হলো আর যদি পিতা-মাতা জীবিত থাকা অবস্থায় ইলম অর্জন করা না যায়, তাহলে সন্তানদের ইলম অর্জন করার জন্য পিতা-মাতার মৃত্যু কামনা করতে হবে। নাঊযুবিল্লাহ!

কাজেই, পিতা-মাতা জীবিত থাকা অবস্থায় শায়খ বা মুর্শিদ উনার নিকট বাইয়াত হওয়া যাবে না-এ ধারণা বা বক্তব্য সম্পূর্ণরূপে কুরআন-সুন্নাহর খিলাফ এবং কুফরীর অন্তর্ভুক্ত।

 

মুহম্মদ আলী আকবর

রাজারহাট, কুড়িগ্রাম

 

সুওয়াল: খিলাফত, খলীফা, পীর বা মুর্শিদ গদীনশীন পীর ইত্যাদি বিষয়গুলির সঠিক ব্যাখ্যা জানিয়ে বাধিত করবেন।

জাওয়াব: খিলাফত: সালিক তরীক্বতের রাস্তায় প্রবেশ করে কামিল ওলী বা মুর্শিদ উনার ছোহবত ইখতিয়ার করতঃ তরীক্বতের সবকাদি আদায় করার মাধ্যমে বিভিন্ন মাক্বাম বা মঞ্জিল অতিক্রম করে যখন তাকমীল বা পূর্ণতায় পৌঁছেন তখন আল্লাহ পাক ও উনার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের নির্দেশে মুর্শিদ ক্বিবলা উনাকে পূর্ণতার যে সনদ প্রদান করেন তার নামই খিলাফত।

খলীফা ও পীর বা মুর্শীদ: যিনি খিলাফত লাভ করেন উনাকে খলীফা বলা হয়। প্রত্যেককে খিলাফত লাভ করে খলীফা হয়ে পীর বা মুর্শীদ হতে হয়। তিনি গদীনশীন হোন বা না হোন তা শর্ত নয়। তবে খিলাফত লাভ না করে কেউই পীর বা মুর্শিদ হতে পারে না। অতএব, পীর বা মুর্শিদের ছেলে হোক, ভাই হোক, পীর বা মুর্শিদ হওয়ার জন্য তাঁকেও অবশ্যই খিলাফত লাভ করতে হবে। অন্যথায় তিনি পীর বা মুর্শিদ হতে পারবেন না।

গদীনশীন পীর বা মুর্শিদ: ‘গদীনশীন’ শব্দটি ফার্সী। গদী অর্থ আসন আর নশীন অর্থ উপবেশনকারী। অর্থাৎ আসনে উপবেশনকারী। পীর-মুর্শিদের অবর্তমানে বা ইনতিকালের পর তাঁদের গদী বা আসনে বসে যিনি দায়িত্ব পালন করেন তাঁকে বলা হয় গদীনশীন পীর বা মুর্শিদ।

আজকাল দেখা যায়, পীর বা মুর্শিদের আত্মীয়-স্বজন ও মুরীদেরা মিলে আলোচনা বা পরামর্শ করে পীর মুর্শিদের গদীনশীন ও খলীফা নির্বাচিত করছে। নাউযুবিল্লাহ! যা শরীয়ত ও তরীক্বতের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।

পীর বা মুর্শিদের ছেলে হোক, জামাই হোক, ভাই হোক, মুরদী হোক ইত্যাদি যেই হোক না কেন সে যদি পূর্বে যে খিলাফতের বর্ণনা দেয়া হয়েছে সেই খিলাফত না পেয়ে থাকে তাহলে তাকে গদীনশীন কিংবা খলীফা হিসেবে গ্রহণ করা জায়িয নেই। খিলাফত লাভ না করে যারা গদীনশীন বা খলীফা নির্বাচিত হবে শরীয়ত ও তরীক্বতের পথে তারা অন্ধ। এক অন্ধ আরেক অন্ধকে রাস্তা দেখাতে পারে না।

কাজেই, এসব গদীনশীন ও খলীফা এবং তাদের যারা অনুসারী সকলকেই একজন খিলাফতপ্রাপ্ত মুর্শিদ বা ওলী উনার নিকট বাইয়াত হয়ে তাকমীলে পৌঁছার জন্য কোশেশ করতে হবে। (সমূহ তাছাউফ-এর কিতাব দৃষ্টব্য)

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ

সুওয়াল – জাওয়াব বিভাগ